বিদেশ থেকে টেলিফোন কল আনতে ১০ বছর আগে গড়ে ওঠা আইজিডব্লিউ অপারেটর ফোরামের (আইওএফ) সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান এটির ‘হোতা’ ছিলেন এবং সিন্ডিকেটটি থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠানেই ৬০০ কোটি টাকার বেশি গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ সিন্ডিকেটের কারণে গ্রাহকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সরকার রাজস্ব হারিয়েছে এবং বিশেষ গোষ্ঠী সুবিধা পেয়েছে। একসময় এ সিন্ডিকেটের অনুমোদন দিয়ে এখন অনিয়ম ও বাজার অস্থিতিশীলতার কথা বলে তা ভাঙতে চাইছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

হাতে হাতে যখন ইন্টারনেট ছিল না, তখন বিদেশ থেকে আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশে ফোনকল আনার ব্যবসা ছিল জমজমাট। ইন্টারনেটের প্রসার ও ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে গত কয়েক বছরে এ ব্যবসা প্রায় তলানিতে নেমেছে।

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২৪টি প্রতিষ্ঠানের আইজিডব্লিউ লাইসেন্স রয়েছে। বর্তমানে বিদেশ থেকে প্রতিদিন টেলিফোন কল আসে ১ কোটি মিনিটের কিছু বেশি, যা ১০ বছর আগে ছিল ১০ কোটি মিনিটের বেশি।

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২৪টি প্রতিষ্ঠানের আইজিডব্লিউ লাইসেন্স রয়েছে। বর্তমানে বিদেশ থেকে প্রতিদিন টেলিফোন কল আসে ১ কোটি মিনিটের কিছু বেশি, যা ১০ বছর আগে ছিল ১০ কোটি মিনিটের বেশি।

টেলিযোগাযোগ খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, আইওএফ ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনুমোদিত রাজস্ব ফাঁকির এক ব্যবস্থা। ক্ষমতাচ্যুত এ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সায়ে গড়ে ওঠে এ সিন্ডিকেট, যা নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান। টেলিযোগাযোগ খাতের নানা পক্ষের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিটিআরসি ২০১৫ সালের ২৪ জুন থেকে আইওএফের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফোনকল আনার নতুন নিয়মের অনুমোদন দেয় সরকার। এ নিয়মে ২৩টি আইজিডব্লিউ অপারেটরের মধ্যে মাত্র ৭টি কল টার্মিনেট বা গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। আন্তর্জাতিক ফোনকল নিয়ন্ত্রণের জন্য এই সাত প্রতিষ্ঠান নিজেরাই একটি কমন ইন্টারন্যাশনাল পয়েন্ট (সিআইপি) তৈরি করে।

এ–সংক্রান্ত চুক্তির পর কলরেট বাড়ানো হয় এবং বৈধ পথে বিদেশ থেকে ফোনকল আসা কমে অবৈধ ভিওআইপি কল বেড়ে যায়। এ নিয়ে ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আইওএফ কল টার্মিনেশন রেট বা হার দেড় সেন্ট থেকে বাড়িয়ে দুই সেন্ট নির্ধারণ করে। কল রেট বাড়ানো হলেও সরকার, মোবাইল অপারেটর ও ইন্টার এক্সচেঞ্জ অপারেটরদের (আইসিএক্স) মধ্যে দেড় সেন্ট দাম ধরেই রাজস্ব ভাগাভাগি হচ্ছে। ফলে টার্মিনেশন হারে বাড়তি মূল্যের সুফল পাচ্ছে শুধু আইজিডব্লিউ অপারেটররা।’

এ ছাড়া নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ও মানোন্নয়নে আইওএফের গড়া ‘মার্কেট ডেভেলপমেন্ট এক্সপেন্স (এমডিএস)’ নামের ফান্ডের টাকার প্রায় পুরোটাই নিয়েছে সালমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড।  

আইওএফ নিয়ে বিটিআরসির সিদ্ধান্ত

বিটিআরসির সর্বশেষ বৈঠকে কল আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে আইওএফ এবং আইজিডব্লিউ অপারেটরদের মধ্যকার অপারেশনাল চুক্তির অনুমোদন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে কমিশন একটি নির্দেশিকা জারি করবে।

বৈঠকে এই অপারটেরদের আইজিডব্লিউ হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করা, আন্ত–অপারেটর সংযোগ স্থাপন এবং কল আদান–প্রদানের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক কল পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুনভাবে কমন পয়েন্ট নির্ধারণ, নগদায়নযোগ্য ব্যাংক গ্যারান্টি গ্রহণ, একক এমএনপি সার্ভার ব্যবহার করে ডিপিং কার্যক্রম পরিচালনা, কলের সমতা বণ্টন এবং বিদেশি কল আদান–প্রদান ও মনিটরিং কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিটিআরসি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখনো কিছু জানায়নি। তবে আইজিডব্লিউ ও আইওএফের মধ্যে চুক্তির সংস্কার নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলছিল।আসিফ রব্বানী, আইওএফের সভাপতি  

আইওএফ সম্পর্কে বিটিআরসি বলেছে, অপারটেরদের মধ্যে আন্তর্জাতিক কল আদান–প্রদানের বাজারে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, কল টার্মিনেশন মূল্য নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হ্রাস ও অপারেটরদের রাজস্ব নিশ্চিত করা এবং অবৈধ পথে আন্তর্জাতিক কল আদান–প্রদান বন্ধে আইজিডব্লিউ ও আইওএফের মধ্যকার চুক্তিকে সরকার অনুমোদন দেয়। কিন্তু আইওএফ তার মূল উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। সরকার কলরেট কমালেও দেশে আন্তর্জাতিক কলের ভলিউম কমেছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, আইজিডব্লিউ অপারেটরদের বকেয়া থাকছে। এ ছাড়া আইওএফ কমিশনের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কমিশন অনুমোদিত চুক্তিকে অনুমোদনহীনভাবে সংশোধন করেছে। পাশাপাশি এমডিএস ফান্ডের নামে গৃহীত অর্থ ব্যয়ে অস্বচ্ছতা রয়েছে।  

উল্লেখ্য, আইজিডব্লিউ ও আইওএফের মধ্যকার ওই চুক্তি গত মার্চ মাসে শেষ হয়েছে।
আইওএফের সভাপতি আসিফ রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখনো তাঁদের কিছু জানায়নি। তবে আইজিডব্লিউ ও আইওএফের মধ্যে চুক্তির সংস্কার নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে তাঁদের চিঠি চালাচালি চলছিল।

চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আসিফ রব্বানী বলেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিয়ে অনেকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এ ফাঁকি যাতে না দিতে পারে, সে উদ্দেশ্যেই ওই চুক্তি হয়। চুক্তির পর বিটিআরসির কাছে কারও কোনো বকেয়া থাকেনি দাবি করে তিনি বলেন, চুক্তি বাতিল হলে আইজিডব্লিউগুলো শৃঙ্খলার বাইরে চলে যাবে।

বেক্সিমকোর অ্যাকাউন্টে ৬০০ কোটি টাকার বেশি

বিটিআরসির আইজিডব্লিউ লাইসেন্সধারীর তালিকায় বেক্সিমকো নামের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। কিন্তু আইজিডব্লিউ অপারেটরদের ফোরামের মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের টাকার অন্তত ৯৫ শতাংশ ঢুকেছে বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেডের অ্যাকাউন্টে।  

বিটিআরসি বলেছে, শুরু থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমডিএসের অ্যাকাউন্টে ৬৩১ কোটি ১৫ লাখ ৭৯ হাজার ২৭৬ টাকা জমা হয়। এর মধ্যে ৬২৫ কোটি ৮৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৫৬ টাকা খরচ হয়েছে এবং ৫ কোটি ৩২ লাখ ২৬ হাজার ৮২০ টাকা রয়েছে। যে ৬২৫ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে, তার অন্তত ৯৫ শতাংশ বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড নামের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে।

এ অর্থ একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয় করার বিষয়ে অস্বচ্ছতা রয়েছে উল্লেখ করে বিটিআরসি তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলটির নেতারা লাভজনক খাত হিসেবে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিতে শুরু করেন। লাইসেন্স নেওয়ার পরপর অনেকেই রাজস্ব ফাঁকি দিতে শুরু করেন। এমন ছয়টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান থেকে বিটিআরসির অন্তত হাজার কোটি টাকা পাওয়া রয়েছে।

এই বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও সাবেক সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আইওএফ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন।

আইওএফ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এমডিএসের নামে যে টাকা দিতে হতো, সেটি তাঁরা আইওএফের নামের অ্যাকাউন্টেই দিতেন। তবে সেখান থেকে কোন অ্যাকাউন্টে অর্থ যেত, সেটার খোঁজ রাখতেন না। তবে তাঁরা জানান, এমডিএসের টাকা শুরুতে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে কিছুটা ব্যবহার হয়েছিল।

যেভাবে গড়ে ওঠে বিতর্কিত আইওএফ সিন্ডিকেট

আন্তর্জাতিক কল ব্যবসা একচেটিয়া করার উদ্যোগ আইওএফ সম্পর্কে ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাইসেন্সের নীতিমালা অনুযায়ী আইজিডব্লিউগুলো একই লাইসেন্সের আওতায় থাকার কথা থাকলেও আইওএফের পরিকল্পনায় টিয়ার-১ ও টিয়ার-২ নামে দুটি অসম স্তরে ভাগ করা হয়। টিয়ার-১–এ ১৬টি ও টিয়ার-২-এ ৭টি অপারেটর রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। আইজিডব্লিউ ২৯টি অপারেটরের মধ্যে ২৩টি অপারেটরকে এ প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রস্তাব অনুসারে এ খাতের সব লেনদেন টিয়ার-২ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে। টিয়ার-১-এর অপারেটরগুলো বিদেশ থেকে কল আনবে, কিন্তু গ্রাহক পর্যন্ত কল নিয়ে যেতে পারবে না। টিয়ার-২-এর মাধ্যমেই কল নিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের সব অর্থ হস্তান্তর করতে হবে সাতটি অপারেটরের মাধ্যমেই। পরে তারাই বিটিআরসি, আইসিএক্স, এএনএসের মতো সংস্থাগুলোর কাছে রাজস্বের অংশ হস্তান্তর করবে।  

এই সাত অপারেটর হচ্ছে ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশনস, রুটস কমিউনিকেশনস, গ্লোবাল ভয়েস, মীর টেলিকম, বাংলা ট্র্যাক ও নভো টেলিকম। এর মধ্যে গ্লোবাল ভয়েসের মালিকানায় এ কে এম শামসুদ্দোহা থাকলেও এর সঙ্গে সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। এ ছাড়া বলা হয়, এ সাত প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব গুরুত্ব পেয়েছে।  

সে সময়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিটিআরসির লাইসেন্সিং নীতিমালা অনুসারে প্রতিটি আইজিডব্লিউ তাদের রাজস্বের ৪০ শতাংশ বিটিআরসি, ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ আইসিএক্স ও ২২ দশমিক ৫ শতাংশ এএনএসের কাছে পরিশোধে দায়বদ্ধ। কিন্তু আইওএফ–ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট আইজিডব্লিউর কাছে রাজস্ব সরাসরি না নিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিতে সম্মতি দেওয়া হয়। এর ফলে প্রতি মাসে বৈদেশিক কল আদান-প্রদানের মাধ্যমে আয় করা ৩০০ কোটি টাকারও বেশি ওই বিতর্কিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নেওয়ায় সম্মতি দেওয়া হয়।  

আরও পড়ুনবিটিআরসির পাওনা ৯২১ কোটি টাকা, উধাও আওয়ামী লীগ নেতাদের স্ত্রী-সন্তানদের প্রতিষ্ঠান১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আইওএফ উদ্যোগটি বাজারের জন্য ক্ষতিকর হবে উল্লেখ করে টেলিযোগাযোগ খাতের অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিল। সে সময়ে আইজিডব্লিউ খাতের উদ্যোক্তাদের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো এক আবেদনে বলা হয়, উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে ‘বিতর্কিত’ একটি গোষ্ঠী লাভবান হবে। এর মাধ্যমে সরকারি কর পরিশোধ না করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার আশঙ্কার কথাও তুলে ধরা হয়। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় টেলিযোগাযোগসচিবের কাছে ব্যাখ্যা চায়। পরে ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আবারও প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৬ ডিসেম্বর তা অনুমোদন করা হয়।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলটির নেতারা লাভজনক খাত হিসেবে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিতে শুরু করেন। লাইসেন্স নেওয়ার পরপর অনেকেই রাজস্ব ফাঁকি দিতে শুরু করেন। এমন ছয়টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান থেকে বিটিআরসির অন্তত হাজার কোটি টাকা পাওয়া রয়েছে।

আরও পড়ুনআইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে১৫ মার্চ ২০১৪আরও পড়ুনতিন আইজিডব্লিউর কল ব্লক, ৩৩৪ আইএসপি কলসেন্টার ও আইপি ফোনের লাইসেন্স বাতিল০৪ ডিসেম্বর ২০২৪.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ট আরস র স প রস ত ব ড স ম বর র অন ম দ সরক র র র জন য ইন ট র আওয় ম ফ নকল ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব‍্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব‍্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।

তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।

পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।

# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে

দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন

আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।

কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।

চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।

দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।

পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।

চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ