আচমকা বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত হয়ে ভারতের পেট্রাপোলে পৌঁছলে আপনি ভয় পেতে পারেন। হঠাৎ করে আবার ভারতে লকডাউন শুরু হয়েছে, এমন ভেবে আতঙ্কিতও হতে পারেন। কারণ পরিস্থিতি এমনই। চারদিকে খাঁ খাঁ! কেউ বলছেন পরিস্থিতি নাকি ধূ ধূ মরুভূমির মতো। কেউ আবার বলছেন কোভিডকালেও এই চিত্র দেখা যায়নি। তবে যে যাই বলুক না কেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলের চেহারা যে মোটেই ভালো নয়, তা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। 

পরিসংখ্যান বলে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পেট্রাপোল-বেনাপোল আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রায় কয়েক হাজার মানুষ যাতায়াত করে থাকে। ঈদ কিংবা অন্য উৎসবের মৌসুমে সেই সংখ্যা অনেকটাই বাড়ে। বিশেষ করে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছে ভারত তথা কলকাতা হয়ে উঠে প্রিয় ভ্রমণস্থল। সেইসব বাংলাদেশি পর্যটকদের অধিকাংশই আবার আসে পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে। আর সেই বিদেশি পর্যটকদের ওপরই নির্ভরশীল পেট্রাপোল বন্দরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের রুটি-রোজগার। পরিবহন, খুচরো ব্যবসায়ী, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র, ফলওয়ালা, কসমেটিক্স বিক্রেতা, ভাতের হোটেল, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রিকশাচালক- সকলেরই উপার্জন নির্ভর করে এই পর্যটকদের আগমনের ওপর। কিন্তু সেই উপার্জনেই আজ বড় ধাক্কা বাংলাদেশি পর্যটকদের অনুপস্থিতি। 

বিশেষ করে গত বছরের ঈদেও যেখানে পেট্রাপোল স্থলবন্দর এলাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ে যুক্ত মানুষজন দম ফেলার ফুরসত পাননি। আর এবার কার্যত ‘মাছি মারতে’ হচ্ছে তাদের। বৃহস্পতিবার পেট্রাপোল স্থলবন্দর ঘুরে দেখা গেলো এক হতাশা ও অলসতার ছবি। ভ্যানওয়ালা থেকে শুরু করে পরিবহন ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই ‘লক্ষ্মী লাভের’ আশায় দিন গুনছেন। 

দেশ ট্রাভেলস-এর কলকাতা চ্যাপ্টারের মালিক মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখ জানান, বরাবর ঈদে আমরা যে ব্যবসা করে থাকি, সেই তুলনায় এবার খুবই খারাপ ছিল। ভারত সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ৬০ শতাংশ টুরিস্ট ভিসা, ৩০ শতাংশ মেডিকেল ভিসা এবং বাকি অন্য ভিসা প্রদান করে থাকে। কিন্তু এবারে ভিসা ইস্যু হয়নি বলে কোন রকম ব্যবসা পাইনি। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক ছিল তখন প্রতিদিন দেশ ট্রাভেলস-এর ৮টি বাস চলাচল করতো কলকাতার নিউ মার্কেট থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত। আর এখন পর্যটকের অভাবে ওই একই যাত্রাপথে মাত্র ১টি বাস চলাচল করে, তাও আবার মাসে ১৫ দিন। 

তার দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে পেট্রাপোল চেকপোস্ট কিংবা কলকাতার নিউ মার্কেটে মাত্র ২ শতাংশ ব্যবসা চলছে, বাকি ৯৮ শতাংশই বন্ধ। যাত্রীসংখ্যা কম, তেল খরচের অর্থও উঠছে না তাই শ্যামলী এসপি, সোহাগ, এনআর, সৌদিয়া, গ্রিন লাইন, রয়েল কোচসহ প্রতিটি পরিবহন সংস্থায় তাদের বাস পরিসেবা বন্ধ রেখেছে। 

কিন্তু মাস কয়েক আগেও তথাকথিত এই ‘ব্যাড প্যাচ’ বা ব্যবসায়িক মন্দা ছিল না। শুরুটা হয়েছে গত ৫ আগস্ট ছাত্র অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ঘটনার আট মাস কেটে গেলেও ক্ষত শুকোয়নি। নিরাপত্তা ও কর্মী সংকটের কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য সাধারণ ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে ভারত সরকার। আবার মেডিকেল ভিসা চালু থাকলেও তা প্রদানের সংখ্যা খুবই কম। আর তার প্রভাব গিয়ে পড়েছে ব্যবসায়। পর্যটকের অভাবে যেমন কলকাতার নিউ মার্কেটে প্রভাব পড়েছে, অনেক ব্যবসায়ীরা যেমন তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন বা অন্য ব্যবসায় ঝুঁকছেন, ঠিক তেমনই অবস্থা পেট্রাপোল স্থল বন্দরেও।

বৈদেশিক বিনিময়কেন্দ্রের মালিক বাবলু রায় জানান, আগে যে পরিস্থিতিতে কাজ করতাম সেটাই ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগে প্রতিদিন গড়ে ২৫/৩০ জন পর্যটক আসতেন। কিন্তু বর্তমান দুই-তিন মাস মিলিয়েও সেই গ্রাহক পাই না। এমনকি ঈদের সময় যে পরিমাণ পর্যটক আসতেন, আনন্দ উপভোগ করতেন, এবার সেটাও নেই। তার প্রভাব ব্যবসায় পড়েছে। 

তিনি আরো জানান, বর্তমানে মেডিকেল এবং তীর্থ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশি পর্যটকরা কলকাতা ও ভারতে আসছেন। তবে সেই সংখ্যাটা খুবই কম। তার অভিমত, টুরিস্ট ভিসা যতদিন না চালু হবে ততদিন স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে না। 

বর্তমান পরিস্থিতিকে লকডাউনের সাথে তুলনা টেনে গ্রিন লাইন পরিবহনের কর্মী সুব্রত ঘোষ জানান, লকডাউনের সময় বুঝতাম সেটা বন্ধ, কিন্তু এখন না খোলা, না বন্ধ। সাধারণ মানুষ পুরোপুরি শুয়ে পড়েছে। আগে প্রতিদিন প্রতিটি পরিবহনের তরফে চারটি করে বাস আসা-যাওয়া করত। এখন সব পরিবহন একত্রিত হয়ে একটি করে বাস ছাড়া হয়। 

পেট্রাপোল সীমান্তে ‘কস্তূরী’ নামক ভাতের হোটেলের কর্মী প্রসেনজিৎ পাল জানান, হোটেলটি মূলত বাংলাদেশি পর্যটকের ওপরে নির্ভরশীল। আগে প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাড়ি ভাত হতো, আর এখন মাত্র দুই হাড়ি। আগে আয় হতো ১২ হাজার রুপির উপর, আর এখন সেটা নেমে এসেছে দুই হাজারের কম। 

এমনকি, বাংলাদেশি পর্যটকদের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে চাকা ঘোরে পেট্রাপোল সীমান্তে এক স্থানীয় লটারির টিকিট বিক্রেতারও। চন্দন দত্ত নামে ওই লটারির টিকিট বিক্রেতা জানান, এখানে যেমন স্থানীয় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা টিকিট কিনতেন, সেভাবে বাংলাদেশি পর্যটকরাও। অনেক বাংলাদেশি লটারিতে নগদ অর্থও জিতেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেবলমাত্র স্থানীয়দের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। আগে যেখানে দৈনিক ১ হাজার রুপি আয় হতো, এখন ১০০ রুপিও হয় না। 

সম্প্রতি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে শীতলতা আসার পেছনে সামাজিক মাধ্যমের একাংশকে দায়ী করেছেন পরিবহন ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখ। তার মতে, যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, দুই দেশের সু-সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের একটি অংশে ভারত বয়কটের ডাক উঠলেও তারা বুঝতে পারছে যে ভারতের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।

ঢাকা/সুচরিতা/এনএইচ 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস য পর বহন কলক ত র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

হামলার পর আশা ও আতঙ্কের মধ্যে পেহেলগামে ধীরে ধীরে ফিরছেন পর্যটকেরা

ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামের কাছে এক প্রাণঘাতী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার এক সপ্তাহ পর শহরটিতে এখনো থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। অবশ্য সেখানে অল্প অল্প করে পর্যটক ফিরতে শুরু করেছেন।

গত সপ্তাহে শহরের প্রধান মহাসড়ক একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, খালি হয়ে গিয়েছিল হোটেলগুলো। এখন সেখানে আবার অল্প অল্প করে প্রাণ ফিরছে।

গত মঙ্গলবার পেহেলগাম থেকে তিন মাইল (৫ কিলোমিটার) দূরে পাহাড়চূড়ার উপত্যকা বৈসারানে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের ওপর গুলি চালায় একদল বন্দুকধারী। এই বৈসারানকে অনেক সময় ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়।

বৈসারানের হামলাকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যা অনেক পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে এবং ভারতজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কাশ্মীরের দুই অংশ দুই দেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তরে পুরো অঞ্চলকে দুই দেশই নিজেদের বলে দাবি করে থাকে।

দিল্লি এ হামলার কোনো সামরিক জবাব দেবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা বাড়ছে।

১৯৮৯ সালে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরুর পর থেকে কাশ্মীরে প্রায়ই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এসব ঘটনায় কখনো নিরাপত্তা বাহিনী আবার কখনো বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করা হয়েছে। কিন্তু পর্যটকদের এভাবে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা বিরল এবং তা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের হতবাক ও আতঙ্কিত করেছে।

১৯৮৯ সালে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরুর পর থেকে কাশ্মীরে প্রায়ই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এসব ঘটনায় কখনো নিরাপত্তা বাহিনী আবার কখনো বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করা হয়েছে। কিন্তু পর্যটকদের এভাবে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা বিরল এবং তা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের হতবাক ও আতঙ্কিত করেছে।

পেহেলগামের মতো এলাকার অর্থনীতি পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। হামলার জেরে সেখানে বহু মানুষের জীবিকা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুনকাশ্মীরে ব্যাপক ধরপাকড়, ভাঙা হচ্ছে বাড়ি: ‘আমার ভাই জড়িত থাকলেও পরিবারের অপরাধ কী’১৮ ঘণ্টা আগেহামলার পরদিন (২৩ এপ্রিল) ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেহেলগামের বৈসারান এলাকায় তল্লাশি অভিযান চালান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কাপ্তাই হ্রদের ‘দ্বীপে’ রিসোর্ট-কটেজ, টানছে পর্যটক
  • ভারতে অনলাইনে ছড়ানো হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষী গান, কনটেন্ট
  • হামলার পর আশা ও আতঙ্কের মধ্যে পেহেলগামে ধীরে ধীরে ফিরছেন পর্যটকেরা
  • কাশ্মীর সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে চতুর্থ দিনের মতো গোলাগুলি