এসএমএ রোগীর বাবা জানালেন বেদনার গল্প ও সচেতনতার আহ্বান
Published: 17th, August 2025 GMT
আগস্ট মাসে স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) সচেতনতা বাড়ানোর বিশেষ প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন মো. ওমর ফারুক। তিনি নিজেও এসএমএ আক্রান্ত শিশুর বাবা ও কিউর এসএমএ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক।
নিজের পরিবারের কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা তুলে তিনি বলেন, চলছে আগস্ট মাস। এই মাস আমাদের জন্য শুধু একটি ক্যালেন্ডারের মাস নয়, এটি স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের অসহায়ত্ব। সন্তানের দুর্বলতা আমাদের চোখের সামনে বাড়তে দেখছি। আমার হাঁটতে পারা ছেলেটাও আর দাঁড়াতে পারছে না। এমনকি হাত দিয়ে পেন্সিল ধরে লেখার ক্ষমতাটুকুও হারাতে চলেছে।
আমি একজন বাবা হিসেবে এবং কিউর এসএমএ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের একজন সদস্য হিসেবে জানি, এসএমএ আক্রান্ত শিশুর মা-বাবা নিরবে কী কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন।
এসএমএ একটি জেনেটিক রোগ, যা শিশুর পেশি নিয়ন্ত্রণকারী নার্ভ কোষগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে হাঁটা, বসা, এমনকি শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে এখনও এই রোগ সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন সচেতন।
আমার পরিবারের এসএমএর সাথে পথচলা শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে এক অজানা আতঙ্কে। আমার প্রথম সন্তান ফাইয়াদ বিন ওমরের শারীরিক দুর্বলতা দেখে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু রোগ নির্ণয়েই অনেক সময় লেগে যায়। সময় তখনই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান, আর সেটাই আমরা হারিয়েছি—কারণ সচেতনতা ছিল না, ছিল না প্রাথমিক স্ক্রিনিং বা যথাযথ নির্দেশনা।
ওর বয়স এখন ৭ বছর ৯ মাস। আমার ছেলেটা ভালো ছবি আঁকতে পারত। ওর মেধা এতো ভালো। কিন্তু ওকে স্কুলে আনা নেওয়াটা এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। অবকাঠামোগত সমস্যাসহ নানা চ্যালেঞ্জ। আমার সাড়ে ৬ বছরের ছোট ছেলে ফাইজান বিন ওমরও এসএমএ টাইপ-২ তে আক্রান্ত।
মানুষ স্বপ্ন দেখে ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমাদের স্বপ্ন ছিল, আমার ছোট ছেলেটা আর্মি অফিসার হবে। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সাথে বেঈমানি করেছে। আমার দুইটা ছেলেই হাঁটতে পারে না। কোথাও ঘুরতে গেলে আমার দুই পা হয়ে ওঠে ওদের পা। আমার ছোট ছেলে যখন বলে—বাবা আমি হাঁটতে চাই, তখন ভেতরটা কেমন লাগে সেটা বোঝাতে পারবো না। এখন স্বপ্ন দেখি, আমার বাচ্চারাসহ দেশে এসএমএ আক্রান্ত সব শিশু ওষুধ পাবে। কম খরচে দেশে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা হবে।
বর্তমানে দেশে অসংখ্য পরিবার ঠিক এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা জানেই না তাদের সন্তানের রোগ কী, কীভাবে চিকিৎসা করা যায় বা কোথায় সাহায্য পাওয়া যাবে।
বিশ্বের অনেক দেশে এখন এই রোগের চিকিৎসা রয়েছে, যা সময়মতো দেওয়া গেলে রোগীর জীবনের মান অনেক উন্নত করা সম্ভব। কিন্তু এই চিকিৎসা এখনও অনেক ব্যয়বহুল এবং আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এই কারণেই সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা বাড়লে জন্মের পরপরই রোগ শনাক্ত করা যাবে। সরকারের সহায়তা, স্বাস্থ্য বিমা, এবং সবার জন্য সমান চিকিৎসা নিশ্চয়তা আনা সম্ভব হবে।
কিউর এসএমএ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে—সচেতনতা ছড়ানো, পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া এবং সরকারের সাথে নীতিগত আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।
একজন বাবা হিসেবে আমার স্বপ্ন, একদিন বাংলাদেশে কোনো সন্তান এসএমএ-তে আক্রান্ত হবে না বা আক্রান্ত হলেও তারা সময়মতো চিকিৎসা পাবে, এবং কোনো বাবা-মাকে অসহায়ের মতো চিকিৎসার অভাবে তার শিশুর মারা যাওয়া দেখতে হবে না।
এই আগস্ট মাসে এসএমএ সচেতনতার মাসে আমি সকল পাঠককে অনুরোধ করব—এসএমএ সম্পর্কে জানুন, জানুন কীভাবে এটি প্রতিরোধ ও চিকিৎসা করা যায়। আমাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলান। কারণ সচেতনতার মাধ্যমে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
আমরা যদি একসাথে এগিয়ে আসি, তবে এসএমএ আর নিরব কোনো যুদ্ধ থাকবে না। এসএমএ-র সাথে লড়াইয়ে আমাদের পাশে থাকুন।
লেখক: মো.
ঢাকা/হাসান/ইভা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সন ত ন পর ব র আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
সংবেদনশীল না হলে কেউ ভালো শিল্পী হতে পারে না: জুয়েল আইচ
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পডকাস্ট শো ‘লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় একাদশতম পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। আলোচনার বিষয় ছিল ‘শিল্প, মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবতার সংমিশ্রণে গঠিত এক অনন্য লিগ্যাসি’।
‘মানুষ তার আশার সমান সুন্দর, বিশ্বাসের সমান বড় এবং কাজের সমান সফল। কাজই মুক্তি। তবে আশাও বড় রাখতে হবে। আশা না থাকলে কাজ হবে না।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে কথাগুলো বলেন জুয়েল আইচ। পডকাস্ট শোর এ পর্ব প্রচারিত হয় গতকাল শনিবার প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে।
পডকাস্টের শুরুতেই সঞ্চালক জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীশিবিরে প্রথম যেদিন জাদু দেখালেন, সেই অনুভূতি কেমন ছিল?
উত্তরে জুয়েল আইচ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সব বাদ দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিই। আমরাই খুব সম্ভবত প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করি। আমি শৈশব থেকেই জাদু দেখাই। তবে মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীশিবিরে জাদু দেখানোর সেই অনুভূতিটি ছিল একেবারেই ম্যাজিক্যাল।’
প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, শিল্পকে সাহস করে অস্ত্রতে পরিণত করার এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এল?
জুয়েল আইচ বলেন, ‘এটা আত্মবিশ্বাস নয়। আমি অসম্মান সহ্য করতে পারি না। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছিলাম, তারা (পাকিস্তান) আমাদের বিভিন্নভাবে অসম্মান করে আসছে। কখনো গানে, কখনো ছবি এঁকে কিংবা কবিতার ভাষায় আমরা সব সময় এর প্রতিবাদ করে এসেছি। এভাবে করেই শেষ পর্যন্ত আমরা মুক্তিযুদ্ধে নেমে গেলাম।’
জুয়েল আইচকে কেউ বলেন ম্যাজিশিয়ান, আবার কেউ বলেন মিউজিশিয়ান। তবে জুয়েল আইচ একজন দার্শনিকও বটে। জাদুর মোহনীয়তা আর বাস্তবতার যে রূঢ় চিত্র—এই দুটো আপনার জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে?
সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে জুয়েল আইচ বলেন, ‘বাস্তবতাকে আমরা বলে থাকি “কঠিন” আর স্বপ্ন তো আমরা আকাশসমান ভাবতে পারি। একদম রংধনুর মতো সাত রং। এই দুটোকে যদি কেউ আয়ত্ত না করতে পারে, তবে তার জীবন কিন্তু সেখানেই শেষ। সে বেঁচে থাকবে কিন্তু মরার মতো।’ তিনি বলেন, ‘সে জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দরকার। যেমন আপনি কোনোভাবেই আমাকে দুঃখী বানাতে পারবেন না। আমি দুঃখ পাই না, তবে বারবার আমাকে খ্যাপাতে থাকলে আমি রুখে দাঁড়াই।’
জুয়েল আইচ কখনোই পরিপূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া স্টেজে ওঠেন না। সঞ্চালক জানতে চান, এর পেছনে কারণ কী?
জুয়েল আইচ বলেন, প্রস্তুতি ছাড়া কোনো কাজ সুন্দরমতো হয় না। প্রস্তুতি ছাড়া যদি কেউ কিছু করে, তবে সেগুলো অনেক নিম্নমানের হবে। তিনি বলেন, ‘আমি একটি বাঁশি দিয়ে সব রাগ বাজাতে পারি। এটা কি এক দিনেই সম্ভব!’
আপনার পারফরম্যান্সের সময় আপনি মাঝেমধ্যে নিঃশব্দ হয়ে যান। যেখানে কোনো উদ্যম নেই। এই ‘সাইলেন্স’-এর কারণটা কী?
সঞ্চালক জানতে চাইলে জুয়েল আইচ বলেন, শব্দের চেয়ে নিঃশব্দের ভাষা বেশি গভীর। একটি পেইন্টিং, যেখানে কোনো শব্দ থাকে না কিন্তু কত কিছু বলে দেয়! দেখবেন কেউ অনেক খেপে গেলে নীরব হয়ে যায়। আসলে শব্দে যা বলা যায়, নিঃশব্দে তার চেয়ে বেশি প্রকাশ করা সম্ভব।
বর্তমানের এই ডিজিটাল যুগে সবকিছুই হাতের নাগালে, এমনকি জাদুও। জাদু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে আসার পর এর আবেদন কিছুটা কমে যাচ্ছে কি না? জানতে চাইলে জুয়েল আইচ বলেন, খালি চোখে দেখলে তা আসলেই কমে যাচ্ছে। কারণ, এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে যে জাদুগুলো দেখানো হচ্ছে, তা দেখে মানুষ বিস্মিত। তিনি বলেন, ‘তারা ভাবছে, আমরা আগে যেসব জাদু দেখেছি, এগুলো তো তার থেকেও বিস্ময়কর। কিন্তু তারা হয়তো বুঝতে পারছে না, এখন সবকিছুর সঙ্গে মিশে গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’
সঞ্চালক এরপর প্রশ্ন করেন, আপনি একসময় ‘পালস স্টপিং’ ধরনের ইলিউশন বন্ধ করেছিলেন। এর পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল?
জুয়েল আইচ বলেন, ‘এই পালস স্টপিংয়ের মাধ্যমে আমি পুরো দেশজুড়ে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলাম। দলে দলে মানুষ এটি দেখতে আসত। কিন্তু এসব দেখে মানুষ অনেক বেশি আতঙ্কিত হতো, অনেক মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ত। একবার একজন অনেক বড় পালোয়ান এটি দেখতে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। সেদিন শো শেষ করেই আমি আমার টিমকে বলি, এই ম্যাজিক আর হবে না। কারণ, এই ম্যাজিক এত এত মানুষকে ডেকে আনছে বটে কিন্তু এটি মাত্রা অতিক্রম করে ফেলছে। যা মোটেও ঠিক নয়।’
প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, তাহলে কি একজন শিল্পীকে সংবেদনশীলও হতে হয়?
‘অবশ্যই।’ জুয়েল আইচ বলেন, একজন শিল্পীকে অবশ্যই সংবেদনশীল হতে হবে। সংবেদনশীল না হলে তিনি ভালো শিল্পী হতে পারবেন না।
আপনি যেমন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের সামনে পারফর্ম করেছেন, তেমনি এমন শিশুদের জন্যও জাদু দেখিয়েছেন, যারা কখনো টিকিট কিনে শো দেখতে পারে না। আপনার চোখে আসল মর্যাদা কোথায়—বৃহৎ মঞ্চে, নাকি একটিমাত্র বিস্মিত মুখে?
সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে জুয়েল আইচ বলেন, ‘আসলে মঞ্চ ব্যাপার নয়। আমি আমার জাদুতে বিস্মিত এবং মুগ্ধ হয়ে থাকা দেখতে ভালোবাসি। শুধু বিস্ময় নয়, বিস্ময়ের সঙ্গে মুগ্ধতা আমার ভালো লাগে।’
আরও পড়ুননীতি আর মূল্যবোধ শক্ত থাকলে কেউ থামাতে পারবে না: রুবাবা দৌলা১২ অক্টোবর ২০২৫পডকাস্টের শেষ পর্যায়ে সঞ্চালক জানতে চান, আমরা আরেকজন জুয়েল আইচ কবে পাব?
মুচকি হেসে জুয়েল আইচ বলেন, ‘যখন সেই উদ্যম নিয়ে কেউ কাজ করবে, ঠিক তখন। সে হয়তো আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। শুধু ম্যাজিকে নয়, সব দিক দিয়েই।’
আরও পড়ুনবাবা প্রথমে আমাকে অফিস সহকারীর কাজ দিয়েছিলেন: হাতিলের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান০৫ অক্টোবর ২০২৫