ষাট বছর আগে চীনে যেভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল, তা ছিল বিশৃঙ্খল, সহিংস ও অগোছালো। কিন্তু এবার চীন সংস্কৃতিগত পরিবর্তনের যে উদ্যোগটি নিয়েছে, তা অনেক বেশি পরিকল্পিত, গোছানো এবং শক্ত অবস্থান থেকে পরিচালিত হচ্ছে।

চীন এখন দেশের ভেতরে পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে নিজস্ব সংস্কৃতিকে জোরদার করছে। অনেকের মতে, এটি এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। চীন হয়তো দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজের মতো করে টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চীন একটি নতুন একাডেমিক শাখা চালু করেছে। এর উদ্দেশ্য জাতিগত গবেষণায় পশ্চিমা পক্ষপাত দূর করা এবং একক জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নিজেদের বয়ানকে মজবুত করা।’ এই উদ্যোগ সম্ভবত সোভিয়েত যুগ থেকে পাওয়া জাতিগত দ্বন্দ্বের বোধকে অতিক্রম করার চেষ্টা।

চীনের জাতীয় জাতিগত–বিষয়ক কমিশনের পরিচালক পান ইউয়ে বলেছেন, ‘চীনের জাদুঘরগুলোর উচিত সব ধরনের ভুল ইতিহাসভিত্তিক ধারণার বিরোধিতা করা। বিশেষ করে হান ও অ-হান জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ তৈরির যেকোনো চেষ্টা রুখে দেওয়া।’

পান ইউয়ে পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই এই উদ্যোগকে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এর লক্ষ্য হচ্ছে—জাতীয় ঐক্য মজবুত করা, জাতিগত বিভাজন কমিয়ে আনা এবং ধীরে ধীরে বিদেশি সাংস্কৃতিক প্রভাব দূর করা।

তবে এই উদ্যোগ শুধু রাজনৈতিক নয়, একে একটি সাংস্কৃতিক প্রশ্ন হিসেবেও দেখা যায়। চীনা চিন্তাবিদ গো ঝাওগুয়াং তাঁর ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘চীনা চিন্তার ইতিহাস’ বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে লিখেছেন, বিশ শতকের শুরুর দিকে চীন তার সব চিন্তা-পদ্ধতি পশ্চিমা ক্যাটাগরিতে পুনর্গঠিত করেছিল। যেমন ‘দর্শন’, ‘ধর্ম’ বা ‘অর্থনীতি’—এগুলো চীনা চিন্তায় আগে ছিল না। জাপানি অনুবাদের মাধ্যমে এই শব্দগুলো এসেছে।

এই পুনর্বিন্যাসের ফলে চীনের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও নতুনভাবে সাজানো হবে। কিন্তু সমাজের অনেকেই হয়তো এই পরিবর্তনকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেনি এখনো। ফলে তারা দুই জগতের মধ্যে আটকে গেছে। একদিকে পশ্চিমা ধারণা, অন্যদিকে চিরাচরিত চীনা চিন্তা।

মাও সে–তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবও এই দ্বন্দ্ব মোকাবিলার চেষ্টা করেছিল। তবে তা ছিল ধ্বংসাত্মক। এবারকার প্রচেষ্টা তুলনামূলকভাবে বেশি স্থির, অনেক বেশি বাস্তবভিত্তিক। তবে এমন উদ্যোগ ভবিষ্যতের নানা বিকাশকেও বাধা দিতে পারে।

প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রও কি তার মাদক সমস্যা বা বাণিজ্য দ্বন্দ্বের মতো অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো মোকাবিলায় এমন কোনো সামগ্রিক ভাবনা ভাবছে? নাকি কেবল বাইরের দিকেই শত্রু খুঁজে বেড়াচ্ছে? এই সংকটগুলো চীনকে ঘিরে হলেও সেগুলোর সমাধান কেবল চীন দিয়ে হবে না।

আমেরিকার সঙ্গে কথোপকথন

বেইজিং এখন আমেরিকাকে দেখছে নেশায় আসক্ত এক দেশ হিসেবে। ঠিক যেমন একসময় চীন আফিম আসক্তিতে ধ্বংসের মুখে পড়েছিল, আমেরিকা তেমনভাবেই এখন একটি ভয়াবহ মাদকসংকটে ভুগছে। চীনের সরকারি দৈনিক পিপলস ডেইলি জানিয়েছে—আমেরিকার জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ, কিন্তু তারা পুরো বিশ্বের ৮০ শতাংশ আফিমজাত মাদক ব্যবহার করে।

দুই শ বছর আগে, চীনের রাজসভার আদেশে আফিম আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, আফিমই একমাত্র পণ্য, যা চীনারা বিদেশ থেকে কিনতে আগ্রহী।

এরপর ১৮৪০ সালে ব্রিটিশরা এবং ১৮৫৬ সালে আরও কিছু পশ্চিমা শক্তি চীনের সঙ্গে আফিম বাণিজ্য চালু রাখতে যুদ্ধ করে। ইতিহাসে তা ‘আফিম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। চীন আফিমকে জাতীয় পতনের অন্যতম কারণ মনে করলেও পশ্চিমারা বলেছিল, চীনারা যদি বেশি আফিম খায়, সেটা তাদেরই সমস্যা।

এখন দৃশ্যপট উল্টো। যুক্তরাষ্ট্র ফেন্টানিল নামের ভয়াবহ এক সিনথেটিক ড্রাগে আক্রান্ত। এই ড্রাগের মূল উপাদান চীন থেকে রপ্তানি হয়। এই উপাদান অনেক সময় বৈধ ওষুধ তৈরিতেও লাগে। তবে এর অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করতে চীন যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করছে। অন্যদিকে চীন বলছে, আমেরিকান সমাজের আসক্তিই আসল সমস্যা—শুধু চীনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

১৮-৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ফেন্টানিল এখন মৃত্যুর প্রধান কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। দুই শ বছর আগে আফিম নিয়ে টানাপোড়েন যুদ্ধ ডেকে এনেছিল। আজকের এই মাদকসংকট কি নতুন কোনো সংঘর্ষ ডেকে আনবে?

যোগাযোগ ও সংস্কৃতির প্রশ্ন

বিশ্ব এখনো যোগাযোগে পশ্চিমা সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। শুধু ভাষা নয়, পুরো চিন্তাপদ্ধতিই এখানে পশ্চিমাদের আদলে তৈরি।

তাই চীন যদি তার নিজস্ব সংস্কৃতি বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে বর্তমান যোগাযোগব্যবস্থার ভাষা হারাতে পারে। অথচ বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এখনো চীনকে পশ্চিমা ঘরানার ভাষা ও চিন্তা ব্যবহার করতে হয়। কারণ, বিশ্ব তো এখনো ‘চীনকেন্দ্রিক’ ভাবনায় অভ্যস্ত নয়।

পাঁচ শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা পশ্চিমা সাংস্কৃতিক কাঠামোকে সরিয়ে দিতে চাইলে সময় লাগবে। আর যদি আমেরিকা পিছিয়ে পড়ে এবং চীন সেই শূন্যতা পূরণ করতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই পশ্চিমা ভাবভাষায় কথা বলতে জানতে হবে। তা না হলে তাদের কেউ বুঝবে না। চীনও অন্যদের বুঝতে পারবে না।

তা ছাড়া, যদি আমেরিকার এই সংকট কখনো চূড়ান্ত পতনের দিকে যায়, তাহলেও চীনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ চালু রাখতেই হবে। বিশ্ব হয়তো এক শতক পর ‘চীনা সংস্কৃতি’কে ভালোভাবে চিনবে। কিন্তু এই সময়টাতে পশ্চিমা ধারণাকে উপেক্ষা করা আত্মঘাতী হতে পারে।

বাস্তবে সমস্যাটা আরও গভীর। অনেক পশ্চিমা ধারণাই এখন আর বাস্তবতা অনুযায়ী কাজ করছে না। ট্রাম্পের আমলে আমেরিকায় যে ধাক্কা লেগেছে, তা একটি নিরাপত্তাহীন ও দিশাহারা জাতির চিত্র তুলে ধরেছে।

চীন এখন সংস্কৃতিকে পুনর্বিন্যাস করছে, নতুন ক্যাটাগরিতে সাজাচ্ছে। তারা তা করতে চাইছে সংঘাতের বদলে সামগ্রিক সমাধানমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারা মনে করে, গোটা বিশ্বব্যবস্থারই পুনর্গঠন দরকার। এর মানে এই নয় যে সমাধানটা নিখুঁত হবে। কিন্তু সমস্যার অস্তিত্ব যে প্রকট, তা অস্বীকার করা যাবে না।

প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রও কি তার মাদক সমস্যা বা বাণিজ্য দ্বন্দ্বের মতো অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো মোকাবিলায় এমন কোনো সামগ্রিক ভাবনা ভাবছে? নাকি কেবল বাইরের দিকেই শত্রু খুঁজে বেড়াচ্ছে? এই সংকটগুলো চীনকে ঘিরে হলেও সেগুলোর সমাধান কেবল চীন দিয়ে হবে না।

ফ্রান্সেসকো সিসি ইতালীয় লেখক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ বন দ ব জ ত গত আম র ক সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

ডি ব্রুইনা-সিটির পুনর্মিলনীতে হলান্ডের দ্রুততম ‘ফিফটি’

ম্যানচেস্টার সিটি ২-০ নাপোলি

ইতিহাদ ছেড়ে গিয়েছিলেন গত জুনে। তারপর এবারই তাঁর প্রথম ফেরা বড় সাধের এই স্টেডিয়ামে। ম্যানচেস্টার সিটির দর্শকেরা তাঁকে নায়কের মর্যাদায় বরণও করে নিলেও কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি থেকে গেল। কেভিন ডি ব্রুইনা এখন হতে পারেন প্রতিপক্ষ, তবু ম্যাচের মাত্র ২৬ মিনিটে তাঁর বদলি হয়ে মাঠ ছাড়ার সময় সিটির দু-একজন সমর্থকদের মুখটা শুকনো দেখা গেল। ক্লাব কিংবদন্তিকে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁরা সম্মান দেখিয়েছেন, তবে মাঠে আরও কিছুক্ষণ দেখতে চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই!

কৌশলগত কারণে মাঠ ছাড়তে হয় ডি ব্রুইনাকে। নাপোলি কোচ আন্তোনিও কন্তে অবশ্য তাতে হার এড়াতে পারেননি। বিরতির পর আর্লিং হলান্ড ও জেরেমি ডকুর গোল হজম করতে হয়। সিটির ২-০ গোলের এ জয়ে দারুণ এক রেকর্ডও গড়েন হলান্ড।

৫৬ মিনিটে তাঁর গোলটির উৎস সিটি মিডফিল্ডার ফিল ফোডেন। লব করে দারুণভাবে বলটা তুলে সামনে বাড়িয়ে দেন, হেডে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজের ৫০তম গোল তুলে নেন হলান্ড। সেটা আবার এই প্রতিযোগিতার ইতিহাসে দ্রুততম। ৪৯ ম্যাচে ‘ফিফটি’ পাওয়া হলান্ড পেছনে ফেললেন রুদ ফন নিষ্টলরয়কে (৬২ ম্যাচ)।

ডকুর গোলটি দেখার মতো। ৬৫ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে বল পেয়ে ভেতরে ঢুকে গোল করার পথে নাপোলির তিন খেলোয়াড় মিলেও তাঁকে থামাতে পারেননি। সিটির এই দুই গোলে এগিয়ে যাওয়া আসলে একটি সুবিধার ফল। ২১ মিনিটে বক্সে হলান্ডকে ফাউল করে লাল কার্ড দেখেন নাপোলি অধিনায়ক ও রাইট ব্যাক জিওভান্নি ডি লরেঞ্জো। এরপর ১০ জনে পরিণত হওয়া ইতালিয়ান ক্লাবটির ওপর চেপে বসে সিটির আক্রমণভাগ।

গোল করলেন জেরেমি ডকু

সম্পর্কিত নিবন্ধ