ক্রাউন সিমেন্ট ‌‘অভিজ্ঞতার আলো’ শিরোনামে বাংলাদেশের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। দুই মাস আগে গিয়েছিলাম শিল্পী রফিকুন নবীর কাছে। তিনি বলছিলেন তাঁর শৈশবের স্মৃতিগুলো—পঞ্চাশের দশকে লৌহজংয়ে ছিলেন। বড় ভূমিকম্প হলো। পুরো মাটি কাঁপছিল। বাসার সামনে যে বড় দিঘি ছিল একটা, সেটার পানি সেই সমুদ্রের পানির মতো উথলে উঠে একদম চারদিকে চলে যাচ্ছে। আর ওই কাঁপাকাঁপির মধ্যে মানুষজন সব মাছ ধরতে ব্যস্ত।

রফিকুন নবীর বাবা স্লেট–পেনসিলে ছবি এঁকে দিয়ে লেখা শেখাতেন। অজগর আঁকতেন, তারপর লিখতেন স্বরে অ। রফিকুন নবীর আগ্রহ ছিল ছবির দিকে। ফতুল্লার স্কুলে পড়তেন। ফোর–ফাইভে থাকতে বর্ধমান হাউসে শিল্পকলার প্রদর্শনী দেখতে চলে গিয়েছিলেন। নারিন্দায় যখন থাকতেন, তখন মহল্লায় আশপাশে থাকতেন বড় শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, নূরজাহান বেগম, আবদুল্লাহ আল–মুতী শরফুদ্দিন। তাঁদের কাছ থেকে লেখা এনে নিজেই দেয়ালপত্রিকা বানাতেন—অভিযাত্রিক। নিজের হাতের লেখা, নিজের আঁকা ছবি। কচি-কাঁচার মেলার দাদাভাই ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় ছবি চাইলেন। রফিকুন নবী ছবি জমা দিলেন, পুরস্কার পেলেন। আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানকে। ভালো ছাত্র ছিলেন। পরীক্ষার ফল ভালো হতো। আবার ষাটের দশকের আন্দোলনে অংশ নিতেন ছবি-কার্টুন-পোস্টার-প্রচ্ছদ এঁকে দিয়ে। খবরের কাগজে ইলাস্ট্রেশন করতেন।

রফিকুন নবী আমাদের শিল্পগুরুদের একজন। ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর তাঁর জন্ম, চাঁপাইনবাবগঞ্জে। বাবা পুলিশ ছিলেন, দাদা পুলিশ ছিলেন। বাড়ির নাম ছিল দারোগাবাড়ি। পুলিশ বাবা ছবি আঁকতেন। এখনো রফিকুন নবীর ঢাকার শেওড়াপাড়ার বাড়ির দেয়ালে তাঁর বাবার আঁকা ছবি ঝুলছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম হলেও বাবার বদলির চাকরির কারণে তাঁর শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের নানা জায়গায়। যেমন মনে করতে পারেন সিংড়া থানার কথা। সেখানকার জলাভূমি, গাছপালা, গুইসাপ আর মাছ। মনে করতে পারেন মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের ছেলেবেলা।

গ্রিসে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার পর বৃত্তি নিয়ে। পড়াশোনা করেছেন কাঠখোদাই নিয়ে।

তাঁর আঁকা কার্টুন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বিচিত্রা আর দৈনিক বাংলায়। বাংলা ভাষায় টোকাই শব্দটা তাঁর অবদান। টোকাইয়ের কত সংলাপ আজও আমার মনে আছে। ‘শুনেছিস, গরিব শিশুরা ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে।’ ভাবুক টোকাইয়ের জবাব, ‘বড় আছিল কবে?’ কিংবা ভারতীয়রা সীমান্তে ওয়াচটাওয়ার বসিয়েছে। তারা ওয়াচটাওয়ারে দুরবিন দিয়ে দেখেছে আর বলছে, ইশ্‌, ইলিশ খাচ্ছে রে!’

টোকাই নিয়ে রফিকুন নবী বলেন, ‘মজা করতে করতে মজা পাওয়াটা হলো আসল মজা। পেতে পেতে একসময় দেখি যে এটা একেবারে মজ্জায় ঢুকে গেছে। মজাটা ডাবল জয়ে চলে গেল।’

এখন যদি টাইমমেশিনে চড়ে চলে যাওয়া যেত, কোথায় যেতে চান—পুরান ঢাকা নাকি চাঁপাইনবাবগঞ্জে? তিনি যেতে চান চাঁপাইনবাবগঞ্জেই। জন্মস্থান। দারোগাবাড়ি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি, আমাদের মতো এই সুন্দর দেশ আর দুটি পাওয়া যাবে না।’ বাংলাদেশের একজন প্রধান শিল্পী তা-ই মনে করেন। সুন্দর দেশের সৌন্দর্যের একজন সাধক রফিকুন নবী, আপনি দীর্ঘজীবী হোন। সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে থাকুন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প ইনব বগঞ জ স ন দর

এছাড়াও পড়ুন:

সংবেদনশীল না হলে কেউ ভালো শিল্পী হতে পারে না: জুয়েল আইচ

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পডকাস্ট শো ‘লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় একাদশতম পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। আলোচনার বিষয় ছিল ‘শিল্প, মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবতার সংমিশ্রণে গঠিত এক অনন্য লিগ্যাসি’।

‘মানুষ তার আশার সমান সুন্দর, বিশ্বাসের সমান বড় এবং কাজের সমান সফল। কাজই মুক্তি। তবে আশাও বড় রাখতে হবে। আশা না থাকলে কাজ হবে না।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে কথাগুলো বলেন জুয়েল আইচ। পডকাস্ট শোর এ পর্ব প্রচারিত হয় গতকাল শনিবার প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে।

পডকাস্টের শুরুতেই সঞ্চালক জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীশিবিরে প্রথম যেদিন জাদু দেখালেন, সেই অনুভূতি কেমন ছিল?

উত্তরে জুয়েল আইচ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সব বাদ দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিই। আমরাই খুব সম্ভবত প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করি। আমি শৈশব থেকেই জাদু দেখাই। তবে মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীশিবিরে জাদু দেখানোর সেই অনুভূতিটি ছিল একেবারেই ম্যাজিক্যাল।’

প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, শিল্পকে সাহস করে অস্ত্রতে পরিণত করার এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এল?

জুয়েল আইচ বলেন, ‘এটা আত্মবিশ্বাস নয়। আমি অসম্মান সহ্য করতে পারি না। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছিলাম, তারা (পাকিস্তান) আমাদের বিভিন্নভাবে অসম্মান করে আসছে। কখনো গানে, কখনো ছবি এঁকে কিংবা কবিতার ভাষায় আমরা সব সময় এর প্রতিবাদ করে এসেছি। এভাবে করেই শেষ পর্যন্ত আমরা মুক্তিযুদ্ধে নেমে গেলাম।’

জুয়েল আইচকে কেউ বলেন ম্যাজিশিয়ান, আবার কেউ বলেন মিউজিশিয়ান। তবে জুয়েল আইচ একজন দার্শনিকও বটে। জাদুর মোহনীয়তা আর বাস্তবতার যে রূঢ় চিত্র—এই দুটো আপনার জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে?

সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে জুয়েল আইচ বলেন, ‘বাস্তবতাকে আমরা বলে থাকি “কঠিন” আর স্বপ্ন তো আমরা আকাশসমান ভাবতে পারি। একদম রংধনুর মতো সাত রং। এই দুটোকে যদি কেউ আয়ত্ত না করতে পারে, তবে তার জীবন কিন্তু সেখানেই শেষ। সে বেঁচে থাকবে কিন্তু মরার মতো।’ তিনি বলেন, ‘সে জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দরকার। যেমন আপনি কোনোভাবেই আমাকে দুঃখী বানাতে পারবেন না। আমি দুঃখ পাই না, তবে বারবার আমাকে খ্যাপাতে থাকলে আমি রুখে দাঁড়াই।’

জুয়েল আইচ কখনোই পরিপূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া স্টেজে ওঠেন না। সঞ্চালক জানতে চান, এর পেছনে কারণ কী?

জুয়েল আইচ বলেন, প্রস্তুতি ছাড়া কোনো কাজ সুন্দরমতো হয় না। প্রস্তুতি ছাড়া যদি কেউ কিছু করে, তবে সেগুলো অনেক নিম্নমানের হবে। তিনি বলেন, ‘আমি একটি বাঁশি দিয়ে সব রাগ বাজাতে পারি। এটা কি এক দিনেই সম্ভব!’

আপনার পারফরম্যান্সের সময় আপনি মাঝেমধ্যে নিঃশব্দ হয়ে যান। যেখানে কোনো উদ্যম নেই। এই ‘সাইলেন্স’-এর কারণটা কী?

সঞ্চালক জানতে চাইলে জুয়েল আইচ বলেন, শব্দের চেয়ে নিঃশব্দের ভাষা বেশি গভীর। একটি পেইন্টিং, যেখানে কোনো শব্দ থাকে না কিন্তু কত কিছু বলে দেয়! দেখবেন কেউ অনেক খেপে গেলে নীরব হয়ে যায়। আসলে শব্দে যা বলা যায়, নিঃশব্দে তার চেয়ে বেশি প্রকাশ করা সম্ভব।

বর্তমানের এই ডিজিটাল যুগে সবকিছুই হাতের নাগালে, এমনকি জাদুও। জাদু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে আসার পর এর আবেদন কিছুটা কমে যাচ্ছে কি না? জানতে চাইলে জুয়েল আইচ বলেন, খালি চোখে দেখলে তা আসলেই কমে যাচ্ছে। কারণ, এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে যে জাদুগুলো দেখানো হচ্ছে, তা দেখে মানুষ বিস্মিত। তিনি বলেন, ‘তারা ভাবছে, আমরা আগে যেসব জাদু দেখেছি, এগুলো তো তার থেকেও বিস্ময়কর। কিন্তু তারা হয়তো বুঝতে পারছে না, এখন সবকিছুর সঙ্গে মিশে গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’

সঞ্চালক এরপর প্রশ্ন করেন, আপনি একসময় ‘পালস স্টপিং’ ধরনের ইলিউশন বন্ধ করেছিলেন। এর পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল?

জুয়েল আইচ বলেন, ‘এই পালস স্টপিংয়ের মাধ্যমে আমি পুরো দেশজুড়ে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলাম। দলে দলে মানুষ এটি দেখতে আসত। কিন্তু এসব দেখে মানুষ অনেক বেশি আতঙ্কিত হতো, অনেক মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ত। একবার একজন অনেক বড় পালোয়ান এটি দেখতে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। সেদিন শো শেষ করেই আমি আমার টিমকে বলি, এই ম্যাজিক আর হবে না। কারণ, এই ম্যাজিক এত এত মানুষকে ডেকে আনছে বটে কিন্তু এটি মাত্রা অতিক্রম করে ফেলছে। যা মোটেও ঠিক নয়।’

প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, তাহলে কি একজন শিল্পীকে সংবেদনশীলও হতে হয়?

‘অবশ্যই।’ জুয়েল আইচ বলেন, একজন শিল্পীকে অবশ্যই সংবেদনশীল হতে হবে। সংবেদনশীল না হলে তিনি ভালো শিল্পী হতে পারবেন না।

আপনি যেমন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের সামনে পারফর্ম করেছেন, তেমনি এমন শিশুদের জন্যও জাদু দেখিয়েছেন, যারা কখনো টিকিট কিনে শো দেখতে পারে না। আপনার চোখে আসল মর্যাদা কোথায়—বৃহৎ মঞ্চে, নাকি একটিমাত্র বিস্মিত মুখে?

সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে জুয়েল আইচ বলেন, ‘আসলে মঞ্চ ব্যাপার নয়। আমি আমার জাদুতে বিস্মিত এবং মুগ্ধ হয়ে থাকা দেখতে ভালোবাসি। শুধু বিস্ময় নয়, বিস্ময়ের সঙ্গে মুগ্ধতা আমার ভালো লাগে।’

আরও পড়ুননীতি আর মূল্যবোধ শক্ত থাকলে কেউ থামাতে পারবে না: রুবাবা দৌলা১২ অক্টোবর ২০২৫

পডকাস্টের শেষ পর্যায়ে সঞ্চালক জানতে চান, আমরা আরেকজন জুয়েল আইচ কবে পাব?

মুচকি হেসে জুয়েল আইচ বলেন, ‘যখন সেই উদ্যম নিয়ে কেউ কাজ করবে, ঠিক তখন। সে হয়তো আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। শুধু ম্যাজিকে নয়, সব দিক দিয়েই।’

আরও পড়ুনবাবা প্রথমে আমাকে অফিস সহকারীর কাজ দিয়েছিলেন: হাতিলের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান০৫ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এপস্টেইনের নথি প্রকাশের পক্ষে হঠাৎ কেন অবস্থান নিলেন ট্রাম্প
  • এশিয়ার প্রভাবশালী নারী ব্যবসায়ী কারা, কীসের ব্যবসা তাঁদের
  • করদাতা মারা গেলেও যে কারণে কর দিতে হয়, কীভাবে দেওয়া হয়
  • ৩ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত উড়োজাহাজসহ আরও যা যা পান একজন মিস ইউনিভার্স
  • গায়িকা থেকে বিধায়ক, মৈথিলীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসারী চমকে ওঠার মতো
  • সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিলেন উপদেষ্টার এপিএস
  • বিএনপি নেতা খুন: অভিযুক্ত ছাত্রদল কর্মী ফেসবুকে লিখলেন ‘আউট’
  • সাজা হলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে ‘কনভিকশন ওয়ারেন্টের’ আবেদন করা হবে
  • সূর্যের সামনে স্কাইডাইভার, তৈরি হয়েছে এক অলীক আলোকচিত্র
  • সংবেদনশীল না হলে কেউ ভালো শিল্পী হতে পারে না: জুয়েল আইচ