বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে সেটি কখন হবে কেউ বলতে পারবে না। ফলে আতঙ্ক তৈরি না করে, ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী।

তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস ভূমিকম্পের এমন সতর্ক বার্তা দেওয়ার কর্তৃপক্ষ নয়। এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সতর্ক করতে পারে। এ ছাড়া দুর্যোগ পরবর্তী করনীয় ঠিক করার জন্য সরকারের একটি কারিগরি কমিটি আছে। তবে ফায়ার সার্ভিস যে বার্তা দিয়েছে তা আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি। বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে সেটি কখন হবে কেউ বলতে পারবে না। ফলে আতঙ্ক তৈরি না করে, ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

ভূমিকম্পে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে সারা বিশ্ব। সেই কম্পনে বাংলাদেশের মানুষও স্তম্ভিত, আতঙ্কিত। ছোট ছোট কম্পন দিচ্ছে বড় ভূমিকম্পের বার্তা। প্রতিবারই বিশ্বের কোথাও ভূমিকম্প হলে, শুরু হয় আলোচনা। রাজধানীসহ সারাদেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে কিছু দিন চলে কথাবার্তা। সপ্তাহ না ঘুরতেই থেমে যায় ভূমিকম্প নিয়ে তোড়জোড়। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক হতাহতের পর শনিবার সকালে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের সতর্কবার্তায় মানুষের মনে নতুন করে উৎকণ্ঠা ভর করেছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও একই ধরনের বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের বিষয়ে সতর্কতা জারির দায়িত্ব ফায়রা সার্ভিসের নয়। এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মন্ত্রণালয় সতর্কতা দিতে পারে। এ ছাড়া ভূমিকম্প পরবর্তীতে কী করতে হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সরকারের একটি কারিগরি উপদেষ্টা পরিষদ আছে।

পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফায়ার সার্ভিস যে বার্তা দিয়েছে তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যে কোনো সময় প্রাকৃতিক এ দুর্যোগটির আঘাতের শঙ্কা থাকলেও মোকাবিলায় নেই প্রস্তুতি। এমন পরিস্থতিতে আতঙ্ক তৈরি না করে মানুষকে সচেতন করতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে পরপর দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প দুটির মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৭ ও ৬ দশমিক ৪। এতে দেশ দুটি বেশ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশেও একই ধরনের বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চল উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার করতে হবে। বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইন ঠিকঠাক আছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসাপাতাল ও অন্যান্য জরুরি নম্বরগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সব ভবন কিংবা স্থাপনায় সংরক্ষণ করতে হবে। এগুলো দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখতে হবে। জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সরঞ্জাম, যেমন টর্চলাইট, রেডিও (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ), বাঁশি, হ্যামার, হেলমেট, শুকনা খাবার, সুপেয় পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও শিশুযত্নের সামগ্রী বাসাবাড়িতে নির্ধারিত স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে।

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ১৮৬৯ সালে সিলেটের কাছার এলাকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ও ১৯২৩ সালে দুর্গাপুরেও বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ফলে সেখানে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা সুপ্ত অবস্থায় আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প সেটিকে নাড়াচাড়া দিতে পারে। সম্প্রতি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি– মানে এই নয় যে, আর বড় ভূমিকম্প হবে না। তাই এক্ষুনি প্রস্তুতি নিতে হবে।

তিনি বলেন, যখন ভূমিকম্প হয় তখন কিছু দিন আলোচনা চলে। কিন্তু পরে সবাই ভুলে যান।  যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাও লেজেগোবরে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে ঘূর্ণিঝড় গবেষণা কেন্দ্র। যন্ত্রপাতি থাকলেও ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে পড়ছে। দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য জরুরি পরিচালন কেন্দ্র তৈরি হলেও জনবল নিয়োগ হয়নি। ঢাকায় ৬ লাখ ভবনের ৬৬ শতাংশই নিয়ম মেনে হয়নি, নতুন ভবনগুলোতেও উপেক্ষিত নীতিমালা। দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বিল্ডিং কোড। শুধু ভূমিকম্প নিয়ে সরকারের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত বলে মনে করেন এ অধ্যাপক।

অধ্যাপক মেহেদি হাসান আনসারী বলেন, সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময় বলা না গেলেও বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেটি ৫ থেকে ১০ বছর কিংবা এর পরও হতে পারে। সে অনুযায়ী আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। 

এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকায় চার লাখ আবাসিক ভবন ও সাড়ে তিন হাজার কারখানা ভবন আছে। এর মধ্যে এক হাজার কারখানা ভবন এবং ২৫ শতাংশ আবাসিক ভবনের নির্মাণে ত্রুটি পাওয়া গেছে। একটি ভবনকে ভূমিকম্প সহনশীলভাবে নির্মাণ করতে প্রতি বর্গফুটে ২৫ থেকে ৩০ টাকা খরচ হয়। আর ভবন নির্মাণের পর যদি তা ভূমিকম্প সহনশীল করতে হয়, তাহলে প্রতি বর্গফুটে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা খরচ হবে। সে তথ্য সবার সামনে তুলে ধরলে তা নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে। এর পর দরকার আইনের প্রয়োগ।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ ম কম প র ভ ম কম প ভ ম কম প র ড় ভ ম কম প প রস ত ত আতঙ ক ত র জন য ধরন র সতর ক আনস র

এছাড়াও পড়ুন:

নগর উন্নয়নে সবুজকে কেন্দ্রে রাখতে হবে

বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ সবুজ অঞ্চল রাখতে হয়। এ জন্য সব সংস্থার সমন্বয়ে স্বল্প–মধ্য–দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। শুধু নগর নয়, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে সারা দেশের জন্য প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান (নেচার–বেজড সলিউশন) দরকার। জীবনযাপনে যেন প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটাও একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে।

বুধবার ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে নগর উন্নয়নে প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিতে করণীয় বিষয়ক এক তথ্য সংকলন অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন নগরবিশেষজ্ঞরা। প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক জোট (আইইউসিএন) বাংলাদেশ এবং গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) যৌথভাবে সংকলনটি প্রণয়ন করেছে, যার অর্থায়ন করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। এতে ২০টি বিস্তৃতভাবে প্রয়োগযোগ্য ‘নেচার–বেজড সলিউশন’ উদ্যোগ উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে শহর পরিকল্পনাকারী, নীতিনির্ধারক ও উন্নয়ন অংশীদারদের জন্য একটি কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান বা নেচার–বেজ সলিউশন হচ্ছে প্রকৃতির কোনো ধরনের ক্ষতি না করে বা মাটি, বায়ু, পানিসহ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অটুট রেখে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন। তিনি বলেন, ‘এই সংকলন শুধু একটি নথি নয়, এটি আমাদের সবুজ ও নিরাপদ শহর গঠনের প্রতিশ্রুতিকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরে।’

প্রকৃতির কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত মন্তব্য করে ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন বলেন, ‘আমাদের জীবনযাপনে প্রকৃতি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক এস এম মেহেদি আহসান বলেন, নগরকে বাসযোগ্য করতে হলে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী ৩০ শতাংশ অঞ্চল সবুজ রাখতে হয়। বাংলাদেশের জাতীয় লক্ষ্য সেটাই হওয়া উচিত।
বিষয়টি বিবেচনা করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়ে এস এম মেহেদি আহসান বলেন, ‘আমাদের একটা বিল্ডিং কোড আছে। সেটা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থার দক্ষতার উন্নয়ন করার সুযোগ আছে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যে ১ হাজার ৪০০ প্রকল্প আছে। সেগুলোকে যদি প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের সঙ্গে যুক্ত করা যায় তাহলে একটা পরিবর্তন আসবে।’ তবে এটার জন্য সব মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ব্রিটিশ হাইকমিশনের ক্লাইমেট ও এনভায়রনমেন্ট উইংয়ের টিম লিডার নাথানিয়েল স্মিথ বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু অভিযোজন সব সময় তাঁদের অগ্রাধিকারের মধ্যে আছে। বাংলাদেশের প্রকৃতি, জীবন–জীবিকার সুরক্ষা দিতে ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

জলবায়ু অভিযোজন খাতে অধিক বিনিয়োগ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার কাজ করছে জানিয়ে নাথানিয়েল স্মিথ বলেন, ‘আমরা সুন্দরবন, হাকালুকি হাওরের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় এগুলো রক্ষা করা জরুরি।’

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশিদ মিয়া বলেন, ‘আমাদের চলমান কিছু প্রকল্পে আমরা প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের চর্চা করি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ক্লাইমেট মিটিগেটেড নলেজ হাব তৈরি করেছি। পাশাপাশি জার্মান সরকারের অর্থায়নে ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট লোকাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রকল্প চলছে।’ বাংলাদেশ সরকারের ১৩২টি প্রকল্প ও উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে ৩২টি প্রকল্পে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্য দেন আইইউসিএনের বাংলাদেশের অ্যাক্টিং কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রাকিবুল আমিন এবং জিসিএর ইন্টেরিম কান্ট্রি ম্যানেজার এম ফয়সাল রহমান। মূল প্রবন্ধ পড়েন বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক আলিয়া শাহেদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ