মার্কিন শুল্কের নিন্দা জানিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত চীন। মোংলা বন্দর প্রকল্প এবং চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ ত্বরান্বিত করতে চায় দেশটি। এর পাশাপাশি তিস্তা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতেও প্রস্তুত বেইজিং। রাজধানীতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি উদ্বোধনে তিনি এসব কথা জানান।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার চীন দূতাবাসে দেশটির সরকারের ২০২৫ সালের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। সূচনা বক্তব্য রাখেন ইয়াও ওয়েন। এতে আরও বক্তব্য রাখেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এশিয়া, জেইসি ও এফঅ্যান্ডএফ অনুবিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অনুবিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ নুরে আলম।

রাষ্ট্রদূত বলেন, চলতি বছর চীন ২৩টি দ্বিপক্ষীয় সেমিনার এবং ৩০টি বহুপক্ষীয় প্রশিক্ষণ ও সেমিনারের আয়োজন করবে। যেখানে ৫০০-এর বেশি বাংলাদেশি অংশ নেবেন। এতে স্মার্ট গভর্ন্যান্স ও তথ্যপ্রযুক্তি, নতুন জ্বালানি, অর্থ, পরিবহন, কৃষি, পর্যটন এবং শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আমরা নিশ্চিত, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি দেশের জাতীয় উন্নয়নে এবং দুই দেশের সহযোগিতার টেকসই অগ্রগতিতে অবদান রাখবে।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ আমাদের সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করে। গত মাসে প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া বার্ষিক সম্মেলন ২০২৫-এ যোগ দিয়েছিলেন। বেইজিং সফর করেছিলেন। সফরে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এটা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়নে নতুন পর্যায়। সেই সঙ্গে আমাদের সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে অভূতপূর্ব উচ্চতায় উন্নীত করে। ড. ইউনূসের সফর দুই দেশের মধ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতায় নতুন গতি সঞ্চার হয়। চীন বাংলাদেশের বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে সমাজে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ও বিশ্বের উন্নয়নের জন্য সংস্কার আরও গভীর করবে এবং উচ্চস্তরের সুযোগ সম্প্রসারণ করবে চীন।

ইয়াও ওয়েন বলেন, মোংলা বন্দর প্রকল্প এবং চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ ত্বরান্বিত করবে চীন। সেই সঙ্গে তিস্তা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত। চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে এবং ডিজিটাল অর্থনীতি, সবুজ অর্থনীতি, সামুদ্রিক অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং পানি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আরও সহযোগিতার সুযোগ খুঁজবে। চীনে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের জন্য চিকিৎসা সুবিধা সহজতর করবে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বৃত্তির সুযোগ সম্প্রসারণ করবে। পাশাপাশি চীনে ব্যবসা, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের বৃহত্তর সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করবে।

মার্কিন শুল্কারোপকে চীন সরকার তীব্র নিন্দা এবং দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের অভিন্ন উন্নয়ন অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার জন্য একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল আন্তর্জাতিক পরিবেশ প্রয়োজন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা ও বাণিজ্য ঘাটতির অজুহাতে চীন-বাংলাদেশসহ তার সব বাণিজ্য অংশীদারের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। এটি সব দেশের বৈধ অধিকারের তীব্র লঙ্ঘন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে। সেই সঙ্গে এ শুল্কারোপ নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল ও বিশ্ব অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করেছে।

রাষ্ট্রদূত বলেন, ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে, বাণিজ্য বা শুল্কযুদ্ধে কেউ বিজয়ী হয় না। সুরক্ষাবাদ ব্যবস্থা একটি অচলাবস্থা। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে বৃহত্তর উন্মুক্ততা এবং সুষম সুবিধার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির দিকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও বিশ্বের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত চীন, যাতে অভিন্ন উন্নয়নের স্বার্থে একটি ন্যায্য বিশ্ব গড়ে তোলা যায়।

এর আগে গত ২৮ মার্চ বেইজিং সফর করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তখন তিনি তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে (টিআরসিএমআরপি) অংশ নিতে চীনকে আমন্ত্রণ জানান। ওই সফরের যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, পানিপ্রবাহের পূর্বাভাস, বন্যা প্রতিরোধ ও দুর্যোগ হ্রাস, নদী খনন, পানি ব্যবস্থাপনা, পানিসম্পদ উন্নয়ন এবং এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রস ত ত ব যবস থ প রকল প সহয গ ত ক জ কর

এছাড়াও পড়ুন:

আজও আছে পরতে পরতে সৌন্দর্য

কারুকার্যখচিত বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে মনোহর সৌন্দর্য। মনোরম পরিবেশে ভবনের চারপাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী পরীর আবক্ষ মূর্তি। ছবির মতো সাজানো ‘পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি’ এখন কালের সাক্ষী।

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কলমাই নদীতীরে ১৫ একর জমিতে জমিদারবাড়িটি। ঢুকতেই চোখে পড়ে পুরোনো মন্দির। লোকমুখে প্রচলিত, শরতের দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে এখানে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা কারিগররা। কালের বিবর্তনে স্থানটি এখন নির্জন। নেই আগের গৌরব-আভিজাত্যের ছাপ, এমনকি প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততাও।

মন্দির ঘুরে দেখা যায়, এর কোথাও কোথাও ইট খসে পড়েছে। পুরোনো দিনের নকশা হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল, যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে।

দোতলা ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। যদিও সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি। এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তিরও দেখা মেলে। জমিদার আমলের টিনের চৌচালা ঘরে অস্থায়ীভাবে সরকারি তহশিল অফিস স্থানান্তর হলেও, সেটি এখন স্থায়িত্ব পেয়েছে।

লতাপতায় আচ্ছন্ন ভবনের একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেকাংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভবনটির পিলারের মাথায় এবং দেয়ালেও অসাধারণ নকশা মুগ্ধ করে।

দোতল আরেকটি মহল, যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্য সব ভবনের সঙ্গে এটির নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনটির বারান্দা ও পুরোনো কাঠের দরজা সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। ভবনটির মাথায় ময়ূরের সঙ্গে দুই পাশে দুই নারী মূর্তির দেখা মেলে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলে গাছগাছালির সবুজে ঘেরা পুরো জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বিমোহিত করতে বাধ্য। যদিও ভবনের ভিন্ন অংশ খসে পড়ছে, হারাচ্ছে রূপ-লাবণ্য।

জমিদারবাড়ির পেছনে রয়েছে দীঘি ও দুটি পরিত্যক্ত কূপ। এ ছাড়া জমিদারবাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে নাটমন্দির। জানা যায়, নাগরপুরের সঙ্গে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে আসেন ধনাঢ্য ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল। তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে জমি কিনে জমিদারি শুরু করেন।

রামকৃষ্ণ সাহার দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধাগোবিন্দ। রাধা নিঃসন্তান। তবে বৃন্দাবনের তিন ছেলে– ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি তিন ভাইয়ের তরফে বিভক্ত থাকলেও, জমিদাররা সবাই ছিলেন প্রজানন্দিত। বৃন্দাবনের মেজ ছেলে উপেন্দ্রকে কাকা রাধাগোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র কাকার জমিদারির পুরো সম্পত্তি লাভ করেন।

দৃষ্টিনন্দন পাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। ইতিহাসের সাক্ষী বাড়িটি সংস্কার না হওয়ায় একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে ইতিহাস। জমিদারবাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ