ভারতে বিতর্কিত ওয়াক্ফ আইন এবং রাষ্টের মদদে ইতিহাস বিকৃতি
Published: 15th, April 2025 GMT
ষোলো শতক থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল ভারতবর্ষ। বাবর, হুমায়ুন, আকবররা তাদের রাজ্যের সীমা যত বাড়িয়েছেন, তাতে একইভাবে হিন্দু-মুসলিমসহ সব সম্প্রদায়ের লোকদের জীবন সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা ও বইপত্রে মুসলিম শাসনকে বর্বরতা, অন্যায় ও হিংস্রতার সর্বোচ্চ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
শুধু ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলাদেশেও বিভিন্ন অসংগতি চোখে পড়ে। যেমন গোপাল ভাঁড় চরিত্রের কথা বলা যাক। কার্টুনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন শিশুরা ‘দেবতুল্য’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মহানুভবতা আর অত্যন্ত বুদ্ধিমান গোপালের উপস্থিত বুদ্ধি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। পাশাপাশি দেখানো হয় মুসলিম নবাব সিরাজউদ্দৌলার বর্বরতা আর কূটবুদ্ধির বাহার। বারবার এটা দেখানো হয়, ‘শয়তান’ নবাব কীভাবে অসহায় কৃষ্ণচন্দ্রকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বিপদে ফেলে কীভাবে এই বর্বর নবাবের রাতের ঘুম আরও আরামের হয় ইত্যাদি। এ ধরনের ইতিহাস গিলিয়ে মুসলিম শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে ধরা হয়। অথচ যে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যেভাবে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, সেই নবাবের সঙ্গেই অতি মহানুভব রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
২০২৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এক ফোনালাপে বলেন, ইংরেজ তথা রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র হাত না মেলালে ধ্বংস হয়ে যেত হিন্দু ধর্ম। মানে বিশ্বাসঘাতকতাকে বৈধতা দিলেন তিনি! (এবিপি আনন্দ, ২৭ মার্চ ২০২৪)
ভারত সরকার এমন ভাষ্য তৈরি করেছে যে, মুসলিম শাসকরা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিয়েছেন। হিন্দি সিনেমা ‘পানিপথ’-এ (অর্জুন কাপুর অভিনীত) আহমদ শাহ আবদালিকে নৃশংস দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দু শাসক সদাশিবরাও ভাউকে একজন অসহায় নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যিনি আসলে মুসলিমদের শয়তানির কাছে হেরে গেলেন! অথচ এই সদাশিব তথা মারাঠা বা বর্গীদের নৃশংসতার কথা আমরা সবাই জানি। মোগল শাসনের ওপর ভারতীয়দের এত রাগ, এত ক্ষোভ যে বাবরি মসজিদ ভেঙে নান্দনিক তাজমহলের দিকেও এখন তাদের চোখ পড়েছে। পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসচর্চার মধ্য দিয়ে ভারতজুড়ে মুসলিমবিদ্বেষ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে গবেষক অড্রি ট্রুসক বলেছেন, বর্তমান ভারতে মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের যে বিদ্বেষ বা নেতিবাচক ধারণা, তার বেশির ভাগই উপমহাদেশের সত্যিকারের ইতিহাসের পরিবর্তে শুধু ‘অনুমানভিত্তিক’ বয়ানের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। ষোলো থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত ভারতে মুসলিম শাসনকাল ছিল প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং অসাধারণ আন্তঃসাংস্কৃতিক শ্রদ্ধা ও সাংস্কৃতিক উর্বরতার সময়।
এই গবেষক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, মোগল শাসনামলে হিন্দু বা অন্য ধর্মানুসারীরা শুধু নিজেদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতেন তা নয়; মোগল সম্রাটদের দরবারেও ছিল তাদের নিয়মিত যাতায়াত। মোগলদের রাজদরবারে সংস্কৃত, জৈন ইত্যাদি সম্প্রদায় ও পণ্ডিতরা আসতেন। তারা ধর্মীয় ও দার্শনিক বিতর্কেও অংশ নিতেন। এমনকি মোগলদের আদালত বা বিচারালয়গুলো ভারতীয় বা হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হতে চাইত, সংস্কৃতে লেখা বিভিন্ন সাহিত্য বা ধর্মগ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনুবাদেও তারা বিপুল আগ্রহ দেখিয়েছেন। এমনকি মোগল শাসকদের দরবারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু ও সংস্কৃত গুরুরা।
অড্রি ট্রুসক তাঁর গবেষণায় এসব তথ্য তুলে ধরার আগে পাকিস্তান ও ভারতে প্রায় দুই বছর কাটিয়েছেন। বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি পড়া ও সেগুলোর অর্থ উদ্ধারের জন্য তিনি দুই ডজনেরও বেশি আর্কাইভে গিয়েছেন। তিনি মুসলিম কিংবা হিন্দুও নন। তাঁর গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত যে কেউ একপক্ষীয় বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
বিশ্বের বহু অঞ্চলে মুসলিম নিধন বা মুসলিম বা ইসলামবিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছে। ইসরায়েলের পাশাপাশি ভারতেও ইসলামবিদ্বেষ প্রকট। দেশটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে দিতে চায়। সিনেমা, অ্যানিমেশন, বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে মুসলিমবিদ্বেষ প্রচারণায় তারা অর্থলগ্নিও করছে। সম্প্রতি মুসলিমদের সম্পত্তি কবজা করতে বিতর্কিত ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের বিলেও অনুমোদন দিয়েছে তারা। এসব অপচেষ্টা মোকাবিলায় সর্বস্তরের নাগরিকদের একই কাতারে শামিল হতে হবে।
আশিকুল মাওলা আদর: সহ-সম্পাদক, জাগো নিউজ
ashiqulmawlaadar@gmail.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
২২ ক্যাডার নিয়ে চলতেন স্বেচ্ছাসেবক দলের জিতু
বগুড়ায় মেয়েকে উত্ত্যক্ত ও বাবাকে খুনে অভিযুক্ত জিতু ইসলাম দলীয় প্রভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কথায় কথায় যাকে-তাকে অহেতুক মারধর করতেন। চলতেন ২২ জনের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে। তারা সবাই নানা অপকর্মে জড়িত এবং একাধিক মামলার আসামি। তাঁর আয় চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা থেকে। গতকাল রোববার এলাকায় গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, জিতু ফুলবাড়ী কারিগরপাড়ার মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে। ২০০৩ সালে এলাকায় বালু ব্যবসা নিয়ে প্রতিপক্ষ রবিউল ইসলামকে খুন করেন। সেই মামলায় তাঁর ১৪ বছর সাজা হয়। সাজা খেটে তিন বছর আগে বের হন। এর পর এলাকায় গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। তাঁর বাহিনীতে যে ২২ জন সদস্য, তারা কেউ রাজনৈতিক দলের পদ-পদবিতে নেই। হত্যা মামলা ছাড়াও জিতুর বিরুদ্ধে একটি মাদক ও একটি ডাকাতির মামলা রয়েছে।
ফুলবাড়ীর এক মুদি দোকানি বলেন, জিতু মাঝেমধ্যে তাঁর দোকান থেকে বাকি নিতেন। দু’বছরে বাকির পরিমাণ প্রায় ৪৮ হাজার টাকা হয়। তখন একদিন টাকা চান। এ কারণে জিতু তাঁকে মারধর করে নাকে খত নেন।
বৃন্দাবন এলাকার আরেক ব্যবসায়ী বলেন, মাঝেমধ্যে জিতু তাঁর বাহিনী নিয়ে হাজির হতেন। মোটা অঙ্কের চাঁদা চাইতেন। চাঁদার কমপক্ষে অর্ধেক দিয়ে তবে নিস্তার পাওয়া যেত। এ ছাড়া ঈদে সেলামির নামে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো তাঁকে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান, তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা চান জিতু। না দেওয়ায় দোকানে ককটেল হামলা করেন। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আগস্টের পর জিতু বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়ে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। ছোট ভাই মিতুলও তাঁর বাহিনীর সদস্য।
জিতু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সহসাধারণ সম্পাদকের পদ পান। সন্ত্রাসী হয়ে দলের পদ পাওয়ায় এলাকায় তাঁকে নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পদ পেয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
এলাকার এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘জিতুর কারণে আমরা মুখ খুলতে পারি না। সে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে এলাকা অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি পেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তার নির্যাতনের শিকার অর্ধশতের কম হবে না। তার বখাটেপনার কারণে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হতো না।’
এক বছর আগে থেকে ফুলবাড়ির পাশেই শহরের শিববাটি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন জিতু। সেই এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক শাকিল হোসেন। শাকিলের মেয়ে স্থানীয় ভান্ডারী সিটি বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এক মাস আগে ৫২ বছর বয়সী জিতু বিয়ের প্রস্তাব দেন শাকিলের মেয়েকে। বিষয়টি শাকিল জেনে রাগ করেন। জিতুর ওপর চড়াও হন। কিছুতে রাজি না হলে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকেন জিতু। তাঁর মেয়েকেও উত্ত্যক্ত করতেন। এরই এক পর্যায়ে শনিবার বিকেলে শাকিলকে পিটিয়ে খুন করেন জিতু ও তাঁর বাহিনী।
এ হত্যার ঘটনায় জিতুকে এক নম্বর আসামি করে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে গতকাল রোববার বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা করেছেন শাকিলের স্ত্রী মালেকা খাতুন। পুলিশ শনিবার রাতেই জিতু ও তাঁর সহযোগী মতি এবং বিপ্লবকে আটক করে।
সন্ত্রাসীকে দলের পদ দেওয়ার বিষয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সরকার মুকুল বলেন, ‘আমি জানতাম না, সে দলের নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করছে। আমরা তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছি।’ শনিবার রাতে স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় সভাপতি এস এম জিলানী ও সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের সই করা বিবৃতিতে জিতু ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়। সেই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ জানানো হয়।
বগুড়া সদর থানার ওসি হাসান বাসির বলেন, ‘এ মামলার অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফুলবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক জোবায়ের খান জানান, গতকাল জিতুসহ তিন আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসান পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে হত্যার প্রতিবাদ ও দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম জেলা শাখা। গতকাল বিকেলে শহরের সাতমাথায় সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট দিলরুবা নূরী এতে সভাপতিত্ব করেন।