Samakal:
2025-04-30@22:00:20 GMT

কৃষক-শ্রমিকের কণ্ঠস্বর

Published: 26th, April 2025 GMT

কৃষক-শ্রমিকের কণ্ঠস্বর

আজ ২৭ এপ্রিল শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬২ সালের এই দিনে তিনি মারা যান। আমরা শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করি। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অকুতোভয় কণ্ঠস্বর। তাঁর জীবন ও কর্ম আজও আমাদের পথ দেখায়, বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন শোষণ-বঞ্চনায় মানুষ ভয়াবহরূপে বিপর্যস্ত হচ্ছে। 

তাঁর পুরো নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর, বরিশালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করে তিনি আইন পেশায় যুক্ত হন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল বৃহত্তর। তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি মুসলিম জনসাধারণের অধিকার আদায়ে এক বিশিষ্ট নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৪০ সালে তাঁর প্রস্তাবিত লাহোর প্রস্তাব পরে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হয়। তবে শেরেবাংলা ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি বরাবরই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘রাজনীতি হবে জনকল্যাণের জন্য, ধর্মের জন্য নয়।’

তাঁর জীবনের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় হলো বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। ১৯৩৭ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা উপমহাদেশের ইতিহাসে অনন্য। জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। তিনি কৃষকদের জমির অধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করেন, ঋণের দায়ে কৃষকদের শোষণের অবসান ঘটান। তাঁর উদ্যোগেই কৃষি ঋণ বোর্ড ও প্রজাস্বত্ব আইন চালু হয়।

তাঁর আমলে শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত মজুরি, শ্রমঘণ্টা ও সুরক্ষার বিষয়গুলো আলোচনায় আসে। তাঁর এই শ্রমজীবী ও কৃষকবান্ধব চিন্তাধারার ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৫০ সালে গঠন করেন কৃষক শ্রমিক পার্টি। এই দল ছিল শোষিত ও প্রান্তিক মানুষের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ধনীর নয়, গরিবের স্বর ছিল মুখ্য।
কৃষক শ্রমিক পার্টি ছিল সেই সময়ের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি তাজা হাওয়া। ফজলুল হকের নেতৃত্বে এ দল মানুষের মৌলিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত গণতন্ত্র তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন কৃষক ও শ্রমিক এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ– রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে।
আজ শেরেবাংলার মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের দিকে তাকাই, তখন তাঁর সেই কথাগুলো আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলি, অথচ কৃষক এখনও ফসলের ন্যায্য দাম পান না, শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন, ন্যূনতম শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এই বাস্তবতায় শেরেবাংলার আদর্শ ও কৃষক 
শ্রমিক পার্টির দর্শন আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

এ.

কে. ফজলুল হক ছিলেন গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আপসহীনতা এবং জনমানুষের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘জনগণই রাজনীতির উৎস ও শক্তি।’ তাঁর রেখে যাওয়া রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হলো একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে বৈষম্য থাকবে না, থাকবে না শোষণ।
তাঁর মৃত্যু ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল। সেদিন শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নয়, হারিয়ে গিয়েছিলেন একটি যুগের প্রতীক। তবে তাঁর আদর্শ আজও বেঁচে আছে সেই সব মানুষের মাঝে, যারা সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা চায়, যারা কৃষক-শ্রমিকের কণ্ঠস্বর হতে চায়। আমরা চাই, নতুন প্রজন্ম শেরেবাংলার কর্ম ও জীবন থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করুক। কৃষক শ্রমিক পার্টির আদর্শকে সামনে রেখে গঠিত হোক এমন এক রাজনীতি, যা শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, বরং মানুষের অধিকার ও মর্যাদার জন্য কাজ করে। তাহলেই তাঁর প্রতি হবে প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লড়াই।

mdyamin.khan1983@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স মরণ র র জন ত ক র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম অধিকার ও সুস্থ কর্মপরিবেশ

আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী মেহনতি মানুষদের স্মরণ করিবার দিন। তৎসহিত সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য মর্যাদাকর জীবন নিশ্চিতকরণের সংগ্রামে নূতন শপথ গ্রহণের দিন।

মে দিবস বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যদ্রূপ বৃদ্ধি করিয়াছে, তদ্রূপ তাহাদিগকে অধিকার সচেতনও করিয়াছে; প্রেরণা জোগাইয়া চলিয়াছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে। মে দিবস বাংলাদেশসহ বিশ্বের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়া স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশসমূহের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎসরূপে কাজ করিয়াছে।

তাহারই প্রতিফলনস্বরূপ এই সকল দেশে ছুটিসহকারে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। উন্নত দেশসমূহ এই দিবসে পৃথক ছুটির ব্যবস্থা না করিলেও উহার প্রভাব উপেক্ষা করিতে পারে নাই। তাই ভিন্ন প্রকারে সেই সকল দেশেও দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে আজিকে শ্রমমান লইয়া যে আলোচনা হয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমিকের বহু অধিকার আজিকে যে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বহু দেশে কার্যকর হইয়াছে, উহারও পশ্চাতে রহিয়াছে মে দিবসের চেতনা। তবে ইহা সত্য, বাংলাদেশে ঘটা করিয়া দিবসটি পালিত হইলেও মজুরি ও কর্মপরিবেশ প্রশ্নে খামতি সীমাহীন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে শ্রমিকদের জন্য এক প্রকার আইনি আশ্রয় থাকিলেও বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উহার লেশমাত্র নাই। শেষোক্ত খাতে কোটি কোটি শ্রমিক উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অধিকার হইতে বঞ্চিত। 

এই বৎসর শ্রমিক দিবস এমন সময়ে উপস্থিত, যখন গণঅভ্যুত্থানের ফসলস্বরূপ দেশে নূতন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। সেই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে শ্রম খাতের সংস্কারেও উদ্যোগী। তাহাদের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও দাখিল করিয়াছে, যথায় দেশের সাড়ে সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত একগুচ্ছ সুপারিশ রহিয়াছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সকল শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ডরূপে বিবেচিত হইবে– কমিশনের এই সুপারিশ যুগান্তকারী বলিয়া আমরা মনে করি। উপরন্তু কমিশন ইহাও বলিয়াছে, কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসাবে বিবেচনায় লইয়া এমন পরিমাণ নির্ধারণ করিতে হইবে, যাহাতে শ্রমিক তাঁহার পরিবারের প্রয়োজন মিটাইতে পারেন।

বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বৎসর অন্তর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করিবার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস এবং স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত সুপারিশসমূহও প্রণিধানযোগ্য। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক আন্দোলন বলিতে কারখানা ভাঙচুর ও সম্পদ ধ্বংস বোঝাইত। পরিণামে নিজের রুটি-রুজি লইয়া শ্রমিকদেরই টানাপোড়েনে পড়িতে হইত। ইহার সমাধান দিয়াছিল ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা। দুর্ভাগ্যবশত এই দেশে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিগত দশকসমূহে ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করে। উহার সহিত সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলনও বিরল হইয়া পড়ে।

আমাদের বিশ্বাস, শ্রম সংস্কার কমিশনের ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ আলোর মুখ দেখিলে শ্রমিক-মালিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হইবে। সর্বোপরি দেশের বিকাশমান শিল্প খাত হইবে লাভবান। উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিরূপে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে উদ্যোক্তার যদ্রূপ অবদান, তদ্রূপ শ্রমিকেরও অবদান ব্যাপক। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে আর কোনো অবহেলা নহে। এইবারের মে দিবসে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করিবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা সমকালের পক্ষ হইতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের অভিনন্দন জানাই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ