জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী কৌশল
Published: 4th, May 2025 GMT
গত ৪৫ বছরে চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশের অবস্থানে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে দেশের রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ বিলিয়ন ডলারে, যার ৮৪ শতাংশ আসছে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। মানে তৈরি পোশাক শিল্প রফতানি আয়ের প্রায় ৪ হাজার ৬৬৭ কোটি ডলার দেশে নিয়ে আসছে। এর মধ্যে নিটওয়্যার রফতানি থেকে আসছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার এবং ওভেন গার্মেন্টস রফতানি থেকে আয় হচ্ছে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার। কিন্তু ওভেন গার্মেন্টস খাতে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন এখনো ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি না হওয়ায় রফতানি আয়ের ৬৫-৭০ শতাংশ, মানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে বিদেশে চলে যায়। অন্যদিকে নিটওয়্যার খাতে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন প্রায় ৬৫ শতাংশে পৌঁছে যাওয়ায় এ খাতের আয়ের প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার দেশেই থেকে যায়। অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বাদ দিলে নিটওয়্যার ও ওভেন গার্মেন্টস রফতানি থেকে বাংলাদেশের প্রকৃত আয় ২২-২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। অপরদিকে মেরিটাইম সেক্টর অপার সম্ভাবনার এক বিরাট ক্ষেত্র।বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে দেশে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে সমুদ্র অর্থনীতি। এর অপার সম্ভাবনার হাতছানি অতিশয় দৃশ্যমান। জাহাজ শিল্পের অর্থনীতিকে যদি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া যায় তা হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধিত হবে।
জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উন্নয়নে যুগোপযোগী নীতিমালা
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ রয়াল নেভীর জন্য জাহাজ তৈরি হতো এই বাংলায়। আর আজ সেই জাহাজ নির্মাণ শিল্পের করুন দশা। বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে জাহাজ নির্মাণশিল্পে চীন,জাপান, কোরিয়া সবার শীর্ষে আছে।সঠিক যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করে বাংলাদেশও জাহাজ নির্মাণশিল্পে চীনের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। জাহাজ নির্মাণশিল্পে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি চীন, কোরিয়া এবং জাপানের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু দক্ষতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের শ্রমিকরা অনেক এগিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের নির্মিত জাহাজ নির্মাণ ব্যয় সর্ববৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী দেশ চীনের তুলনায় ১৫% কম। আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ নির্মাণশিল্পে ২০০ বিলিয়ন ডলারের শতকরা দুই ভাগ অর্ডার পেলে বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণশিল্পে অনেক এগিয়ে যাবে। জাহাজ নির্মাণশিল্পে প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন হয়। যা এ দেশের শিপইয়ার্ড মালিকদের কাছে নেই। মূলধন সমস্যা সমাধান করতে পারলেই শিপইয়ার্ডগুলো লাভের মুখ দেখতে পারবে। জাহাজ রপ্তানিতে বাংলাদেশের শিপইয়ার্ডগুলো মাত্র শতকরা ৫ ভাগ ইনসেনটিভ পায়। ভারতে পায় শতকরা ২৫ ভাগ। আমাদের দেশে ইনসেনটিভ ৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগ উন্নতি করার দাবি জানাচ্ছি। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মালিকদের জন্য নামমাত্র সুদে ঋণ দেওয়ার দাবি করছি। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সুবিশাল সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় এখানে জাহাজ নির্মাণের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে অনেক জায়গা আছে। এ রকম একটি অনুকূল পরিবেশে বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ব্যাপক বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।
মাদার ভ্যাসেল মেরামতের ড্রাই ডক নির্মাণ
সমুদ্র ঘেঁষা বাংলাদেশে ড্রাই ডক হতে পারে একটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল, যার মাধ্যমে জাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের একটি খাত উন্মোচিত হবে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরো সম্প্রসারিত হবে শিল্পের বিকাশ। শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আমাদের দেশে জাহাজ জাহাজ ড্রাই ডক শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বা বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটা ড্রাই ডক নির্মাণ করে বছরে ৩/৪ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব এবং প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে ১ লক্ষ দক্ষ অদক্ষ বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
বাংলাদেশ নেভীর তত্ত্বাবধানে একটা ড্রাইডক রয়েছে যার ২০ হাজার ডেড ওয়েটের বেশি ক্যাপাসিটির জাহাজ মেরামত করতে পারে না। বাংলাদেশের বড় বড় যে শতাধিক বাণিজ্যিক জাহাজ রয়েছে তা ড্রাইডকিং এর জন্য দুই বছর পর পর চায়না যেতে হয়। যাতে বাংলাদেশের প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশ চলে যাচ্ছে। ২০০ থেকে ২৫০ মিটারের লম্বা এবং ৪০ মিটারের প্রসস্থ জাহাজ ড্রাইডকিং করার মতো ৫/৬ টি ইয়ার্ড কুতুবদিয়া, মহেশখালী উপকূলে বিদেশি বিনিয়োগে নির্মাণ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের পক্ষে ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।
জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের যুগোপযোগী কর্মপদ্ধতি তৈরি করা
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, বিশ্বের জাহাজ নির্মাণ বাজারের মোট পরিমাণ ১৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদি বাংলাদেশ মাত্র ১% অর্জন করতেও সক্ষম হয় তবে তা হবে ১৬ বিলিয়ন ডলার এবং যদি বিশ্বের ছোট জাহাজ নির্মাণ বাজারের শতকরা এক ভাগও নিজেদের দখলে নিতে পারে, তবে তার পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে এবং দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। দেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দক্ষ, আধাদক্ষ মিলিয়ে ৩০ লক্ষাধিক কর্মী নিয়োজিত করা সম্ভব। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ জাহাজভাঙ্গা শিল্পে প্রথমস্থানে ছিল এবং এই শিল্প থেকে বছরে ১২শ' থেকে ১৫শ' কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে সেখানে বাংলাদেশের নাম কোনো অবস্থানের মধ্যেই নেই। বিগত সরকারের কান্ডজ্ঞানহীন পরিকল্পনার কারণে অধিকাংশ শিপইয়ার্ড আজ বন্ধ হয়ে গেছে। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে একটি গ্রিন শিপইয়ার্ড করতে সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। সরকারিভাবে স্বল্প সুদে দীর্ঘমিয়াদি ঋণ সুবিধা দিলে অথবা বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা গেলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবে এবং এই শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলোতে নাবিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি
দেশের গত চার দশকের অর্থনৈতিক গতিশীলতার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দেওয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের ফরমাল-ইনফরমাল চ্যানেলে মোট রেমিট্যান্স ও দেশে নিয়ে আসা বৈদেশিক মুদ্রার যোগফল ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি যারা মধ্যে ৮ হাজার মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার এবং নাবিকদের অবদান দেড় বিলিয়ন ডলার । সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতায় সঠিক মেরিটাইম কৌশল নিলে মেরিন সেক্টর থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব যা অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে।বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে বাংলাদেশের নাবিকদের কাজের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ কতটুকু করছে তা নিয়ে সংশয় আছে! দুবাইসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা সমস্যার সমাধান হলেও কয়েকশো নাবিকের এই মুহুর্তে কর্মসংস্থান ব্যবস্থা হতো।
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বছরে সাত-আট লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এর মানে, বিদেশে কর্মসংস্থান বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘সেফটি বাল্ব’ হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। ১০ কোটি জনসংখ্যার ফিলিপাইনে নাবিক প্রায় ৮ লাখ এবং সে দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে নাবিক সবমিলিয়ে মাত্র ২০ হাজারের মতো এবং অর্থনীতিতে আমাদের অবদান মাত্র দেড় মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য যথাযথ ট্রেনিং দিয়ে বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলোতে যদি ১ লাখ বেকারের কাজের সুযোগও সৃষ্টি করা হয় তবে দেশের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে যাবে। এজন্য বাংলাদেশের নাবিকদের জন্য বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে কার্যকর পরিকল্পনা প্রনয়ণ করতে হবে।
বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি
৪৩ হাজার জনগোষ্ঠীর পানামার পতাকাবাহী জাহাজ সংখ্যা ৮০৬৫টি। আর ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের জাহাজ মাত্র ১০১টি। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর এক পর্যায়ে সংস্থাটির বহরে ৩৯টি জাহাজ-ট্যাংকার যুক্ত থাকলেও এখন মাত্র ৭টি জাহাজ। বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং প্রাইভেট কোম্পানির জাহাজ সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচশতে উন্নতিকরণ এবং ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, দুবাই, পানামার মত বিশ্বব্যাপি খ্যাতিসম্পন্ন জাহাজ কোম্পানীর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার মত সক্ষমতা অর্জন করা করতে হবে। বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজশিল্প রক্ষার জন্য ১৯৮২ সালে প্রণয়ন করা হয় ফ্ল্যাগ ভেসেল প্রটেকশন অর্ডিন্যান্স। এ অর্ডিন্যান্সে বলা আছে, আমদানি ও রফতানি মালপত্র বহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলো অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু জাহাজ সংকটকে কাজে লাগিয়ে বিদেশি জাহাজগুলো ডিজি শিপিংয়ের কাছ থেকে ওয়েভার বা অনাপত্তিপত্র নিয়ে পণ্য পরিবহন করছে।
অপরদিকে জাতিসংঘের আঙ্কটাডের নিয়মে বলা হয়েছে, সমুদ্রগামী পণ্য পরিবহন ব্যবসার ৪০ শতাংশ পাবে রফতানিকারক দেশ। ৪০ শতাংশ পাবে আমদানিকারক দেশ। মুক্তবাজার প্রতিযোগিতায় যার সামর্থ্য বেশি সে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ ব্যবসা পাবে। আর জাহাজ সংকটের কারণে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারছেন না এ খাতের উদ্যোক্তারা।
চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি
জাহাজ নিবন্ধনে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধকতা অনেক। পোশাকশিল্পের মালিকেরা বিদেশি মুদ্রা আয় করলে উল্টো তাদের নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। অথচ জাহাজের ভাড়াবাবদ বিদেশি মুদ্রা দেশে আনার পরও ৩ শতাংশ কর দিতে হয়। আবার বিদেশের কোনো বন্দর থেকে জাহাজ কেনার পর শুল্কায়নের আগে পণ্য পরিবহন করা যায় না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে এখানে সুদের হারও বেশি। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর না করলে নতুন করে জাহাজ নিবন্ধনে কেউ আগ্রহী হবে না। তাই বছরে জাহাজ ভাড়াবাবদ প্রায় ১৫০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বন্দরে বছরে পাঁচ হাজার জাহাজের আগমন হয়। যেখানে জাহাজ ভাড়া হিসেবে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় হয়। বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ চেইনে অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে জাহাজে পণ্য পরিবহনের ব্যয় ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। সমুদ্রগামী জাহাজ মালিকানায় স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানা খুব ছোট পরিসরে হওয়ায় জাহাজ ভাড়ার প্রায় পুরোটাই মূলত দেশের বাইরে চলে যায়। করছাড়ের সঙ্গে সরকারি প্রণোদনা এবং দেশী জাহাজে পণ্য পরিবহনে বাড়তি সুবিধা দেয়ার সুযোগ দিলে প্রতি অর্থবছরে স্থানীয় জাহাজ মালিকদের মাধ্যমে ১ বিলিয়ন ডলার জাহাজ ভাড়া ও কয়েক হাজার নাবিকের বেতনসহ প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় সাশ্রয় করা সম্ভব। বেসরকারি খাতে জাহাজ বৃদ্ধিতে সুদ মুক্ত অথবা স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চট্টগ্রাম এবং মংলা সমুদ্র বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কর্ণফুলী এবং পশুর নদী দুই ধারেই জেটি নির্মাণ করার পরিকল্পনা করতে হবে।
গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কোনো চালান সরাসরি ইউরোপে যায় না। প্রথমে কার্গো কন্টেইনারগুলো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো বন্দরে যায়। পরে সেখানে ইউরোপে যাওয়ার মতো কোনো মাদার ভেসেলের জন্য অপেক্ষা করে। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান জেটিগুলোতে ৯ দশমিক ৫ মিটারের বেশি ড্রাফটবিশিষ্ট জাহাজ বার্থিং করতে পারে না। এসব জাহাজ সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টিইইউএস কনটেইনার বহন করতে পারে। কিন্তু মাতারবাড়ী এবং সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দরে ৮ হাজার টিইইউএসের বেশি ক্ষমতার কনটেইনারবাহী বড় জাহাজ নোঙর করতে পারবে। এছাড়াও প্রতিবছর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সামলাতে জাহাজভাড়া বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। মাদার ভেসেল চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে না পারার কারণে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরে ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্যের চালান পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে অনেক কম সময়ে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হবে। সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর থেকে পণ্য পরিবহণ খরচ ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমে আসবে। দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হবে ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার। বড় ধরনের ফিডার ভেসেল এলে সময় ও খরচ বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে গতি আসবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলি নদীর ওপর হওয়ায় এখানে শুধুমাত্র জোয়ারের সময়ই জাহাজ ঢুকতে বা বের হতে পারে। এছাড়া কর্ণফুলি নদীতে দু'টি বাঁক থাকায় ১৯০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ বন্দরে ঢুকতে পারে না। আর গভীরতা কম থাকায় সাড়ে ৯ মিটারের বেশী গভীরতার জাহাজও বন্দরে প্রবেশ করতে পারে না। গভীর সমুদ্র বন্দরে এরকম কোনো সীমাবদ্ধতা না থাকায় যে কোনো সময় সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ মিটার গভীরতার জাহাজ সেখানে ঢুকতে পারবে। ফলে কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ থেকে পণ্য আনতে ব্যবসায়ীদের অপেক্ষাকৃত কম খরচ হবে এবং তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে পণ্য আনা নেয়া করা যাবে।
বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালীন কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়ায় একটা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয় এবং সুদূরপ্রসারী প্রকল্প হাতে নেয়। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গেমচেঞ্জার হতে পারতো।
দেশের অর্থনীতিতে এ বন্দর নতুন আয়ের উৎস যোগ করার পাশাপাশি বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। হংকং ও সিঙ্গাপুর যেমন তাদের সমুদ্রবন্দর দিয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে, বাংলাদেশও সেভাবে একই পথে হাঁটতে পারে। বন্দরকে ঘিরে মাতারবাড়ী-মহেশখালী এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়নসহ গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিপুল কর্মসংস্থান এবং দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকসহ পেশাজীবীদের জীবিকার অবারিত সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এ বন্দর ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে যে লজিস্টিক্স ও সাপ্লাইচেইন ম্যানেজমেন্টের অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি হবে, তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সহায়ক হবে এবং মাতারবাড়ী-মহেশখালী এলাকায় গড়ে ওঠায় নগরায়ণ এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুরে পরিণত করবে। এলাকার জনসাধারণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নও হবে দেখার মতো। মাতারবাড়ী নিয়ে আবর্তিত নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ দেশের জিডিপিতে ২-৩ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের সাথেই বন্দর অবস্থিত হওয়ায় পণ্য বহনকারী ট্রাকের কারণে শহরের কার্যক্রমে ব্যাঘাত তৈরি হয়, যেটি এই বন্দরের ক্ষেত্রে থাকবে না। মাতারবাড়ী বন্দর থেকে চকরিয়া পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি রাস্তা সরাসরি হাইওয়ের সাথে যুক্ত হবে। পাশাপাশি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও বন্দরের ভেতর রেল যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।
শোরবেসড স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ
বর্তমানে ১১শ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতার দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে থাকা টার্মিনাল দুটিই বেসরকারি মালিকানার। এর একটি মালিকানায় আছে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি, অন্যটি সামিট গ্রুপের। গত বছর ২৯ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময়ে সামিটের এলএনজি টার্মিনাল এফএসআরইউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর টার্মিনালটি ঠিক করে চালু করতে একাধিকবার দিনক্ষণ ঘোষণা করা হলেও কার্যত তা হয়নি। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে সামিটকে কড়া ভাষায় চিঠিও দেওয়া হয়। প্রায় সাড়ে তিন মাস বন্ধ থাকার পর টার্মিনালটি গ্যাস সরবরাহ শুরু করে। সামিটের টার্মিনালটি বন্ধ থাকার কারণে সরকার স্পট মার্কেট থেকে চার কার্গো এলএনজি কেনা বাতিল করে। এ সময় দেশে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দেয়। পাশাপাশি বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যায়।
দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শিপিং সেক্টরের নতুন নতুন ক্ষেত্র নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। যুগোপযোগী কর্মকৌশল প্রণয়ন ও আশু-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রাটেজিক পদক্ষেপ দৃশ্যমান করে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে কার্যকর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। ন্যূনতম অবজ্ঞা-অবহেলা পরিহার করে তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবেই।চীন সহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণে শিপিং সেক্টরে বিদেশি বা নিজস্ব অর্থায়নে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তির ব্যবহারে কালক্ষেপণ না করে এ ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া সময়ের দাবি।
ক্যাপ্টেন রেদওয়ান সিকদার: মাষ্টার মেরিনার ও ষ্টেট কাউন্সিলর, সাউথ এশিয়ান স্ট্রাটেজিক কংগ্রেস
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ র ম ত রব ড় এই শ ল প ব যবস থ র জন য ট ইন র র বহন অবস থ রফত ন হওয় য় আমদ ন ন করত ক ষমত অবদ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘এ’ দলে ৩৬ উইকেট পাওয়া পেসার এনামুল
নিউ জিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডের পর দুইটি চার দিনের ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ ‘এ’ দল। দুইটি চার দিনের ম্যাচের জন্য বাংলাদেশ ‘এ’ দলে সুযোগ পেয়েছেন পেসার এনামুল হক। সর্বশেষ জাতীয় ক্রিকেট লিগে ৩৬ উইকেট পেয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিভাগের হয়ে ৭ ম্যাচে ১৪ ইনিংসে ১৫.৪১ গড় ও ৩.৩৪ ইকোনমিতে লিগের সর্বোচ্চ ৩৬ উইকেট পেয়েছিলেন। লিগে আর কোনো বোলার ৩০ উইকেটের বেশি পাননি। ২০২১ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হলেও গত আসরেই আলোচনায় আসেন ২৪ বছর বয়সী এই পেসার। এবার ‘এ’ দলের হয়ে বড় মঞ্চে পারফর্ম করার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন।
এছাড়া নাঈম শেখ, এনামুল হক বিজয়, জাকির হাসান, মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ, অমিত হাসান, নাসুম আহমেদ, ইবাদত হোসেনদের নিয়ে শক্তিশালী দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ‘এ’ দল।
আরো পড়ুন:
শান্ত কেন দলে, বিপিএল সেরা হয়েও মিরাজ কেন নেই?
লিটনকে অধিনায়ক করে সাত টি-টোয়েন্টির জন্য ১৬ সদস্যের দল ঘোষণা
সিলেটে দুই দল তিনটি ওয়ানডে খেলবে ৫, ৭ ও ১০ মে। প্রথম চার দিনের ম্যাচ সিলেটেই অনুষ্ঠিত হবে। শুরু হবে ১৪ মে থেকে। দ্বিতীয় চার দিনের ম্যাচ হবে ঢাকায় মিরপুরে। শুরু হবে ২১ মে থেকে।
সীমিত পরিসরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলকে নেতৃত্ব দেবেন নুরুল হাসান সোহান। এই দলের দায়িত্বে আছেন কোচ মিজানুর রহমান বাবুল।
রবিবার (৪ মে) গণমাধ্যমে কোচ বলেছেন, ‘‘জাতীয় দলের যে গ্যাপগুলো আছে সেগুলো পূরণ করা আমাদের লক্ষ্য। পাশাপাশি ভালো ক্রিকেট খেলে তো জিততেই চাইব। পাইপলাইন সমৃদ্ধ করাই আমাদের কাজ। কিছু খেলোয়াড় আমরা তৈরি রাখতে চাই জাতীয় দলের জন্য।’’
চার দিনের স্কোয়াড: নাঈম শেখ, এনামুল হক বিজয়, জাকির হাসান, সাইফ হাসান, মাহমুদুল হাসান জয়, মাহিদুল ইসলাম, অমিত হাসান, কাজী নুরুল হাসান সোহান, হাসান মুরাদ, নাঈম হাসান, নাসুম আহমেদ, সাঈদ খালেদ আহমেদ, ইবাদত হোসেন চৌধুরী, এনামুল হক ও মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ।
ওয়ানডের স্কোয়াড: নাঈম শেখ, এনামুল হক বিজয়, মাহিদুল ইসলাম, সাইফ হাসান, ইয়াসির আলী চৌধুরী, কাজী নুরুল হাসান, অমিত হাসান, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, আফিফ হোসেন ধ্রুব, নাসুম আহমেদ, নাঈম হাসান, ইবাদত হোসেন চৌধুরী, মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ, সৈয়দ খালেদ আহমেদ ও রেজাউর রহমান রাজা।
ঢাকা/ইয়াসিন