তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বৈপরীত্যের দোলাচল
Published: 17th, April 2025 GMT
জেনারেল এরশাদের পতনের পর দেশে প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সরকারের অধীনে দেশে প্রথমবারের মতো অবাধ ও কেন্দ্র দখলমুক্ত পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন জনমনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার জন্ম দেয়। সেই সঙ্গে জন্ম দেয় নতুন প্রত্যাশা– নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি আস্থা। কিন্তু ১৯৯০-৯১ সালের এই ব্যবস্থা সংবিধানে স্থায়ী রূপ না পাওয়ায় জনগণ আশাহত। পরিষ্কার হয়ে ওঠে– পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়; হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে।
শুরু হয় বৈপরীত্যের টানাপোড়েন। সরকারে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অনড় অবস্থান নেয় রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনের। অন্যদিকে বিরোধী আসনে থাকা পরস্পরবিরোধী দুই রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী সমান্তরালভাবে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে। আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হয়ে যায় একতরফা নির্বাচন। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও তাদের সমর্থনে আরও অনেক দল নির্বাচন বয়কট করে। বিএনপি ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুধু ফ্রিডম পার্টি একটি মাত্র আসন পায়। নির্বাচনের পর আন্দোলন আরও তীব্র হয়। মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং বিএনপি সেই সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়।
এখনও প্রশ্ন ওঠে, তখন কি বিএনপির দলীয় দর্শন ভুল ছিল? জবাব একটিই– না। পাঁচ বছরের জন্য একটি রাজনৈতিক দলের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিয়ে নির্বাচনের সময় তাকে অবিশ্বাস রাজনীতির প্রতিই এক ধরনের অবিশ্বাস। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের টগর বোষ্টমী আর নন্দ মিস্ত্রীর সংসারের মতো; জাতসচেতন টগর বোষ্টমী বলতে পারে, ‘বিশ বচ্ছর ঘর করছি বটে, কিন্তু একদিনের তরে হেঁশেলে ঢুকতে দিয়েচি?’ অর্থাৎ সংসার করলে জাত যায় না। জাত যায় শুধু সূত্রধর স্বামীকে হেঁশেলে ঢুকতে দিলে! সরকার ব্যবস্থায় পুরো পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রের সব দায়দায়িত্ব দেওয়া যায়, শুধু আস্থায় রাখা যায় না নির্বাচনকালে!
২০০১ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়েই সদ্য ক্ষমতা ছাড়া রাজনৈতিক দলকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। ক্ষমতা হারানো দল আওয়ামী লীগ অনুভব করে টগর বোষ্টমীর দর্শন– হেঁশেলে অন্য কাউকে ঢুকতে দিতে নেই। নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। শুরু হয় নবম জাতীয় সংসদের জন্য নিজেদের অনুকূল তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রস্তুতি। শেষে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড.
যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকার গঠন করে রাজনৈতিক দল। সরকারের আচরণ কেমন হবে-না হবে, তা ঠিক করার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর। কিন্তু গত সাড়ে ১৫ বছর একটি দলের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা দায়িত্ব নিয়েছেন রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের খেলার নিয়ম নির্ধারণ করে দিতে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন দেশে ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন থেকে বেড়ে হবে চার মাস। এই চার মাসে জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এখন যেহেতু সব রাজনৈতিক দলই রাজক্ষমতার বাইরে, তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব হয়তো সবারই মনঃপূত।
মজাদার বৈপরীত্য হচ্ছে, নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুপারিশ করে একই প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা না করতে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ‘বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক সরকারের প্রতিনিধি হওয়ায় তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে প্রচ্ছন্নভাবে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।… বিশেষত সরকারকে অসন্তুষ্ট করতে পারে, নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা দুরূহ হয়ে পড়ে।’ তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন কি ধরেই নিয়েছে, প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে ভিন্ন তরিকায় চলতে পারে? ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশন এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসন্তুষ্ট করতে পারে? যদি ভবিষ্যতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এ আশঙ্কাই থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে নির্বাচন আয়োজনের একমাত্র উপায় হতে পারে ‘গায়েবি সহায়তা’।
ভারতে ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র সঞ্জয় গান্ধী তাদের মৌরসি আসন রায়বেরিলি ও আমেথিতে পরাজিত হন। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হয়। ২০২১ সালে পশ্চিম বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস ভূমিধস বিজয় পেলেও তিনি নিজের রাজনৈতিক ভিত্তিভূমি নন্দীগ্রামে হেরে গেছেন। অথচ আমাদের নির্বাচনকালে অরাজনৈতিকদের হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করেও নির্বাচনের পরে সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থূল কারচুপি, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং– নানাবিধ বিশেষণ ব্যবহারে সময়ক্ষেপণ করি না। সিস্টেম নয়, ব্যক্তিই নিজেকে নিয়ে যায় স্বৈরাচারের ভূমিকায়। হিটলার, মুসোলিনি বারবার হয় না; কেউ কেউ হয়ে যায়। উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হতে পারেন।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশের পথ সৃজনের সুযোগ এসেছে। আমরা গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে। হয়তো একদিন দাবি উঠবে– তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস না; ছয় মাস অথবা এক বছর হোক। এখনই কোনো কোনো প্রান্তে শোনা যাচ্ছে ধ্রুপদি সংগীতের টুংটাং। গণতন্ত্রের প্রকৃত বিকাশ না হলে কোনো একদিন আরও জোর গলায় আওয়াজ উঠতে পারে– ‘তার চেয়ে আমাদের ফিরে দাও রাজবংশ, রাজকীয়/ অলীক বিশ্বাস’।
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণত ন ত র ক সরক র গঠন ক সরক র র র র মত ন র পর ক ষমত আওয় ম ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।
বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী
‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত
সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।
লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড
ঢাকা/লিপি