আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনীতির মাঠে মিত্র থেকে প্রতিযোগীতে পরিণত হওয়া বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বৈঠক কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে হঠাৎ জামায়াতের অবস্থান স্পষ্ট করা এ বৈঠকেরই ফল কিনা– এ আলোচনাও রয়েছে। 

গত রোববার লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা.

শফিকুর রহমানের বৈঠককে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলছে দুই দল। বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে– তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে জামায়াত সূত্র নিশ্চিত করেছে, এ বৈঠকে দূরত্ব কমলেও আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা নেই। 

দল দুটির সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে রাজনীতি, সংস্কার,  নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা নানা অপকর্মে যুক্ত– সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন প্রচারণার জন্য জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অভিযোগ করা হয়। যদিও জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বলা হয়, এগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত নয়। ২২ বছর বিএনপির সঙ্গে রাজনীতি করেছে জামায়াত। দলটি বিএনপির শত্রু নয়। 

১৯৯৯ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয় জামায়াত। একসঙ্গে সরকার পরিচালনা করা দল দুটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জোট ভাঙে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে যুগপৎ আন্দোলন করেছে তারা। শেখ হাসিনার পতন ঘটানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দুটি দলের নেতাকর্মীদেরই সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল। ৬ আগস্ট খালেদা জিয়া কারামুক্ত হওয়ার পর জামায়াত নেতারা তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। 

শেখ হাসিনার পলায়ন এবং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এক সময়ের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। দল দুটির নেতারা পরস্পরের কড়া সমালোচনা করছেন। জামায়াতকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যেই সমালোচনা করছেন। জামায়াত নেতারা বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মতো অপকর্মে লিপ্ত দল হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। 

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির প্রধান নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হতে জামায়াত ভোটের মাঠে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। নির্বাচন, সংস্কার, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণসহ প্রায় সব ইস্যুতে দল দুটির অবস্থান বিপরীতমুখী। আর্থিক খাত, পুলিশ-প্রশাসন, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে দলীয় আদর্শের ব্যক্তিদের পদায়নের লড়াই চলছে। শুধু কথার লড়াই আর বাহাস নয়, দল দুটির নেতাকর্মী বিভিন্ন স্থানে সংঘাতেও জড়িয়েছেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারাও জামায়াতকে ব্যাংক দখলকারী, মোনাফেক বলে আখ্যা দেন। এর প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াত নেতারা বিএনপি নেতাকর্মীকে চাঁদাবাজ, দখলদার আখ্যা দিচ্ছেন।  

এমন পরিস্থিতিতে গত রোববার খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। গত ৮ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান বিএনপির চেয়ারপারসন। 

গত ৪ এপ্রিল ইউরোপ সফরে যান শফিকুর রহমান। ১২ এপ্রিল যুক্তরাজ্য গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে পরের দিন দেশে ফেরেন। জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ সমকালকে বলেছেন, শুধুই সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে এ ধরনের সাক্ষাৎ সম্পর্ক সুদৃঢ় করে। 

রাজনীতি নিয়ে কথা হয়েছে কিনা– এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান। বিএনপির কোনো নেতাই এই বৈঠকের বিষয়ে নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

আজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপ সফরের বিষয়ে জানাবেন জামায়াত আমির। গতকাল বুধবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেননি। বিএনপি এবং জামায়াতের লন্ডনে অবস্থান করা সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমানের সঙ্গে দীর্ঘ সময় আলাপ হয়েছে শফিকুর রহমানের। গত দুই দিনে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলা একাধিক নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপিবিরোধী প্রচারণার বিষয়ে উষ্মা জানানো হয়েছে। জামায়াতের তরফে বলা হয়, ২২ বছর একসঙ্গে রাজনীতি করার পর বিরোধিতা কাম্য নয়। দুই পক্ষের প্রতিযোগিতা থাকলেও, দূরত্ব সৃষ্টি হলে তা ক্ষতিকর। 

বিএনপির দিক থেকে বলা হয়, জামায়াতবিরোধী প্রচারণা তারা শুরু করেননি। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব জামায়াতের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি। জামায়াতই বিএনপিবিরোধী জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারাই বলছে, আগামী দিনে আর জোট হবে না। বিএনপি এমন কিছুই বলেনি। 

বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সরব থাকলেও, জামায়াত এতদিন সংস্কারেই জোর দিয়েছে। তবে গতকাল জামায়াত আমির প্রথমবারের  মতো স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁর দল কবে নাগাদ নির্বাচন চায়। তিনি বলেছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হতে যাওয়া রমজানের আগেই নির্বাচন চায় জামায়াত। 

২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ বিচারের মুখোমুখি করেছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের। দল দুটির কয়েকশ নেতাকর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের শিকার হন। গ্রেপ্তার হন দুই দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী। মামলায় আসামি হয়েছেন কয়েক লাখ নেতাকর্মী। 

বিএনপির এক নেতা সমকালকে বলেছেন, দুই দলই আওয়ামী লীগ আমলে নির্যাতনের শিকার। কিন্তু জামায়াত ৫ আগস্টের পর বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টা করে যেসব অপপ্রচার চালিয়েছে তাতে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের বৈঠকের বিষয়টি দেশে থাকা বিএনপি নেতারা জানতেন না। বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে– তা এখনও পরিষ্কার নয়। শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা পাওয়ার পরই এ বিষয়ে কথা বলা যাবে; জানা যাবে, জামায়াতের বিষয়ে অবস্থানের বদল হয় কিনা। 

জামায়াতের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সমকালকে বলেছেন, কখনোই বিএনপিকে প্রকাশ্যে নাজেহাল করা হয়নি। বিএনপি সন্দেহ করে, সরকার এবং এনসিপির সঙ্গে মিলে জামায়াত নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছে– এ অমূলক ধারণা থেকেই সম্পর্কের অবনতি। বিএনপি সমালোচনা শুরু করায়, জামায়াতকেও মুখ খুলতে হয়েছে। লন্ডনের বৈঠকে কী আলাপ হয়েছে– তা জানার পরই বলা যাবে বিএনপির বিষয়ে জামায়াত আগামীতে কোন অবস্থানে থাকবে।  

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ত র ক রহম ন র ন ত কর ম দল দ ট র অবস থ ন ব এনপ র বল ছ ন র জন ত আওয় ম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

৫ আসামিকে বাদ দিতে হলফনামা, বাদী কৃষক দল নেতাকে শোকজ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় জুলাই আন্দোলনে হামলার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায় পাঁচ আসামির নাম বাদ দিতে আদালতে দুটি হলফনামা দিয়েছেন বাদী কৃষক দল নেতা শাহ আলম পাঠান। টাকার বিনিময়ে তিনি হলফনামা দিয়েছেন, এমন অভিযোগ ওঠার পর তাঁকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিয়েছে জেলা কৃষক দল।

শাহ আলম পাঠান নাসিরনগর উপজেলা কৃষক দলের সদস্যসচিব। ৪ জুন পাঁচজনের নাম মামলা থেকে বাদ দিতে আদালতে হলফনামা দেন শাহ আলম। সম্প্রতি বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা তৈরি হয়।

যে পাঁচজনকে বাদ দিতে হলফনামা দেওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন উপজেলার নূরপুর গ্রামের মো. মাসুদ, গোকর্ণ গ্রামের শেখ মো. জোবায়ের হাসান, বেনিপাড়ার মামুন মিয়া, টেকানগরের জসিম উদ্দিন কায়কোবাদ ও নূরপুর গ্রামের শামসুল আরেফিন মিঞা। তাঁরা যথাক্রমে মামলার ৯৭, ৭৯, ৯১, ১০৫ ও ৮৭ নম্বর আসামি। তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও কোনো পদ–পদবি ছিল না।

হলফনামা দেওয়ার বিষয়টি জানাজানির পর গত শুক্রবার রাতে জেলা কৃষক দলের দপ্তরে দায়িত্বে থাকা যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আল আমিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে শাহ আলমকে কারণ দর্শাতে বলা হয়। সাত দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক আবু শামীম মো. আরিফ ও সদস্যসচিব জিল্লুর রহমান এক যৌথ বিবৃতিতে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শাহ আলম পাঠানের বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা আগামী সাত দিনের মধ্যে জেলার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে সশরীর হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে নাসিরনগর উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনের সড়কে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে জড়ো হন। তখন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় শাহ আলম ১১৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৩০০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলার আবেদন করেন। আদালত আবেদনটি আমলে নিয়ে এজাহারটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করতে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। গত ২ নভেম্বর মামলাটি থানায় নথিভুক্ত হয়। ওই মামলার পাঁচ আসামিকে বাদ দিতে আদালতে হলফনামা দেওয়া হয়েছে।

একটি হলফনামায় বাদী উল্লেখ করেন, লিখিত এজাহারে মাসুদ, জোবায়ের, মামুন ও জসিম উদ্দিনের নাম আসামির শ্রেণিভুক্ত ছিল না। অসাবধানতার কারণে চারজনের নাম আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁদের চারজনকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, জানেন না। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, তাঁরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।

আরেকটি হলফনামায় বলা হয়, আসামি শামসুল আরেফিন মিয়া ২০১৪ সালে উপজেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি, সাবেক সদস্যসচিব ও ২০০৩ সালের উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য ছিলেন। অসাবধানতাবশত ভুলের জন্য তিনি (শাহ আলম) অনুতপ্ত এবং অনুশোচনা প্রকাশ করছেন।

তবে বিষয়টি জানাজানির পর সমালোচনামুখর হন বিএনপি ও ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা। তাঁরা বলেন, শাহ আলম ২০২০ সালে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য বি এম ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে কেক কেটে মুজিব বর্ষ পালন করেন। তাঁর বাবা মো. ইয়াছিন পাঠান উপজেলার চাতলপাড় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

নাসিরনগর সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক ইয়াছিন মাহমুদ ফেসবুক পোস্টে লেখেন, শাহ আলম মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে হলফনামা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় যাঁরা ছিলেন, এখন তাঁরাই আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে লিপ্ত।

তবে কৃষক দলের সদস্যসচিব শাহ আলম পাঠান বলেন, ‘পাঁচজনকে মামলায় ভুলবশত সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাই হলফনামা দিয়েছি। জেলা কৃষক দলের কাছে তথ্য গিয়েছে যে আমি টাকার বিনিময়ে এমন করেছি, যা মোটেও সত্য নয়। স্থানীয় বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’

নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মূল ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ