ভারতে বিতর্কিত ওয়াক্ফ আইন এবং রাষ্টের মদদে ইতিহাস বিকৃতি
Published: 15th, April 2025 GMT
ষোলো শতক থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল ভারতবর্ষ। বাবর, হুমায়ুন, আকবররা তাদের রাজ্যের সীমা যত বাড়িয়েছেন, তাতে একইভাবে হিন্দু-মুসলিমসহ সব সম্প্রদায়ের লোকদের জীবন সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা ও বইপত্রে মুসলিম শাসনকে বর্বরতা, অন্যায় ও হিংস্রতার সর্বোচ্চ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
শুধু ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলাদেশেও বিভিন্ন অসংগতি চোখে পড়ে। যেমন গোপাল ভাঁড় চরিত্রের কথা বলা যাক। কার্টুনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন শিশুরা ‘দেবতুল্য’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মহানুভবতা আর অত্যন্ত বুদ্ধিমান গোপালের উপস্থিত বুদ্ধি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। পাশাপাশি দেখানো হয় মুসলিম নবাব সিরাজউদ্দৌলার বর্বরতা আর কূটবুদ্ধির বাহার। বারবার এটা দেখানো হয়, ‘শয়তান’ নবাব কীভাবে অসহায় কৃষ্ণচন্দ্রকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বিপদে ফেলে কীভাবে এই বর্বর নবাবের রাতের ঘুম আরও আরামের হয় ইত্যাদি। এ ধরনের ইতিহাস গিলিয়ে মুসলিম শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে ধরা হয়। অথচ যে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যেভাবে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, সেই নবাবের সঙ্গেই অতি মহানুভব রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
২০২৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এক ফোনালাপে বলেন, ইংরেজ তথা রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র হাত না মেলালে ধ্বংস হয়ে যেত হিন্দু ধর্ম। মানে বিশ্বাসঘাতকতাকে বৈধতা দিলেন তিনি! (এবিপি আনন্দ, ২৭ মার্চ ২০২৪)
ভারত সরকার এমন ভাষ্য তৈরি করেছে যে, মুসলিম শাসকরা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিয়েছেন। হিন্দি সিনেমা ‘পানিপথ’-এ (অর্জুন কাপুর অভিনীত) আহমদ শাহ আবদালিকে নৃশংস দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দু শাসক সদাশিবরাও ভাউকে একজন অসহায় নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যিনি আসলে মুসলিমদের শয়তানির কাছে হেরে গেলেন! অথচ এই সদাশিব তথা মারাঠা বা বর্গীদের নৃশংসতার কথা আমরা সবাই জানি। মোগল শাসনের ওপর ভারতীয়দের এত রাগ, এত ক্ষোভ যে বাবরি মসজিদ ভেঙে নান্দনিক তাজমহলের দিকেও এখন তাদের চোখ পড়েছে। পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসচর্চার মধ্য দিয়ে ভারতজুড়ে মুসলিমবিদ্বেষ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে গবেষক অড্রি ট্রুসক বলেছেন, বর্তমান ভারতে মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের যে বিদ্বেষ বা নেতিবাচক ধারণা, তার বেশির ভাগই উপমহাদেশের সত্যিকারের ইতিহাসের পরিবর্তে শুধু ‘অনুমানভিত্তিক’ বয়ানের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। ষোলো থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত ভারতে মুসলিম শাসনকাল ছিল প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং অসাধারণ আন্তঃসাংস্কৃতিক শ্রদ্ধা ও সাংস্কৃতিক উর্বরতার সময়।
এই গবেষক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, মোগল শাসনামলে হিন্দু বা অন্য ধর্মানুসারীরা শুধু নিজেদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতেন তা নয়; মোগল সম্রাটদের দরবারেও ছিল তাদের নিয়মিত যাতায়াত। মোগলদের রাজদরবারে সংস্কৃত, জৈন ইত্যাদি সম্প্রদায় ও পণ্ডিতরা আসতেন। তারা ধর্মীয় ও দার্শনিক বিতর্কেও অংশ নিতেন। এমনকি মোগলদের আদালত বা বিচারালয়গুলো ভারতীয় বা হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হতে চাইত, সংস্কৃতে লেখা বিভিন্ন সাহিত্য বা ধর্মগ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনুবাদেও তারা বিপুল আগ্রহ দেখিয়েছেন। এমনকি মোগল শাসকদের দরবারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু ও সংস্কৃত গুরুরা।
অড্রি ট্রুসক তাঁর গবেষণায় এসব তথ্য তুলে ধরার আগে পাকিস্তান ও ভারতে প্রায় দুই বছর কাটিয়েছেন। বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি পড়া ও সেগুলোর অর্থ উদ্ধারের জন্য তিনি দুই ডজনেরও বেশি আর্কাইভে গিয়েছেন। তিনি মুসলিম কিংবা হিন্দুও নন। তাঁর গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত যে কেউ একপক্ষীয় বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
বিশ্বের বহু অঞ্চলে মুসলিম নিধন বা মুসলিম বা ইসলামবিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছে। ইসরায়েলের পাশাপাশি ভারতেও ইসলামবিদ্বেষ প্রকট। দেশটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে দিতে চায়। সিনেমা, অ্যানিমেশন, বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে মুসলিমবিদ্বেষ প্রচারণায় তারা অর্থলগ্নিও করছে। সম্প্রতি মুসলিমদের সম্পত্তি কবজা করতে বিতর্কিত ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের বিলেও অনুমোদন দিয়েছে তারা। এসব অপচেষ্টা মোকাবিলায় সর্বস্তরের নাগরিকদের একই কাতারে শামিল হতে হবে।
আশিকুল মাওলা আদর: সহ-সম্পাদক, জাগো নিউজ
ashiqulmawlaadar@gmail.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষা আন্দোলনের চেতনা বনাম রাষ্ট্রের নীরবতা
পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনের ওপর দাঁড়িয়ে ইতিহাস আমাদের প্রভূত জাতীয়তাবাদী শক্তি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুরোনো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ নতুন মোড়ক জন্ম দিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ, যা তাঁরা ১৯০৫-১৯১১ সাল পর্যন্ত গ্রহণ করেননি; কিন্তু ১৯৪৮ সালের পর সেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে গ্রাহ্য করা জরুরি ছিল।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠল পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক ‘ডমিনেন্ট হেজিমনি’র বিপরীতে নিপীড়িত জাতিসত্তার কণ্ঠস্বর। এই প্রভাব বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম দিলেও ভাষা আন্দোলন আমাদের পাঠ্যপুস্তকীয় ইতিহাসে শুধু ‘বায়ান্ন’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এটা রাষ্ট্রই সুচারুভাবে গড়ে তুলেছে। কেননা, এতে তার তথাকথিত উদারবাদী রাজনীতির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সহজ হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় প্রতিরোধের রাজনীতিকে।
রাষ্ট্রের এই রাজনীতির সবচেয়ে বড় বলি হয়েছে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন, মুখ্যত বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে এ রাষ্ট্রে, শিক্ষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তার সিকিভাগ বিদ্যায়তনিক মনোযোগও দেওয়া হয়নি। অথচ ভিন্ন আলাপ তুললে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন মূলত ভাষা আন্দোলনের যে প্রতিরোধ, সেটিরই একটি পরিবর্ধিত রূপ এবং প্রাথমিক পূর্ণতার জন্মদাতা।
আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই গৌরবগাথার বয়ান পাবেন মাত্র এক অনুচ্ছেদ। এই দ্বিচারিতার পেছনেও অন্য এক রাজনীতি আছে। সত্য এই যে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হয়ে বাংলাদেশ অর্জন পর্যন্ত; কিন্তু নতুন দেশে শিক্ষাব্যবস্থা যতটা সর্বজনীন ও বি–উপনিবেশিত করা উচিত ছিল, সেদিকে রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর যথাযথ আগ্রহ আজও নেই।
কেন হয়েছিল শিক্ষা আন্দোলনব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার পথ ধরেছিল পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রী শাসকগোষ্ঠী। ঔপনিবেশিক মনোজগৎ নিয়েই ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের সচিব এস এম শরীফের নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শে শিক্ষাকে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় শরীফ শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। মাত্র আট মাসে প্রস্তুত সেই প্রতিবেদন প্রত্যাঘাতের ভয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পূর্ববঙ্গ আবার ফুঁসে ওঠে। ভেঙে ফেলে আইয়ুব শাহির রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সময়ের কঠিন-কঠোর মার্শাল ল। কেন? এর গুরুত্বটা অনুধাবন করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনের সুপারিশে শরীফ কমিশন প্রথমত বলেছিল, উর্দু হবে পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা, ইংরেজি হবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক আর বাংলা বর্ণমালার বদলে চালু হবে রোমান হরফ (রোমান হরফে ইউরোপীয় বহু দেশ তাদের ভাষাকে লিখিতভাবে প্রকাশ করে)।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাকে পণ্য ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্র শিক্ষার দায়িত্ব নেবে না বলে কমিশন সুপারিশ করে। অর্থাৎ যাঁর টাকা আছে, শিক্ষার অধিকার তাঁরই, এটাই ছিল এই সুপারিশের মূলকথা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক (ফ্রি) না করার পরিপূর্ণ পাঁয়তারা ছিল এই সুপারিশে। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই পূর্ববঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। কমিশনের সুপারিশ তাতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠল। গ্রাম-অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে বরাবরই কৃষক ও শ্রমিকেরা ছিল সংখ্যাগুরু। ভাষা ও অর্থের মারণাস্ত্র প্রয়োগ করলে এই বিশাল মেহনতি শ্রমজীবী শ্রেণির সন্তানেরা শিক্ষিত হবে কীভাবে?
এই যে দুটি বিপদ, এগুলো নতুন নয়, পুরোনোই। ১৮৩৫ সালে দেওয়া ম্যাকওলে নীতিরই নতুন সংস্করণ। প্রথমে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়া; তারপর ইংরেজি না জানলে চাকরি না পাওয়ার আতঙ্ক ঢোকানো ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি। ঠিক একই খড়্গ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আবারও নেমে এল ১৯৬২ সালে।
শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরোধিতা ও মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিতে রাজপথে নামলেন। লম্বা সে লড়াইয়ের ইতিহাস। সে ইতিহাস গৌরবেরও, চাঞ্চল্যেরও। লম্বা সময় ধরে লড়াই করার পর ১৭ সেপ্টেম্বর হরতাল ডাকা হলো, যার মূল কুশীলব ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মোহাম্মদ ফরহাদ ও ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান।
সেই হরতালের মিছিলে গুলি চলল। শহীদ হলেন মোস্তফা, বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহ। টঙ্গীতে সুন্দর আলী। সেই থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘শিক্ষা দিবস’। কিন্তু সেটি নামে, মর্মে-কর্মে অতলান্ত বিস্মৃতির ছাপ।
ভাষার প্রশ্নটি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানেরও প্রশ্নশিক্ষার প্রশ্নটি যে ভাষার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তা শরীফ কমিশনের সুপারিশ থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু একে শুধু ১৯৫২ বা ১৯৬২ সালের ঘটনাবলি দিয়ে মোটেও বোঝা যাবে না। যেতে হবে ইতিহাস ও রাজনীতির আরও গভীরে।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আট বছরের সংগ্রাম তাতে আপাত সফল হয়; কিন্তু এই সাফল্যের চেয়েও বড় অর্জন আছে।
ভাষার প্রশ্নটিকে পূর্ববঙ্গের উদয়োন্মুখ (অ্যাসপায়েরিং) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত (শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীরা) যে আর্থসামাজিক বয়ান দিয়ে মোকাবিলা করেছিলেন, তার তুল্য বিচার হতে পারে ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে। সেই প্রতিরোধকে ঔপনিবেশিক বিদ্যায়তনিক ভাষায় ক্ষুদ্রার্থে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলা হলেও আদতে তা ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক উৎপাদন সম্পর্ক তথা সার্বিকভাবে উৎপাদন পদ্ধতিকে নাকচ করে পুরো ভারতবর্ষে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য প্রকট। ভাষার সঙ্গে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সম্পর্ককে সামনে আনা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল, তা মুসলিম লীগ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহই প্রথম নাকচ করে প্রতারণা করেন। সেই স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গের জমিনে সব আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে।
ভাষা হিসেবে বাংলাকে নাকচ করে দেওয়ার সঙ্গে এই স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করার সম্পর্ক আছে। পূর্ববঙ্গ স্বায়ত্তশাসন পেলে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই তার গঠন তৈরি হতো। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামো তার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইল উর্দু, যা পূর্ববঙ্গের আমজনতার কাছে ‘ভিনদেশি’ ভাষাই ছিল মুখ্যত। এমতাবস্থায় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসে গেছে।
শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) ও চাকরির পরীক্ষার ভাষা উর্দু হলে বাঙালি সেই ভার বহন করতে পারত না। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানিরা উর্দুকে শুধু একক রাষ্ট্র ভাষাই বানাতে চায়নি, পঞ্চাশের দশকে বাংলা লিখতে বলেছিল ফার্সি-আরবি প্রভাবিত নাস্তালিক হরফে, যে হরফে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষাগুলো লিখিত।
নৌবাহিনীর পরীক্ষা উর্দুতে নেওয়ার প্রতিবাদ এ জন্যই হয়েছিল। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমা উর্দুভাষী রেজিমেন্ট দ্বারা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার এই প্রবণতা খেয়াল করার মতো। মনে রাখতে হবে, এই প্রবণতা পঞ্চাশের দশকের শুরুর প্রবণতা, একাত্তরের গণহত্যা যার চূড়ান্ত পরিণতি। ভাষাকেন্দ্রিক লড়াই তাই শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে একটি প্রতারিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিকভাবে বিকাশের সম্পর্ক জড়িত। জড়িত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও।
আর অন্তরে ছিল এমন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা, যারা ১৮৫৭ সালের মতোই প্রথাগত উৎপাদন–সম্পর্ক ও উৎপাদনপদ্ধতিকে সমূলে উৎপাটন করে আপামর জনগোষ্ঠীর কথা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। যুক্ত হয়েছিল ভূমিব্যবস্থা বদলে ফেলতে চাওয়া বিখ্যাত তেভাগা আন্দোলনের লড়াইয়ের স্পিরিট, যার প্রভাবে ১৯৫০ সালের জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়।
১৯৫০ সালে রাজশাহীর জেলে সংঘটিত হয় কুখ্যাত ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড’, যেখানে রাজবন্দী বামপন্থী নেতা-কর্মীদের মধ্যে ৭ জন নিহত হন, আহত হন ৩০ জনের বেশি। ১৯৫৪ সালে আদমজী ও কর্ণফুলী কারখানায় বাঙালি শ্রমিকদের ওপর অবাঙালি মালিকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেওয়া দানবীয় হত্যাকাণ্ডে নিহত হন ৯০ জন, আহত হন ২৫০ জনের বেশি শ্রমিক। ভাষা আন্দোলন এসব নির্মমতার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধের অপর নাম।
সবিশেষে এই আন্দোলন এমন কিছু আর্থসামাজিক বিষয় সামনে এনেছিল, যা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মেহনতি মানুষের দুর্দশা লাঘবের বড় মঞ্চ হয়ে উঠেছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল উৎপাদন-সম্পর্ক বদলের। এ কারণেই এটি একটি আন্দোলন মাত্র ছিল না, ছিল অভিজাত ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে একেকটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ‘অনন্য অভ্যুত্থান’।
শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল হয় শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদানের শক্তিতেই। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; লড়াইটা তাই মূল ভাষা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন ছিল; কিন্তু এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন ছিল। নতুন রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির বিপক্ষে যেতে চায়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে শিক্ষা আন্দোলনের যে চেতনা তৈরি হয়েছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে।ভাষা ও ‘শিক্ষার মাধ্যম’ অঙ্গাঙ্গি ছিলনতুন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ প্রসঙ্গ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ভারত ভাগ হওয়ার আগপর্যন্ত বারবার এড়িয়ে গেছেন। পূর্ববঙ্গের নেতারাও সেটি অনুভব করেননি। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক পরিষদে শিক্ষার অধিকার প্রসঙ্গে যে ইশতেহার তুলে ধরেন, তাতে ভাষার প্রসঙ্গটি স্থান পায়নি। ছাত্র-যুবা ও বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু ঠিকই আলাপটা তুলেছিলেন। তবে সেটি শুধু রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গে নয়, এর সঙ্গে তাঁরা শিক্ষার মাধ্যম নিয়েও কথা বলেছেন।
১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে গণ আজাদী লীগ, ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—বাংলা না উর্দু শীর্ষক পুস্তিকায় তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে পূর্ববঙ্গের দাপ্তরিক ভাষা করার পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি তোলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগ তো অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষারও দাবি জানায়।
মোদ্দাকথা, শুধু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেই ভাষার অধিকার বাস্তবায়িত হয় না। এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত হয় মূলত শিক্ষায়, সরকারি দপ্তরে ও চাকরির পরীক্ষায়; কিন্তু ১৯৫৬ সালে সাংবিধানিক স্বীকৃতির তথাকথিত ভণিতা ছাড়া বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তানিদের মনোভাব কখনোই বদলায়নি। সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন শরীফ শিক্ষা কমিশন। এ জন্যই শিক্ষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের বয়ান ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি।
শিক্ষা ও আজকের বাংলাদেশশরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল হয় শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদানের শক্তিতেই। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; লড়াইটা তাই মূল ভাষা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন ছিল; কিন্তু এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন ছিল। নতুন রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির বিপক্ষে যেতে চায়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে শিক্ষা আন্দোলনের যে চেতনা তৈরি হয়েছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে।
যে কারণে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে বারবার শিক্ষার্থীদের নামতে হয়েছে। এরশাদের আমলে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়েছেন, যে দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস নামে স্বীকৃত হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করতে হয়েছে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে বর্ধিত ফি–বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
বিস্ময়কর বটে, বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো জানেনই না শিক্ষা দিবস কী ও কেন! ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে জানেন; কারণ, পাঠ্যপুস্তকে এগুলো স্বাভাবিক মহিমায় প্রকাশিত হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর নিয়ে সেটি করতে গেলে রাষ্ট্রকে সরাসরি শিক্ষা সংকোচন নীতি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে; কিন্তু রাষ্ট্র সেটি করবে না।
সেটি করলে রাষ্ট্রের তথাকথিত উদার অর্থনীতি ও ব্যক্তিমালিকানায় শিক্ষাকে সোপর্দ করার সব নকশা শিক্ষার্থী সমাজের কাছে উন্মোচিত হয়ে যাবে।
শিক্ষার্থীরা তখন প্রশ্ন করবেন, ‘এ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে আমি বৈষম্যের শিকার কেন হচ্ছি? কেন রাষ্ট্র দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হলেও, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতে দিলেও যেকোনো স্তরে আমার শিক্ষার ভার বহন করবে না?’
এসব প্রশ্নের উত্তর পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় চলতে চাওয়া রাষ্ট্রের কাছে নেই। শিক্ষা দিবসের দুর্দমনীয় চেতনা তাই শুধু কাগজের কালিতেই লেখা আছে; মর্মে নেই, কর্মে তো নেই-ই।
ড. সৌমিত জয়দ্বীপ, সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব