সন্ত্রাসী সাজ্জাদকে ১৩ বছরেও ফেরানো যায়নি দেশে
Published: 8th, April 2025 GMT
চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের বিরুদ্ধে ১৩ বছর আগে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে রেড নোটিশ জারি করেছিল আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। তবে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি করেও এই সন্ত্রাসীকে ফেরাতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তার অবস্থান এখন কোথায়, তাও জানে না চট্টগ্রামের পুলিশ। সাজ্জাদ আলী বিদেশে বসে দিব্যি নিয়ন্ত্রণ করছেন চট্টগ্রামের অপরাধ জগৎ। তার অনুসারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাকে চাঁদা দেওয়া ছাড়া একটি ইটও সরানো যায় না। চাঁদা দিতে না চাইলে পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় কারখানা। গুলিতে ঝাঁজরা করা হয় ঘরবাড়ি। অনুসারীর পেছনে লাগলে খুনের শিকার হয় প্রতিপক্ষ।
সাজ্জাদকে ফেরানো দূরের কথা, তার অনুসারী সন্ত্রাসীদের নাগাল পেতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। তার আস্থাভাজন ছোট সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করলেও অধিকাংশ অনুসারী এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ সমকালকে বলেন, ‘বিদেশে পলাতক সাজ্জাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে ছোট সাজ্জাদ চাঁদাবাজি, হত্যাসহ নানা অপরাধ কার্যক্রম চালাচ্ছিল। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাজ্জাদকে ফেরাতে ইন্টারপোলে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো দেশ থেকে তার অবস্থান শনাক্ত করে ফিরতি বার্তা আসেনি।’
সাজ্জাদের সর্বশেষ অবস্থান ছিল ভারত
সাজ্জাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ এক ডজন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। ২০১২ সালের ১৪ এপ্রিল তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলে বার্তা পাঠায় বাংলাদেশ পুলিশ। তাকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। ওই বছরের ৭ নভেম্বর ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সাজ্জাদকে ফেরাতে দফায় দফায় চেষ্টা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে থাকা মামলার নথিও পাঠানো হয় ভারতে। তবে তাকে ফেরাতে ব্যর্থ হয় সরকার।
এর মধ্যে কয়েক বছর জেল খেটে দিল্লির তিহার কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে এখন তিনি ভারতেই অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আবদুল্লাহ পরিচয়ে পাঞ্জাবের এক নারীকে বিয়েও করেছেন তিনি। এই পরিচয়ে তার পাসপোর্টও রয়েছে। পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, ভারতে বসেই সাজ্জাদ চট্টগ্রামের অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিভিন্ন সময় চাঁদা চেয়ে যেসব ফোন করা হয়, সেগুলোর অবস্থান ভারত ছিল বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ।
অনুসারীর বদল হলেও চাঁদা নেওয়ার পদ্ধতি একই
নগরের বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জমি বেচাকেনা করলেই ফোন আসে সাজ্জাদের। চাঁদা নেন তার অনুসারীরা। সেই টাকার একটি অংশ তার কাছে পৌঁছে দেন তারা। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এভাবেই অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ রেখেছেন সাজ্জাদ। একসময় তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন নুরুন্নবী ম্যাক্সন ও সারোয়ার হোসেন বাবলা। এর মধ্যে নুরুন্নবী ভারতে পালিয়ে থাকা অবস্থায় মারা যান। বাবলা গ্রুপ ছেড়ে নিজেই বাহিনী গড়ে তুলেছেন। পরে আরেক সন্ত্রাসী ঢাকাইয়া আকবরকে চাঁদাবাজিতে নামান সাজ্জাদ। একাধিকবার গ্রেপ্তারের পর দলছুট হন তিনিও। পরে ছোট সাজ্জাদকে শিষ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চট্টগ্রাম নগরের ত্রাস হয়ে ওঠে ছোট সাজ্জাদ। গত ১৫ মার্চ তাকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
যেভাবে সাজ্জাদের উত্থান
নগরের বায়েজিদ বোস্তামীর জান আলী নগর চালিতাতলী এলাকার আব্দুল গনি কন্ট্রাক্টরের ছেলে সাজ্জাদ আলী খান। ১৯৯৯ সালের ২ জুন পাঁচলাইশ ওয়ার্ড কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খানকে বাড়ির সামনে খুন করে সন্ত্রাসী হিসেবে আবির্ভূত হন সাজ্জাদ। ২০০০ সালের ১২ জুলাই নগরের বহদ্দারহাটে দিনদুপুরে মাইক্রোবাস থামিয়ে ছাত্রলীগের ছয় নেতাকর্মীসহ আটজনকে ব্রাশফায়ারে খুন করা হয়। সেখানে সাজ্জাদ নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ ২০০০ সালের ১ অক্টোবর একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে জামিনে বেরিয়ে বিদেশে পালিয়ে যান।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর অবস থ ন অন স র নগর র অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তানিয়া আমিরের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর
২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তানিয়া আমিরের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
এক বিবৃতিতে প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে তানিয়া আমিরের বক্তব্য, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে, তাতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক হিসেবে তার নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ‘সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস’-এ পোস্ট করা এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে।
প্রেস উইং বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পেছনের সত্য উদঘাটনে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত উদ্যোগগুলো উপস্থাপন করেছে। উদ্যোগগুলো হচ্ছে:
তদন্ত কমিশন
২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর পিলখানা হত্যাকাণ্ড বিষয়ে পুনঃতদন্তের জন্য সাত সদস্যের জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে কমিশন কয়েক ডজন সাক্ষীর (এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৭ জন, যার মধ্যে অফিসার, বিডিআর সদস্য এবং ভুক্তভোগীদের পরিবার অন্তর্ভুক্ত) সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছে। এটি ‘ঘটনার প্রকৃত প্রকৃতি উন্মোচন’, সমস্ত দোষী ব্যক্তিকে শনাক্ত করা এবং এমনকি যেকোনো দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র তদন্তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে কমিশন একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এতে ২০০৯ সালের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যেকোনো ব্যক্তির কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকলে তা ওয়েবসাইট বা ই-মেলের মাধ্যমে জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সত্য উন্মোচনের অঙ্গীকার
স্বরাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পিলখানার হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ পুনঃতদন্তের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কমিশনের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, তদন্ত কমিশন ইতোমধ্যেই কয়েক ডজন সাক্ষীর সাক্ষ্য রেকর্ড করেছে এবং প্রয়োজনে তারা এমনকি শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে (যেমন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রাক্তন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ) ডাকবেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার ‘প্রকৃত প্রকৃতি উন্মোচিত’ হবে। মামলায় প্রকৃত অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং সম্ভাব্য সকল বিদেশি বা দেশীয় চক্রান্তের বিষয়গুলো খুঁজে দেখা হবে।
তথ্যের জন্য জনসাধারণের কাছে আবেদন
প্রাসঙ্গিক তথ্য থাকলে যেকোনো নাগরিক বা সংস্থাকে ওয়েবসাইট বা ই-মেলের মাধ্যমে জানানোর জন্য ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে তদন্ত কমিশন।
এটি ১৬ বছর আগের একটি অপরাধের তদন্তের জটিলতা তুলে ধরে এবং তথ্যদাতাদের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে। যা ‘সরকার বিষয়গুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে’— তানিয়া আমিরের এমন দাবির বিপরীতে এটি স্বচ্ছ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ আনুষ্ঠানিক প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
আদালতের মামলা এবং মুক্তি
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বিদ্রোহ-সম্পর্কিত মামলায় কয়েকশত সাবেক বিডিআর সদস্যকে জামিন দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে, তানিয়া আমিরের অভিযোগ— কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বন্দিদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। নিহত অফিসারদের পরিবার তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানায় যে, যারা সেনা অফিসারদের হত্যা করেছে, তাদের সম্পূর্ণ মুক্তি দেওয়া উচিত নয়। ইতোমধ্যে বেঁচে যাওয়া অফিসারদের পরিবারগুলো নতুন অভিযোগ দায়ের করেছে (যেমন: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে) এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে নতুন করে বিক্ষোভের হুমকি দিয়েছে।
নিহতদের স্মরণ
অন্তর্বর্তী সরকার পিলখানায় নিহতদের সম্মান জানাতে পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করেছে এবং পিলখানায় নিহত ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে ‘শহীদ’ মর্যাদা দিয়েছে।
প্রেস উইং বলছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তানিয়া আমিরের সম্পৃক্ততা সুপরিচিত। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তিনি এবং তার বাবা ব্যারিস্টার এম আমির-উল ইসলাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে সংসদীয় আসন কুষ্টিয়া-৩ এবং কুষ্টিয়া-৪ এর জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন, যা ওই দলের সঙ্গে সক্রিয় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত বহন করে।
তানিয়া আমিরের পারিবারিক পটভূমি আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তার বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং পরিবার ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। যদিও তিনি স্বাধীনভাবে আইনি মামলা করেছেন, তবু তাকে দলের রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থানের সাথে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হিসেবে দেখা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই সম্পৃক্ততার পরিপ্রেক্ষিতে, জেনেভা প্রেস ক্লাবে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে এবং ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে জড়িত সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহীদের প্রতিনিধিত্ব করে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্যকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, জেনেভা সম্মেলনে তানিয়া আমির এবং অন্যান্য বক্তারা কোনো নতুন প্রমাণ উদ্ধৃত করেননি; বরং তারা বছরের পর বছর ধরে বিরোধী পক্ষগুলোর মধ্যে প্রচারিত দাবিগুলো (যেমন: মৃত্যুর সংখ্যা, ক্ষতিপূরণ আইন, বন্দিদের মুক্তি) পুনরাবৃত্তি করেছেন বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
ঢাকা/হাসান/রফিক