জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অর্থ ব্যবস্থাপনার চাহিদা ভিন্ন। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত আমাদের আর্থিক বাস্তবতা, দায়বদ্ধতা ও আকাঙ্ক্ষা বদলায়।

বাংলাদেশে যেখানে অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগও বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনা ও অর্থ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি দিন দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনাকে একটি গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শিকড় গড়ে, ডালপালা ছড়িয়ে পূর্ণতা লাভ করে।

বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা যায়, তবে সারা জীবন আর্থিক নিরাপত্তা এবং মানসিক শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

চলমান বাস্তবতায় এটিকে সাতটি ধাপে ভাগ করে পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

আরও পড়ুনআর্থিক সাক্ষরতায় বাংলাদেশ কতদূর এগোল০৩ মার্চ ২০২৫প্রথম ধাপ (০-১৮ বছর): আর্থিক সাক্ষরতার ভিত্তি

জীবনের শুরুতেই আর্থিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলা থেকেই খরচ ও সঞ্চয়ের পার্থক্য শেখানো হলে দায়িত্বশীল প্রজন্ম গড়ে ওঠে।

বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের জন্য সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট চালু করেছে, যা আর্থিক সাক্ষরতার বীজ বপন করছে।

এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের সব শাখা ও উপশাখাকে অন্তত একটি করে স্কুলে আর্থিক সাক্ষরতা ও স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কার্যকর উদ্যোগ শিশুদের মধ্যে সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ দেখলে দেখা যায়, জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিশুদের পকেটমানি ব্যবস্থাপনা শেখানো হয়। খরচ, সঞ্চয়, চ্যারিটি ও বাজেট পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলো শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশেও স্কুল পর্যায়ে এমন উদ্যোগ বাধ্যতামূলক হলে শিশুরা অল্প বয়সেই অর্থের মূল্য বুঝতে শিখবে এবং ভবিষ্যতে আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুননাগরিকের ওপর আর্থিক চাপ আর কত১২ নভেম্বর ২০২৪দ্বিতীয় ধাপ (১৮-২৫ বছর): আর্থিক স্বাধীনতার শুরু

এই বয়সে তরুণেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কিংবা কর্মজীবনে প্রবেশ করে। তাই শুরু থেকেই সঠিক বাজেট পরিকল্পনা শেখা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বহুল আলোচিত ৫০/৩০/২০ ‘মানি ম্যানেজমেন্ট রুল’—যেখানে আয়ের ৫০ শতাংশ ব্যয় হয় প্রয়োজনীয়তায়, ৩০ শতাংশ ব্যয় হয় ইচ্ছাপূরণে এবং বাকি ২০ শতাংশ যায় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে—এটি তরুণদের আর্থিক শৃঙ্খলা গড়ে তোলার জন্য নিঃসন্দেহে সবচেয়ে কার্যকর একটি পদ্ধতি।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পার্টটাইম কাজের সুযোগ সীমিত, তবে ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ উদ্যোগ তরুণদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তরুণেরা পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে নিজেদের টিউশন ফি বহন করে। এতে আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি পায় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা তৈরি হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার ফ্রিল্যান্সারের অধিকাংশই তরুণ, যাঁরা অনলাইনে আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে কাজ করে আয় করছেন, যা দেশের বড় সম্পদ।

আরও পড়ুনআর্থিক ও সামাজিক বাধা দূর করতে হবে২৩ মে ২০২৪তৃতীয় ধাপ (২৫-৩৫ বছর): আর্থিক দায়িত্ব শুরু

এই বয়সে কর্মজীবনের স্থিতি আসে এবং পরিবার গঠনের চিন্তা শুরু হয়। প্রথম সন্তান, বাড়িভাড়া বা ফ্ল্যাট কেনা, জীবনবিমা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের তরুণেরা হোম লোন, গাড়ির লোন এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগও শুরু করেন।

সিঙ্গাপুরে সরকারিভাবে তরুণ দম্পতিরা হাউজিং স্কিম থেকে ভর্তুকি পান, ফলে স্বল্প বয়সেই ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সহজ শর্তে সরকারি-বেসরকারি হোম লোনের সুযোগ থাকলে এই বয়সে আর্থিক নিরাপত্তা অনেক বেড়ে যাবে।

আরও পড়ুনআর্থিক খাতে সংস্কার কখন ও কীভাবে১১ জানুয়ারি ২০২৪চতুর্থ ধাপ (৩৫-৪৫ বছর): আর্থিক স্থিতির যুগ

এ সময়ে আয় বাড়ে; কিন্তু খরচও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় সন্তান আসে, সন্তানের স্কুলে ভর্তি, অ্যাপার্টমেন্ট বা গাড়ি কেনা, উচ্চতর ডিগ্রি বা বিদেশে পড়াশোনার জন্য সঞ্চয় তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

এ সময়েই বিমা, স্বাস্থ্যসেবা ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে খুচরা পুঁজিবাজারে ৭০ শতাংশ বিনিয়োগকারীর বয়স ৪৫ বছরের নিচে।

সুতরাং পরিবারগুলো যদি সন্তানদের উচ্চশিক্ষা এবং নিজেদের বার্ধক্যের জন্য এই বয়সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তাহলে ভবিষ্যতের চাপ অনেকটাই কমবে।

যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইতালি, পোল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে এই বয়সের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিটায়ারমেন্ট পেনশন চালু হয়। এ ছাড়া  ইউরোপের কিছু কিছু দেশে স্থানীয় নাগরিকদের জন‍্য বিনা মূল্যে বা স্বল্প খরচে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাওয়া যায়, যা পরিবারগুলোর আর্থিক চাপ কমায়।

পঞ্চম ধাপ (৪৫-৫৫ বছর): ভবিষ্যতের প্রস্তুতি

ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশেষ করে ক্যারিয়ারের শীর্ষে পৌঁছানোর পাশাপাশি এই বয়সে ঋণ পরিশোধ, সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ এবং অবসর তহবিল গঠন করা জরুরি। স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিয়মিত অভ্যাসও অপরিহার্য।

অস্ট্রেলিয়ায় ‘সুপারঅ্যানুয়েশন’ বাধ্যতামূলক, যেখানে কর্মজীবনের একটি অংশ সরাসরি অবসর তহবিলে জমা হয়। বাংলাদেশেও এমন বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ব্যবস্থা চালু হলে এই বয়সে আর্থিক নিরাপত্তা বাড়বে।

অবসরজীবনে শান্তি উপভোগ, সম্পদ সংরক্ষণ, উত্তরাধিকার নির্ধারণ এবং উইল বা ট্রাস্ট হালনাগাদ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাতি-নাতনিদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানো, সমাজসেবা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনাও প্রয়োজন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে অবসরপ্রাপ্তরা সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং উত্তরাধিকার পরিকল্পনার নিশ্চয়তা পান। বাংলাদেশেও প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করা উচিত।ষষ্ঠ ধাপ (৫৫-৬৫ বছর): অবসরের প্রস্তুতি

অবসরের জন্য মানসিক ও আর্থিক প্রস্তুতি মূল লক্ষ্য। এ সময় প্যাসিভ ইনকাম যেমন ভাড়া, লভ্যাংশ ও সঞ্চয় স্কিম তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া অবসর-পরবর্তী স্বাস্থ্যবিমা এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ অপরিহার্য।

জার্মানির পেনশন সিস্টেম তিন স্তরে সাজানো, যা নিশ্চিত করে যে অবসরের পরও মানুষ আর্থিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। বাংলাদেশেও জাতীয় পেনশন স্কিম আরও সম্প্রসারণ ও বিশ্বস্তকরণ জরুরি।

সপ্তম ধাপ (৬৫ বছরের পর): প্রশান্তির অবসর

অবসরজীবনে শান্তি উপভোগ, সম্পদ সংরক্ষণ, উত্তরাধিকার নির্ধারণ এবং উইল বা ট্রাস্ট হালনাগাদ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাতি-নাতনিদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানো, সমাজসেবা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনাও প্রয়োজন।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে অবসরপ্রাপ্তরা সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং উত্তরাধিকার পরিকল্পনার নিশ্চয়তা পান। বাংলাদেশেও প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করা উচিত।

পরিশেষে, জীবনের প্রতিটি ধাপে আর্থিক পরিকল্পনার ধরন আলাদা। বাংলাদেশে এখনো ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনা অনেকাংশে অবহেলিত; কিন্তু বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সচেতনভাবে পরিকল্পনা করলে সারা জীবন আর্থিক নিরাপত্তা এবং মানসিক শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা কেবল ব্যক্তির জীবনই বদলাবে না; বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করবে।

এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার, উন্নয়ন–গবেষক ও লেখক
ই-মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র জন য র জন য স র আর থ ক ব স তবত এই বয়স জ বন র সন ত ন

এছাড়াও পড়ুন:

তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।

সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’

বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’

শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ

অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।

দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’

রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’

এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’

মামলার পূর্বাপর

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।

রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।

পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আপিল বিভাগের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করলেন নেপালের প্রধান বিচারপতি
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
  • বিশ্ব শিক্ষক দিবস: রাবিতে ৩ অধ্যাপককে সম্মাননা
  • টি-টোয়েন্টি থেকে উইলিয়ামসনের অবসরের ঘোষণা
  • ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানলেন মুজিবুর রহমান