সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে থাকুন রফিকুন নবী
Published: 17th, August 2025 GMT
ক্রাউন সিমেন্ট ‘অভিজ্ঞতার আলো’ শিরোনামে বাংলাদেশের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। দুই মাস আগে গিয়েছিলাম শিল্পী রফিকুন নবীর কাছে। তিনি বলছিলেন তাঁর শৈশবের স্মৃতিগুলো—পঞ্চাশের দশকে লৌহজংয়ে ছিলেন। বড় ভূমিকম্প হলো। পুরো মাটি কাঁপছিল। বাসার সামনে যে বড় দিঘি ছিল একটা, সেটার পানি সেই সমুদ্রের পানির মতো উথলে উঠে একদম চারদিকে চলে যাচ্ছে। আর ওই কাঁপাকাঁপির মধ্যে মানুষজন সব মাছ ধরতে ব্যস্ত।
রফিকুন নবীর বাবা স্লেট–পেনসিলে ছবি এঁকে দিয়ে লেখা শেখাতেন। অজগর আঁকতেন, তারপর লিখতেন স্বরে অ। রফিকুন নবীর আগ্রহ ছিল ছবির দিকে। ফতুল্লার স্কুলে পড়তেন। ফোর–ফাইভে থাকতে বর্ধমান হাউসে শিল্পকলার প্রদর্শনী দেখতে চলে গিয়েছিলেন। নারিন্দায় যখন থাকতেন, তখন মহল্লায় আশপাশে থাকতেন বড় শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, নূরজাহান বেগম, আবদুল্লাহ আল–মুতী শরফুদ্দিন। তাঁদের কাছ থেকে লেখা এনে নিজেই দেয়ালপত্রিকা বানাতেন—অভিযাত্রিক। নিজের হাতের লেখা, নিজের আঁকা ছবি। কচি-কাঁচার মেলার দাদাভাই ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় ছবি চাইলেন। রফিকুন নবী ছবি জমা দিলেন, পুরস্কার পেলেন। আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানকে। ভালো ছাত্র ছিলেন। পরীক্ষার ফল ভালো হতো। আবার ষাটের দশকের আন্দোলনে অংশ নিতেন ছবি-কার্টুন-পোস্টার-প্রচ্ছদ এঁকে দিয়ে। খবরের কাগজে ইলাস্ট্রেশন করতেন।
রফিকুন নবী আমাদের শিল্পগুরুদের একজন। ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর তাঁর জন্ম, চাঁপাইনবাবগঞ্জে। বাবা পুলিশ ছিলেন, দাদা পুলিশ ছিলেন। বাড়ির নাম ছিল দারোগাবাড়ি। পুলিশ বাবা ছবি আঁকতেন। এখনো রফিকুন নবীর ঢাকার শেওড়াপাড়ার বাড়ির দেয়ালে তাঁর বাবার আঁকা ছবি ঝুলছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম হলেও বাবার বদলির চাকরির কারণে তাঁর শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের নানা জায়গায়। যেমন মনে করতে পারেন সিংড়া থানার কথা। সেখানকার জলাভূমি, গাছপালা, গুইসাপ আর মাছ। মনে করতে পারেন মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের ছেলেবেলা।
গ্রিসে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার পর বৃত্তি নিয়ে। পড়াশোনা করেছেন কাঠখোদাই নিয়ে।
তাঁর আঁকা কার্টুন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বিচিত্রা আর দৈনিক বাংলায়। বাংলা ভাষায় টোকাই শব্দটা তাঁর অবদান। টোকাইয়ের কত সংলাপ আজও আমার মনে আছে। ‘শুনেছিস, গরিব শিশুরা ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে।’ ভাবুক টোকাইয়ের জবাব, ‘বড় আছিল কবে?’ কিংবা ভারতীয়রা সীমান্তে ওয়াচটাওয়ার বসিয়েছে। তারা ওয়াচটাওয়ারে দুরবিন দিয়ে দেখেছে আর বলছে, ইশ্, ইলিশ খাচ্ছে রে!’
টোকাই নিয়ে রফিকুন নবী বলেন, ‘মজা করতে করতে মজা পাওয়াটা হলো আসল মজা। পেতে পেতে একসময় দেখি যে এটা একেবারে মজ্জায় ঢুকে গেছে। মজাটা ডাবল জয়ে চলে গেল।’
এখন যদি টাইমমেশিনে চড়ে চলে যাওয়া যেত, কোথায় যেতে চান—পুরান ঢাকা নাকি চাঁপাইনবাবগঞ্জে? তিনি যেতে চান চাঁপাইনবাবগঞ্জেই। জন্মস্থান। দারোগাবাড়ি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি, আমাদের মতো এই সুন্দর দেশ আর দুটি পাওয়া যাবে না।’ বাংলাদেশের একজন প্রধান শিল্পী তা-ই মনে করেন। সুন্দর দেশের সৌন্দর্যের একজন সাধক রফিকুন নবী, আপনি দীর্ঘজীবী হোন। সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে থাকুন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ইনব বগঞ জ স ন দর
এছাড়াও পড়ুন:
সার্কভুক্ত ‘দেশি’ ফুটবলার আশীর্বাদ নাকি শঙ্কা
বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে সার্কভুক্ত দেশগুলোর ফুটবলারদের ‘দেশি’ খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ দেওয়াকে কেউ স্বাগত জানাচ্ছেন, কেউ আবার এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
আবাহনী লিমিটেডের কোচ মারুফুল হক বলেন, ‘এই চ্যালেঞ্জটা আমাদের দেশি খেলোয়াড়দের সামনে থাকা উচিত।’ অন্যদিকে সাবেক জাতীয় ফুটবলার আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুর প্রশ্ন, ‘দেশি খেলোয়াড়দের সুযোগ না দিলে জাতীয় দল কীভাবে গড়ে উঠবে?’
নতুন মৌসুমের জন্য খেলোয়াড় নিবন্ধন শেষ হয়েছে গতকাল। শেষ খবর, চারটি ক্লাব সার্কভুক্ত দেশের মোট আট ফুটবলারকে বাফুফের কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ এফসি নিয়েছে নেপালের গোলরক্ষক ও অধিনায়ক কিরণ কুমার লিম্বু, ফরোয়ার্ড আয়ুশ ঘালান এবং ভুটানের মিডফিল্ডার ওয়াংচুক শেরিংকে। ফর্টিস এফসিতে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক ও গোলরক্ষক সুজান পেরেরা এবং নেপালের ডিফেন্ডার অনন্ত তামাং। রহমতগঞ্জে নেপালের ডিফেন্ডার অভিষেক লিম্বু। আরামবাগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী ও মিঠুন সামান্তাকে, তাঁদের একজন গোলকিপার একজন ডিফেন্ডার।
কোনোভাবেই সার্কের খেলোয়াড়কে দেশি কোটায় আনা ঠিক হয়নি। দেশিদের সুযোগ না দিলে খেলোয়াড় উঠে আসবে কীভাবে? জাতীয় দলই–বা কীভাবে তৈরি হবে? এগুলো ভাবতে হবে।আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, সাবেক ফুটবলারক্লাবগুলোর সার্কের ফুটবলারের দিক ঝোঁকার বড় কারণ অর্থনৈতিক সুবিধা। স্থানীয় শীর্ষ খেলোয়াড়দের মাসিক বেতন যেখানে পাঁচ–ছয় লাখ টাকা বা তারও বেশি, সেখানে নেপাল বা ভুটানের জাতীয় দলের খেলোয়াড় পাওয়া যাচ্ছে এক থেকে দেড় লাখ বা তারও কম টাকায়। অর্থনৈতিক ব্যাপারটা যে বড় কারণ, তা স্বীকার করে নিলেন রহমতগঞ্জের সভাপতি টিপু সুলতান, ‘নেপাল, শ্রীলঙ্কা বা ভুটানের ফুটবলারদের মান বাংলাদেশিদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। কিন্তু ওদের পাওয়া যাচ্ছে কম টাকায়। ক্লাব এই সুযোগটা নেবেই।’
নতুন নিয়মে প্রতিটি ক্লাব সার্কভুক্ত দেশ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন খেলোয়াড় নিবন্ধন করাতে পারবে এবং তাঁদের সবাইকে এক ম্যাচে খেলানো যাবে। সার্কের বাইরের দেশ থেকে পাঁচজন বিদেশি নেওয়া যাবে, তবে মাঠে একসঙ্গে সর্বোচ্চ তিনজন খেলতে পারবেন। অর্থাৎ, এ মৌসুমে কোনো ক্লাব চাইলে একাদশে সর্বোচ্চ আটজন বিদেশি খেলাতে পারবে। কোনো দল যদি এ সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে, সেই দলের একাদশে দেশি খেলোয়াড় থাকবেন মাত্র তিনজন। তাঁদের মধ্যে একজন আবার অনূর্ধ্ব–১৯ হতে হবে।
সার্ক দেশগুলোর খেলোয়াড় এলে আমাদের লিগের মান বাড়তে পারে। তবে সার্কের এক বা দুজন ঠিক আছে, পাঁচজন খেললে দেশের খেলোয়াড়দের সুযোগ কমবে, এটা ঠিক।ছাইদ হাছান কানন, বাফুফের সদস্য ও সাবেক ফুটবলারদেশের ফুটবল–বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এত বিদেশি খেলানো জাতীয় দলের জন্য ক্ষতিকর। মোহামেডানের কোচ আলফাজ আহমেদ বলেন, ‘সার্কভুক্ত খেলোয়াড়দের দেশি কোটায় আনা উচিত নয়। এতে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের খেলার সুযোগ কমে যাবে। নতুন নিয়মটা কোনোভাবেই সমর্থন করি না।’ তাঁর প্রস্তাব, সার্কভুক্ত একজন, সার্কের বাইরে তিনজনসহ মোট চারজন বিদেশি খেলানো যেতে পারে।
আটজন বিদেশি খেললে বাকি তিনজন হবে স্থানীয় এবং তারা মানসম্মত হবে। যারা সুযোগ পাবে না, তারা নিজেদের যোগ্যতা বাড়াবে। দুই-তিন মৌসুমের মধ্যে দেশে মানসম্মত খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে।মারুফুল হক, কোচ, আবাহনী লিমিটেডবাংলাদেশের ফুটবলে এর আগে পাঁচজন বিদেশি এক ম্যাচে খেলতে পেরেছেন। কিন্তু এবার নজিরবিহীনভাবে তা আটে পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে। যদিও কোনো ক্লাবই পাঁচজন সার্কভুক্ত খেলোয়াড় নেয়নি। বড় দলগুলো একজনও নেয়নি। তারপরও অভিজ্ঞ কোচ জুলফিকার মাহমুদ মিন্টুও নিয়মটা সমর্থন করছেন না, ‘সার্কভুক্ত খেলোয়াড়দের দেশি কোটায় খেলানোর সিদ্ধান্তটা আরও চিন্তাভাবনা করে নেওয়া উচিত ছিল। বলা হচ্ছে, আমাদের খেলোয়াড়দের জন্য সার্কের অন্য দেশগুলোর দুয়ারও খুলবে। কিন্তু আমাদের খেলোয়াড়েরা কোথাও তো ডাক পায়নি। পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখছি না। এর ফলে আমাদের ফুটবল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
সাবেক ফুটবলার আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুও নিয়মটা মানতে পারছে না। তাঁর কথায়, ‘এমনিতে বিদেশিরা বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে আমাদের ফুটবলে। তার ওপর এখন কোনোভাবেই সার্কের খেলোয়াড়কে দেশি কোটায় আনা ঠিক হয়নি। দেশিদের সুযোগ না দিলে খেলোয়াড় উঠে আসবে কীভাবে? জাতীয় দলই–বা কীভাবে তৈরি হবে? এগুলো ভাবতে হবে।’
সার্কভুক্ত খেলোয়াড়দের দেশি কোটায় আনা উচিত নয়। এতে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের খেলার সুযোগ কমে যাবে। নতুন নিয়মটা কোনোভাবেই সমর্থন করি না।আলফাজ আহমেদ, কোচ, মোহামেডানতবে এর ইতিবাচক দিকও দেখছেন আবাহনী লিমিটেডের কোচ মারুফুল হক। তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টা নেতিবাচক হিসেবে দেখছি না। আটজন বিদেশি খেললে বাকি তিনজন হবে স্থানীয় এবং তারা মানসম্মত হবে। যারা সুযোগ পাবে না, তারা নিজেদের যোগ্যতা বাড়াবে। দুই–তিন মৌসুমের মধ্যে দেশে মানসম্মত খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে।’ মারুফুলের সংযোজন, ‘এই চ্যালেঞ্জ দেশি খেলোয়াড়দের সামনে থাকা উচিত। পাশাপাশি আমাদের খেলোয়াড়দের সার্কের অন্যান্য দেশে খেলতে পারার জন্য সব দেশের মধ্যে সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন।’
বাফুফের সদস্য ও সাবেক ফুটবলার সাইদ হাছান কানন মনে করেন, সার্কভুক্ত মানসম্মত খেলোয়াড় এলে সমস্যার কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘সার্ক দেশগুলোর খেলোয়াড় এলে আমাদের লিগের মান বাড়তে পারে। তবে সার্কের এক বা দুজন ঠিক আছে, পাঁচজন খেললে দেশের খেলোয়াড়দের সুযোগ কমবে, এটা ঠিক।’ কী কারণে বাফুফে এ নিয়ম করেছে? বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন চৌধুরীর ভাষ্য, ‘মূল লক্ষ্য হলো সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে খেলোয়াড় আদান-প্রদান ও প্রতিযোগিতা বাড়ানো। আমাদের পর ভারতও এই নিয়ম করেছে। তবে ভালো ফল না এলে নিয়মটা বদলের সুযোগও আছে।’
বিষয়টি এখনো পরীক্ষামূলক, ১৯ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়ার লিগ মাঠে গড়ালে সার্কভুক্ত ফুটবলারদের ‘দেশি’ হিসেবে পারফরম্যান্স বিচার করা যাবে। তখনই নিয়মটির কার্যকারিতা ও প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে।