কীভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ, যা বললেন আনু মুহাম্মদ
Published: 26th, April 2025 GMT
আওয়ামী লীগের শাসনামলে কীভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল, সে বিষয়ে একটি ভাষ্য সামনে এনেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ফ্যাসিবাদী শাসনের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে—সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসা এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, ‘সত্যটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে যে ফ্যাসিবাদ হয়েছে, সেটা ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে হয়নি, ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে প্রতারণা করার কারণে হয়েছে।’
আনু মুহাম্মদের মতে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার সঙ্গে প্রতারণা করে, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে, ধর্মীয় নিপীড়নকে নানাভাবে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, মুক্তিযুদ্ধকে অপব্যবহার করে এবং জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাস: ভূমিকা ও সংস্কার প্রস্তাব’ শিরোনামে পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। এতে সভাপ্রধানের বক্তব্য দেন আনু মুহাম্মদ। সভায় জননিরাপত্তা, সংবিধান, শিক্ষা, দ্রব্যমূল্য, জ্বালানি, শ্রমিক, কৃষকের সংকটসহ ১৩টি বিষয়ে বক্তব্য দেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির অন্য সদস্যরা।
সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশের কঠোর সমালোচনা করে সভায় আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলে বহুত্ববাদ কী করে হয়? কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই হচ্ছে যে রাষ্ট্র সব ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে। কোনো ধর্মের ব্যাপারে পক্ষপাত থাকলে বহুত্ববাদ কী করে হবে?’
ধর্মনিরপেক্ষতা ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত্তি কায়েম করেছে—এ ধরনের বিপজ্জনক কথা কী করে সংবিধান সংস্কার কমিশন থেকে আসতে পারে, তা বুঝতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, সত্যটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে ফ্যাসিবাদ হয়েছে, সেটা ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে হয়নি, ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে প্রতারণা করার কারণে হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতারণা করে, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে, ধর্মীয় নিপীড়নকে নানাভাবে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, মুক্তিযুদ্ধকে অপব্যবহার করে এবং জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ।
সংবিধানের মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়া-সংক্রান্ত প্রস্তাবেরও সমালোচনা করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশন যেভাবে বলছে সমাজতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা, তারা তো নিশ্চয়ই জানে যে পুঁজিবাদের যেমন অনেক রকম মডেল আছে, সমাজতন্ত্রেরও বিভিন্ন ধরন আছে।.
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, উত্তরাধিকার প্রশ্ন কিংবা নারীর অধিকার প্রশ্ন এলেই বাংলাদেশের বৈষম্যবাদী রাজনীতি বা মতাদর্শ যারা ধারণ করে, ধর্মের নামে হোক, জাতির নামে হোক, তাদের মধ্যে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। কারণ, ধর্ম পালন করুক বা না করুক, নারী প্রশ্ন এলেই ধর্মের অজুহাত দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার সেটা নিয়ে একটা উন্মাদনা ও সহিংসতা তৈরি করার চেষ্টা চলে। কিছু লোক ধর্মের নাম করে হত্যার কথা বলছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই।
সংস্কার বিষয়ে সভায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের কিছু কিছু কাজ আছে, যেগুলো বর্তমান সরকারই করে ফেলতে পারে। কিন্তু সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে—এই অপ্রয়োজনীয় একটা বিতর্কের কথা শোনা যাচ্ছে। কিছু কিছু সংস্কার এই অন্তর্বর্তী সরকারই করতে পারে, আবার কিছু কিছু সংস্কার আছে যেগুলো করার জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারই যেগুলো করতে পারে, সেগুলো করতে বাধা কোথায়, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘সম্পর্কের’ বিষয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বসুন্ধরা গোষ্ঠীর সঙ্গে খাতির করে তো কোনো পরিবর্তন আসবে না। একদিকে পাইকারি মামলা হচ্ছে, বহু নিরপরাধ ও নিরীহ লোক হামলা-মামলায় আতঙ্কিত আর অন্যদিকে বসুন্ধরার মতো প্রভাবশালী লোকেরা আপনাদের সঙ্গে বৈঠক করে, তাদের নানা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে—এই বৈপরীত্য চলবে না। এগুলোর অবসান এবং পরিবর্তন আমাদের দাবি, করতে হবে।’
মূলত ‘দীর্ঘকালীন স্থায়ী সরকারের’ কথা বলতে গিয়ে আনু মুহাম্মদ বসুন্ধরা গ্রুপের প্রসঙ্গ টানেন। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি বা বহুজাতিক কোম্পানি—এই তিন গোষ্ঠীকে স্থায়ী সরকারের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরা যদি একই রকম ক্ষমতাবান থাকে, একই রকম সক্রিয় থাকে এবং একইভাবে তাদের নীতিমালায় যদি দেশ চলতে থাকে, তাহলে কোনো ধরনের পরিবর্তন হবে না।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, বিগত সরকারের সময় বোঝা যেত আদালতের রায় কী হবে। এখনো বোঝা যায় যে রায় কী হবে। তাহলে পরিবর্তনটা কী হলো? কে জামিন পাবে, কে খালাস পাবে, কে আটক থাকবে, কার জামিন হবে না, এগুলো তো পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাইরের জানা-অজানা বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীর প্রভাবে যদি আদালত চলে, তাহলে এই সরকার যে সংস্কার বা পরিবর্তন করতে আগ্রহী, তার প্রকাশটা কোথায়?
মডেল মেঘনা আলমের গ্রেপ্তারের ঘটনা প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক, এমনকি যুদ্ধাপরাধীও যদি হয়, তার ঘরবাড়ি, ঘরের জানালা, দরজা ভেঙে, কোনো রকম কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসবে, এটা কারও ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য নয়।’
মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এই চুক্তির ব্যাপারে তো মানুষের জানতে হবে। খালি সরকার, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী কিংবা যে প্রবাসী লোকজন এখন দেশের স্বার্থে বিদেশের আরাম-আয়েশ ছেড়ে বাংলাদেশে কাজ করতে এসেছেন, তাঁরা বললেই তো হবে না। আমাদের তো পরিষ্কার জানতে হবে যে আসলে ঘটনাটা কী হচ্ছে। আমাদের স্বার্থ আছে কি না, সেটা জানতে হবে।’
মার্কিন কোম্পানি থেকে এলএনজি আমদানির সমালোচনা করে আনু মুহাম্মদ বলেন, দরকার হচ্ছে এলএনজি আমদানির নীতিমালা থেকেই বের হয়ে আসা। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর কাজটা এই সরকারকে করতে হবে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় সক্ষমতা বাড়িয়ে আমাদের শতভাগ মালিকানায় গ্যাস সম্পদটা পুরোপুরি আমরা যাতে ব্যবহার করতে পারি, সেই উদ্যোগগুলো নিতে হবে। আট মাসে এটার ব্যাপারে কি কোনো উদ্যোগ নেওয়া যেত না? আট মাসে কি নীতিমালার মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনা যেত না?’
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি আয়োজিত এই সভায় সংবিধান ও বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ‘কৃষি ও কৃষকের সংকট’ নিয়ে বক্তব্য দেন লেখক-গবেষক মাহা মির্জা।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নিয়ে বক্তব্য দেন চিকিৎসক মো. হারুন-অর-রশিদ। শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা ও গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছায়েদুল হক। শিল্প ও শ্রমিকের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন শ্রমিকনেতা সত্যজিৎ বিশ্বাস। দ্রব্যমূল্য ও অর্থনীতি নিয়ে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতু। জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেন সাবেক ছাত্রনেতা বাকি বিল্লাহ। হরিজন জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন সীমা দত্ত। পাহাড় ও সমতলের জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হেমা চাকমা। নারী ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী বিষয়ে বক্তব্য দেন ফেরদৌস আরা রুমী। সভার সঞ্চালক ছিলেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সভাপতি দিলীপ রায়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ব যবহ র কর ক য় ম কর ছ সরক র র আম দ র ব যবস ধরন র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
দাদন ফাঁসে ‘দাসের’ জীবনে শ্রমিক
২০ বছর ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের চাতালে কাজ করেন ছোবহান মিয়া। এখন আছেন উপজেলার আলমনগরের ছিদ্দিক অটো রাইস মিলে। ওই চাতালে যোগ দেওয়ার সময় মালিকের কাছে দাদন হিসেবে টাকা নেন। এখন এই পরিমাণ দুই লাখ টাকার ওপর। এই টাকার জন্য স্ত্রী খায়রুন বেগমকেও (৩৫) খাটতে হয় ছোবহানের সঙ্গে।
ছিদ্দিক অটো রাইস মিলে ২০ বছর খেটেও দাদনের টাকা শোধ হয়নি ছোবহানের (৪৭)। আগে এখানেই কাজ করতেন তাঁর বাবা হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার শিবপুর গ্রামের আফসর মিয়া। তিনি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বছর দুয়েক আগে ছোবহানের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মা জাহানারা বেগমও। মা, তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিদ্দিক অটো রাইস মিলের পাশে গড়ে তোলা খুপরি ঘরেই থাকেন ছোবহান। মায়ের নামেও নেওয়া হয়েছে দাদন।
ছোবহানের মতো জীবনের গল্প আশুগঞ্জের দেড়শ চাতালে কর্মরত আট হাজারের বেশি শ্রমিকের। তাদের এক-তৃতীয়াংশই পুরুষ। যাদের নেই কোনো সরকারি-বেসরকারি মজুরি কাঠামো। প্রতি বাংলা বছরের শুরুতে তারা চাতাল মালিকের কাছে থেকে ‘দাদন’ নিয়ে কাজ করেন। তবে কাজ না করলে মজুরি মেলে না তাদের।
শ্রমিকরা জানান, প্রতি চাতালে গড়ে ৪০-৫০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক সপরিবারে কাজ করেন। পুরুষরা সপরিবারে কাজের কথা বলেই দাদন নেন। ধানের মাঠ বা বস্তা হিসেবে নির্ধারিত হয় তাদের মজুরি। সাধারণত একটি চাতালে ৬০০-৭০০ মণ ধান শুকানো যায়। মাঠ হিসেবে মজুরির জন্য শ্রমিকদের ভেজা ধান গাড়ি থেকে নামানো, সেদ্ধ করা, শুকানো, চাল তৈরির পর গাড়িতে উঠানো পর্যন্ত দায়িত্ব নিতে হয়। সাধারণত আবহাওয়া ভালো থাকলে এই কাজ সম্পন্ন হতে তিন-চার দিন লেগে যায়। বৃষ্টি থাকলে লেগে যায় ৮-১০ দিন পর্যন্ত। এ কাজ শেষ করা হলে পুরুষ শ্রমিকরা মজুরি হিসাবে ৩০০-৪০০ টাকা ও নারী শ্রমিকরা ৫০-৬০ টাকা পান। এ ছাড়া খোরাকি বাবদ সব শ্রমিককে প্রতি ১০০ মণ ধানে দেওয়া হয় ২৫ কেজি চাল।
বস্তা হিসেবে মজুরির জন্য সেদ্ধ চালের চাতালে প্রতি বস্তা ধান ও চালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রমিকরা পান ২৮ টাকা, আতপ চালের চাতালে মেলে ২২ টাকা। শ্রমিকরা জানান, কোনোভাবেই পুরুষ শ্রমিকের তিন-চার দিনের মজুরি ৩০০-৪০০ টাকার বেশি হয় না। দৈনিক গড় মজুরি সীমাবদ্ধ থাকে ১০০-১৫০ টাকায়।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চাল উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আশুগঞ্জের পরিচিতি রয়েছে। এক সময় এখানে চাতালের সংখ্যা ছিল চার শতাধিক। এসব চাতালে কাজ করতেন ২৫-৩০ হাজার শ্রমিক। ২০১৪-১৫ সালের দিকে এ উপজেলায় অটো ড্রায়ার কারখানা বাড়তে শুরু করে। এসব কারখানার দাপটে চাতাল কমতে কমতে টিকে আছে দেড়শর মতো।
ছিদ্দিক অটো রাইস মিলের অপর শ্রমিক কামালের (৩৮) জন্ম আশুগঞ্জেই। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার নূরপুরে। চাতাল মালিকের কাছে কামালের দাদন দুই লাখ টাকার বেশি। এখানেই খুপরিতে স্ত্রী জেসমিন ও পাঁচ নাবালক ছেলেকে নিয়ে থাকেন। জেসমিন তাঁর সঙ্গে চাতালে শ্রম দেন। দাদন কীভাবে শোধ করবেন– এমন প্রশ্নের উত্তর ভাগ্যের হাতে সঁপে দেন কামাল। চাতালকেই নিজের ঘরবাড়ির মতো ভাবেন। তাই ঋণ নিয়ে চিন্তাই করবেন না। কামাল বলেন, ‘যেখানেই যাই, কাজ করতেই হবে। আল্লাহর রহমত হলে ও চাতাল মালিকের দয়া হলেই সেই ঋণ কোনোদিন শোধ করা সম্ভব।’
মৌখিক চুক্তিতে নামমাত্র মজুরিতে এই শ্রমিকরা ‘স্বেচ্ছাবন্দি’ হিসেবে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন বছরের পর বছর। কবে এ দশা থেকে মুক্তি মিলবে– তা অজানা তাদের। শ্রমিকরা জানান, যে টাকা আয় হয়, এদিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তাই সঞ্চয় করে দাদন পরিশোধের কোনো টাকাই হাতে থাকে না। চালের উৎপাদন বন্ধ থাকলে মজুরিও পান না। কারও অসুখ-বিসুখ হলে যে টাকার দরকার, তার জন্যও হাত পাততে হয় চাতাল মালিকের কাছে। তখন ‘ভাংতি’ নেওয়া টাকা পরে দাদনের অঙ্কে যোগ হয়। এতে দিনে দিনে তাদের মাথায় বোঝা আরও বাড়তে থাকে। সেই ঋণ শোধ করাও হয় না, মজুরি বাড়ানোর দাবিও তুলতে পারেন না।
ফারুক ‘সর্দারের’ গল্প
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের মো. মন্নাস মিয়ার ছেলে ফারুক মিয়া (৪৮)। বাবার কোনো জমিজিরাত ছিল না। খুব শৈশবেই এলাকায় শ্রম বিক্রি শুরু করেন। আনুমানিক ১৭ বছর আগে সামসুন্নাহারকে বিয়ে করেন। কিছুদিনের মধ্যেই সংসারের অভাব বেড়ে যায়। এক ভায়রা ভাইয়ের পরামর্শে আশুগঞ্জের এক চাতালে কাজ শুরু করেন। শুরুতে দাদন নেননি। পরে সংসারের প্রয়োজনে প্রথম দফায় ১০ হাজার টাকা নেন। দাদন বাড়তে বাড়তে এখন তাঁর মাথায় তিন লাখ টাকার বোঝা।
আলমনগরের ছিদ্দিক অটো রাইস মিলে ফারুক এখন কর্মরত সর্দার হিসেবে। বিয়ের কয়েক বছর পর স্ত্রীকেও নিয়ে আসেন। তিনিও একই চাতালের কর্মী। ছোট দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ১৬ ফুট দীর্ঘ ও ১০-১২ ফুট চওড়া খুপরিতে থাকেন ফারুক। বড় দুই ছেলে থাকে একই আকারের অন্য কক্ষে। একই চাতালের কর্মী আরও ১৫টি পরিবার একই চাতালের খুপরিতে থাকে। তাদের ব্যবহারের জন্য শৌচাগারের সংখ্যা মাত্র দুটি। খাবার পানির জন্য আছে দুটি নলকূপ। এই খুপরিতে সংযুক্ত বিদ্যুৎ বিল বহন করেন চাতাল মালিক।
১৫ বছরের মতো এই চাতালে কর্মরত ফারুকের ভাষ্য, দাদন বাড়ার জন্য নিজের সাংসারিক প্রয়োজনের পাশাপাশি দায় রয়েছে পালিয়ে যাওয়া কিছু শ্রমিকেরও। এসব শ্রমিকের দাদনের অঙ্কও তাঁর হিসাবে যোগ হয়েছে।
সর্দারের ওপর কেন পালিয়ে যাওয়া শ্রমিকের দাদন চেপে বসে, সে বিষয়ে কথা হয় ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিন মোল্লার সঙ্গে। তিনি আগে চাতাল পরিচালনা করতেন। এখন যৌথভাবে পরিচালনা করছেন এগ্রো ফুড নামের ড্রায়ার মিল। মহিউদ্দিন মোল্লা বলেন, চাতালের মালিকরা নিজের প্রয়োজনেই শ্রমিক খোঁজেন। তখন সর্দারের মাধ্যমে কাজে আসেন পুরুষরা। তাদের পরিবারে ৩ থেকে ৪ বা ৪ থেকে ৫ জন সদস্য থাকেন। চুক্তি অনুযায়ী, দাদনের টাকা দেওয়া হয় সর্দারের মাধ্যমে। আগে কোনো লিখিত চুক্তিপত্র হতো না। এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে তা দেখভাল করেন সর্দার। কোনো শ্রমিক পালিয়ে গেলে, দায়ভারও তাঁর ওপর বর্তায়।
জানা গেছে, দাদনের অঙ্কটি সীমাবদ্ধ থাকে মালিক ও সর্দারের মধ্যেই। শ্রমিকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি না হলেও সর্দারের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তি হয়। কোনো শ্রমিক হাতবদল বা কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করলে যে চাতাল মালিক তাঁকে নেবেন, তিনি ওই শ্রমিকের টাকা দিয়ে দেন। অনেক ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেশি টাকা নেন শ্রমিকরা। এ ঝুঁকির জন্য সর্দাররা দাদনের টাকা থেকেও কমিশন নেন।
চাতাল মিল শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আব্বাস সরদার, সভাপতি মো. হরমুজ আলী ও সাধারণ সম্পাদক মো. আল আমিনের কথায় শ্রমিকের অসহায়ত্বের কারণ উঠে আসে। তারা বলেন, অধিকাংশ শ্রমিকের পায়ের নিচে মাটি নেই। অথচ গড়ে প্রতি শ্রমিকের মাথার ওপর দেড়-দুই লাখ টাকা দাদন। মজুরি যে তারা পান, তা দিয়ে সংসারই চলে না। তাই দাদন পরিশোধ করতে পারেন না। এটি দুই পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর।
আশুগঞ্জ উপজেলা চাতাল মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হেলাল সিকদারও বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, দাদন মালিকের জন্যও বোঝা। প্রতি মালিককে দাদনের জন্য বাড়তি বিনিয়োগ করতে হয় ২৫-৩০ লাখ টাকা। এ জন্য ব্যাংকে যেমন সুদ গুনতে হয়, তেমনি শ্রমিক পালিয়ে গেলেও ক্ষতির মুখেও পড়তে হয়। দাদন না নিলে শ্রমিকের মজুরি কিছুটা হলেও বাড়ানো সম্ভব।
আশুগঞ্জ সরকারি শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের জনসংখ্যা পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. নাঈম আহমেদের ভাষ্য, চাতাল শ্রমিকরা চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণের জন্য এখানে আসেন। কিন্তু কখনও তারা ঋণ নিয়ে কথা বলেননি।