পেট্রাপোলে যেন ‘লকডাউন’, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা
Published: 7th, April 2025 GMT
আচমকা বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত হয়ে ভারতের পেট্রাপোলে পৌঁছলে আপনি ভয় পেতে পারেন। হঠাৎ করে আবার ভারতে লকডাউন শুরু হয়েছে, এমন ভেবে আতঙ্কিতও হতে পারেন। কারণ পরিস্থিতি এমনই। চারদিকে খাঁ খাঁ! কেউ বলছেন পরিস্থিতি নাকি ধূ ধূ মরুভূমির মতো। কেউ আবার বলছেন কোভিডকালেও এই চিত্র দেখা যায়নি। তবে যে যাই বলুক না কেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলের চেহারা যে মোটেই ভালো নয়, তা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন।
পরিসংখ্যান বলে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পেট্রাপোল-বেনাপোল আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রায় কয়েক হাজার মানুষ যাতায়াত করে থাকে। ঈদ কিংবা অন্য উৎসবের মৌসুমে সেই সংখ্যা অনেকটাই বাড়ে। বিশেষ করে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছে ভারত তথা কলকাতা হয়ে উঠে প্রিয় ভ্রমণস্থল। সেইসব বাংলাদেশি পর্যটকদের অধিকাংশই আবার আসে পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে। আর সেই বিদেশি পর্যটকদের ওপরই নির্ভরশীল পেট্রাপোল বন্দরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের রুটি-রোজগার। পরিবহন, খুচরো ব্যবসায়ী, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র, ফলওয়ালা, কসমেটিক্স বিক্রেতা, ভাতের হোটেল, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রিকশাচালক- সকলেরই উপার্জন নির্ভর করে এই পর্যটকদের আগমনের ওপর। কিন্তু সেই উপার্জনেই আজ বড় ধাক্কা বাংলাদেশি পর্যটকদের অনুপস্থিতি।
বিশেষ করে গত বছরের ঈদেও যেখানে পেট্রাপোল স্থলবন্দর এলাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ে যুক্ত মানুষজন দম ফেলার ফুরসত পাননি। আর এবার কার্যত ‘মাছি মারতে’ হচ্ছে তাদের। বৃহস্পতিবার পেট্রাপোল স্থলবন্দর ঘুরে দেখা গেলো এক হতাশা ও অলসতার ছবি। ভ্যানওয়ালা থেকে শুরু করে পরিবহন ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই ‘লক্ষ্মী লাভের’ আশায় দিন গুনছেন।
দেশ ট্রাভেলস-এর কলকাতা চ্যাপ্টারের মালিক মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখ জানান, বরাবর ঈদে আমরা যে ব্যবসা করে থাকি, সেই তুলনায় এবার খুবই খারাপ ছিল। ভারত সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ৬০ শতাংশ টুরিস্ট ভিসা, ৩০ শতাংশ মেডিকেল ভিসা এবং বাকি অন্য ভিসা প্রদান করে থাকে। কিন্তু এবারে ভিসা ইস্যু হয়নি বলে কোন রকম ব্যবসা পাইনি। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক ছিল তখন প্রতিদিন দেশ ট্রাভেলস-এর ৮টি বাস চলাচল করতো কলকাতার নিউ মার্কেট থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত। আর এখন পর্যটকের অভাবে ওই একই যাত্রাপথে মাত্র ১টি বাস চলাচল করে, তাও আবার মাসে ১৫ দিন।
তার দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে পেট্রাপোল চেকপোস্ট কিংবা কলকাতার নিউ মার্কেটে মাত্র ২ শতাংশ ব্যবসা চলছে, বাকি ৯৮ শতাংশই বন্ধ। যাত্রীসংখ্যা কম, তেল খরচের অর্থও উঠছে না তাই শ্যামলী এসপি, সোহাগ, এনআর, সৌদিয়া, গ্রিন লাইন, রয়েল কোচসহ প্রতিটি পরিবহন সংস্থায় তাদের বাস পরিসেবা বন্ধ রেখেছে।
কিন্তু মাস কয়েক আগেও তথাকথিত এই ‘ব্যাড প্যাচ’ বা ব্যবসায়িক মন্দা ছিল না। শুরুটা হয়েছে গত ৫ আগস্ট ছাত্র অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ঘটনার আট মাস কেটে গেলেও ক্ষত শুকোয়নি। নিরাপত্তা ও কর্মী সংকটের কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য সাধারণ ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে ভারত সরকার। আবার মেডিকেল ভিসা চালু থাকলেও তা প্রদানের সংখ্যা খুবই কম। আর তার প্রভাব গিয়ে পড়েছে ব্যবসায়। পর্যটকের অভাবে যেমন কলকাতার নিউ মার্কেটে প্রভাব পড়েছে, অনেক ব্যবসায়ীরা যেমন তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন বা অন্য ব্যবসায় ঝুঁকছেন, ঠিক তেমনই অবস্থা পেট্রাপোল স্থল বন্দরেও।
বৈদেশিক বিনিময়কেন্দ্রের মালিক বাবলু রায় জানান, আগে যে পরিস্থিতিতে কাজ করতাম সেটাই ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগে প্রতিদিন গড়ে ২৫/৩০ জন পর্যটক আসতেন। কিন্তু বর্তমান দুই-তিন মাস মিলিয়েও সেই গ্রাহক পাই না। এমনকি ঈদের সময় যে পরিমাণ পর্যটক আসতেন, আনন্দ উপভোগ করতেন, এবার সেটাও নেই। তার প্রভাব ব্যবসায় পড়েছে।
তিনি আরো জানান, বর্তমানে মেডিকেল এবং তীর্থ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশি পর্যটকরা কলকাতা ও ভারতে আসছেন। তবে সেই সংখ্যাটা খুবই কম। তার অভিমত, টুরিস্ট ভিসা যতদিন না চালু হবে ততদিন স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিকে লকডাউনের সাথে তুলনা টেনে গ্রিন লাইন পরিবহনের কর্মী সুব্রত ঘোষ জানান, লকডাউনের সময় বুঝতাম সেটা বন্ধ, কিন্তু এখন না খোলা, না বন্ধ। সাধারণ মানুষ পুরোপুরি শুয়ে পড়েছে। আগে প্রতিদিন প্রতিটি পরিবহনের তরফে চারটি করে বাস আসা-যাওয়া করত। এখন সব পরিবহন একত্রিত হয়ে একটি করে বাস ছাড়া হয়।
পেট্রাপোল সীমান্তে ‘কস্তূরী’ নামক ভাতের হোটেলের কর্মী প্রসেনজিৎ পাল জানান, হোটেলটি মূলত বাংলাদেশি পর্যটকের ওপরে নির্ভরশীল। আগে প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাড়ি ভাত হতো, আর এখন মাত্র দুই হাড়ি। আগে আয় হতো ১২ হাজার রুপির উপর, আর এখন সেটা নেমে এসেছে দুই হাজারের কম।
এমনকি, বাংলাদেশি পর্যটকদের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে চাকা ঘোরে পেট্রাপোল সীমান্তে এক স্থানীয় লটারির টিকিট বিক্রেতারও। চন্দন দত্ত নামে ওই লটারির টিকিট বিক্রেতা জানান, এখানে যেমন স্থানীয় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা টিকিট কিনতেন, সেভাবে বাংলাদেশি পর্যটকরাও। অনেক বাংলাদেশি লটারিতে নগদ অর্থও জিতেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেবলমাত্র স্থানীয়দের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। আগে যেখানে দৈনিক ১ হাজার রুপি আয় হতো, এখন ১০০ রুপিও হয় না।
সম্প্রতি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে শীতলতা আসার পেছনে সামাজিক মাধ্যমের একাংশকে দায়ী করেছেন পরিবহন ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখ। তার মতে, যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, দুই দেশের সু-সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের একটি অংশে ভারত বয়কটের ডাক উঠলেও তারা বুঝতে পারছে যে ভারতের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।
ঢাকা/সুচরিতা/এনএইচ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস য পর বহন কলক ত র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ
রাজধানী ঢাকা থেকে ছুটিতে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন হাবিবুল আউয়াল। ভালো হোটেলে রুম না পাওয়ায় শহরের কলাতলী এলাকায় মধ্যমমানের একটি আবাসিক হোটেলে উঠেছেন। তাঁর কাছে এক রাতের জন্য হোটেলটির দুটি রুমের ভাড়া নেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। যদিও অন্য সময়ে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায় এই মানের হোটেলে রুম ভাড়া পাওয়া যায়। ঈদ মৌসুমে চাহিদা বাড়ায় অন্য সময়ের তুলনায় ১২ গুণের বেশি ভাড়া নেওয়া হয়েছে তাঁর কাছ থেকে।
কোরবানির ঈদ ও পরবর্তী ছুটির সময়ে অতিরিক্ত পর্যটক আসায় কক্সবাজার শহর ও এর আশপাশের পাঁচ শতাধিক আবাসিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস ও রিসোর্টের প্রায় প্রতিটিতেই অন্য সময়ের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ গুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। শুধু আবাসিক হোটেল নয়, রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে পর্যটনসংশ্লিষ্ট সব সেবা খাতেই অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, প্রতিটি ছুটির মৌসুমে কক্সবাজারে পর্যটকদের সংখ্যা একটু বাড়লেই তাদের কাছ থেকে ‘গলাকাটা’ টাকা নেওয়া হয়।
ঈদুল আজহার লম্বা ছুটি শেষ হচ্ছে আজ। গতকাল শুক্রবার কক্সবাজার সৈকতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় ছিল পর্যটকের ভিড়। সাগরতীর পরিণত হয়েছিল উৎসবের বেলাভূমিতে। শুক্রবার সকাল থেকে তীব্র গরম থাকলেও পর্যটকে পূর্ণ ছিল কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট, লাবণী, কলাতলী, হিমছড়ি, ইনানী, পাতুয়ারটেক থেকে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত পুরো এলাকা।
রাজধানীর মতিঝিল থেকে ঘুরতে আসা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এখন সমুদ্রে গোসল করছি। বিকেলে মেরিন ড্রাইভে ঘুরব, এরপর শনিবার রাতে ঢাকায় ফিরে যাব।’ নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা আসিফ আহমেদ বলেন, ‘অনেক মানুষ, তবুও পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করছি, ছবি তুলছি, বিচ বাইক ও ঘোড়ায় চড়েছি।’
কক্সবাজার শহরের পাঁচতারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস লিমিটেডের বিপণন ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ নুর সোমেল সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার পর্যন্ত তাদের হোটেলের ৭০-৮৫ শতাংশ রুম বুকিং রয়েছে। যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক হোটেল ব্যবসায়ী জানান, ১৩ জুন পর্যন্ত অধিকাংশ আবাসিক হোটেল সম্পূর্ণ বুকিং হয়ে গেছে। তবে প্রশাসন, কর ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিতে তারা বিষয়টি স্বীকার করতে চান না।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের এএসপি নিত্যানন্দ দাস বলেন, এবার কোরবানির ঈদের পর গত সাত দিনে আট লাখের বেশি মানুষ কক্সবাজার ভ্রমণ করেছেন। তিনি বলেন, অতীতের মতো এবারও শহর ও সমুদ্রসৈকতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধে ওয়াচ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সৈকতের প্রতিটি গোলঘরে সার্বক্ষণিক পুলিশের অবস্থান এবং মোবাইল টিমসহ কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পর্যটন স্পটগুলোতে সাদা পোশাকেও দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা।
আবাসিক হোটেলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে এএসপি জানান, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত কয়েকদিন এমন পাঁচটি অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহিদুল আলম বলেন, পর্যটকদের হয়রানি রোধে তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত মাইকিং করা হচ্ছে।