আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা: ঝুঁকির দিকগুলো কী
Published: 15th, May 2025 GMT
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসে। জনগণের মধ্যে ব্যাপক আশা ছিল যে তারা বিএনপির চেয়ে ভালো একটি গণতান্ত্রিক বিকল্প হিসেবে কাজ করবে; বিএনপি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তবে সেই আশা শিগগিরই নিরাশায় পরিণত হয়।
নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, স্বাধীন চিন্তা দমন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিকীকরণ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দ্রুত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। পূর্ববর্তী সরকারগুলোও এ ধরনের অসদাচরণের বাইরে ছিল না। তবে আওয়ামী লীগের অধীনে এর মাত্রা ও তীব্রতা ছিল অভূতপূর্ব, যা একে স্বৈরাচারী শাসন হিসেবে চিহ্নিত করার ভিত্তি তৈরি করে। শাসক দল কিছু বিশেষভাবে উদ্বেগজনক আচরণও প্রতিষ্ঠা করে।
এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, জোর করে তুলে নেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মহিমান্বিত করা। তবে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনকে বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি চরম সংস্করণ হিসেবেই চিহ্নিত করা সম্ভব।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের নেই অনুশোচনা, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভরসা১১ নভেম্বর ২০২৪১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে দেয়। ছাত্রদের নেতৃত্বে সংগঠিত প্রতিবাদকে সরকার নির্মমভাবে দমন করতে থাকে। আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, এই সময়ে প্রায় ১ হাজার মানুষ নিহত হন। জাতিসংঘের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সরাসরি এই কঠোর দমন-পীড়নকে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপরের স্তরের নির্দেশনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুলি করে হত্যা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নিষ্ঠুরতা কখনোই দেখা যায়নি। এটাকে পূর্ববর্তী কোনো সরকারের বা দলের কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। ৫ আগস্টে যখন সেনাবাহিনী প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন দ্রুত সরকারের পতন ঘটে। এই পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ বিষয়ে অবস্থান কী হওয়া উচিত, তা এক জরুরি জাতীয় প্রশ্ন হয়ে ওঠে। বিশেষত দলটিকে কি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন কি না, সে প্রশ্ন দেখা দেয়।
এ ব্যাপারে খুব একটা সংশয় নেই যে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের সময় অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এর মাত্রা এতখানি যে তা সংজ্ঞা অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে। যাঁদের বিরুদ্ধে এসব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা অনেকেই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও দলীয় নেতৃত্বের অংশ। বলা বাহুল্য, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত এবং প্রমাণ মিললে বিচার ও দণ্ড নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে যে খোদ দলটির ব্যাপারে কী করা হবে। একে কি বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে? তারা কি জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবে, বিশেষ করে সামনের জাতীয় নির্বাচনে?
ঢাকার কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অংশের উদ্যোগে এবং ইসলামপন্থী দলগুলোর দৃঢ় সমর্থনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গত শনিবার ঘোষণা করে যে উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে।
গত সোমবার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি সংশোধনী আনে সরকার। আইনে সংশোধন এনে ‘দলের সব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ’ বলার অর্থ কী, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখন থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে বা সমর্থনে কোনো প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করা নিষিদ্ধ; একইভাবে গণমাধ্যম, অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে দলের সমর্থনে কোনো ধরনের প্রচারণা চালানো যাবে না। এমনকি মিছিল, সভা, সংবাদ সম্মেলন আয়োজন বা জনসমক্ষে বক্তব্য দেওয়াও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
মূল প্রশ্নগুলোর একটি হলো বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সম্মিলিতভাবে দায়ী করা কি ন্যায্য হবে? যাঁরা দলটিকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে, তাঁরা যুক্তি দেন যে দল ও সরকার আলাদা—এই ধারণা অবাস্তব। তাঁদের মতে, দলের সাংগঠনিক কাঠামো ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো ওতপ্রোতভাবে রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় জড়িত ছিল।
আদতে এই দুটি সত্তাকে আলাদা করে দেখা সত্যিই কঠিন। ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় নেতা-কর্মীরা, কেউ কেউ অস্ত্রসহ নিরাপত্তা বাহিনীর পাশে থেকে ওই সহিংসতায় অংশ নিয়েছে। তবে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড সম্ভবত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে এবং এগুলোর নির্দেশ এসেছে কিছু উচ্চপর্যায়ের নেতার কাছ থেকে।
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদনেও আওয়ামী লীগকে সরাসরি দল হিসেবে দায়ী করা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, শুধু দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে যারা যারা এই দমন-পীড়ন সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে, তারা দায়ী। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে, দল হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ এই রক্তপাতের কতটা অংশীদার? শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে প্রমাণের ওপর, যা একমাত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নির্ধারিত হতে পারে।
আরও পড়ুনহাসিনার পতনে গ্রামেগঞ্জে প্রভাব ও আওয়ামী কর্মীদের ভাবনা কী১০ এপ্রিল ২০২৫জুলাই-আগস্টের ঘটনার পর দলটির আচরণ কেমন, সে বিবেচনাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দমন-পীড়নের পর দলটির কোনো জ্যেষ্ঠ নেতা দলের পক্ষ থেকে বা সরকারের হয়ে এর দায়িত্ব স্বীকার করেননি কিংবা কোনো ধরনের ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশও করেননি। দলটি এখনো তার পুরোনো নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণেই আছে। তারা জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। আত্মসমালোচনার বা সংস্কারের কোনো অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেনি।
শেখ হাসিনা এখনো দলের প্রতীক ও নেতা হিসেবে বিদেশে অবস্থান করে দেশে ঝামেলা সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছেন; হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে যুক্ত আছে আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্টদের অনলাইন কার্যক্রম। দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জুলাই-আগস্টের ঘটনা নিয়ে ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে; একই সঙ্গে তারা ভুয়া খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়েও।
আওয়ামী লীগের এখনো উদ্ধত, সংস্কারহীন ও অনুশোচনাহীন মনোভাব। একই সঙ্গে যৌক্তিক ধারণা করা যেতে পারে তারা দেশকে অস্থিতিশীলও করে তোলায় সচেষ্ট। এসব বিষয় দলের কার্যক্রম স্থগিত রাখার পক্ষে যুক্তিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে মূল যে যুক্তিগুলো রয়েছে, তার সারাংশ হলো আওয়ামী লীগ সরাসরি হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছে এবং পরে তার কোনো জবাবদিহি করেনি; ফলে দলটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার হারিয়েছে। কিন্তু এরপরও দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বড় ধরনের কিছু ঝুঁকি রয়েছে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো সবচেয়ে বেশি এসেছে, তার একটি হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে অস্বীকার করা। এটা অবশ্যই সত্য। অথচ এখন সংস্কারমুখী হিসেবে পরিচিত অন্তর্বর্তী সরকার সেই একই ভুল করতে যাচ্ছে, লাখ লাখ নাগরিকের জন্য কোনো অর্থবহ রাজনৈতিক বিকল্পহীন একটি জাতীয় নির্বাচনের পথে অগ্রসর হয়ে।প্রথমত, এটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। এর শিকড় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রোথিত। তাদের রয়েছে এক বিশাল জনসমর্থনের ভিত্তি। তাদের অনেকেরই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। নানা কারণে এই দলটিকে অনেকে সমর্থন করে। কেউ করে দলটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানের কারণে, কেউ ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে অবস্থানের কারণে, কেউ উন্নয়নমূলক কাজ অথবা শুধু তার ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণে।
নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে এই লাখ লাখ সমর্থক বস্তুত তাদের রাজনৈতিক অধিকার হারাবে। আওয়ামী লীগের পক্ষে যেকোনো মতপ্রকাশ—মৌখিক, লিখিত বা অনলাইনে শেয়ার করাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। দলটির সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ জমায়েত, এমনকি সামাজিক বা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এতে ভয়ের এক পরিবেশ তৈরি হবে, যেখানে নজরদারি, হয়রানি ও ইচ্ছামতো গ্রেপ্তারের আশঙ্কা থাকবে আর মতপ্রকাশ ও সমাবেশের অধিকার সংকুচিত হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও এতে বড় ধাক্কা খাবে। কারণ, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোকে আওয়ামী লীগ–সম্পর্কিত যেকোনো কিছু প্রকাশে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে।
এই নিষেধাজ্ঞা আসলে একটি নতুন দমনপ্রক্রিয়ার সূচনা ঘটাতে পারে—এমন ঝুঁকির আশঙ্কা অমূলক না। আওয়ামী লীগ নিজেই তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে দমনের এ ধরনের কৌশল প্রয়োগ করেছিল। বিরোধী দলকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিত তারা। কিন্তু সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার পদ্ধতি এবার আইনি কাঠামোর মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হলো। কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থক হলে, ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বা যেকোনো অভিযোগে তার গ্রেপ্তারের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এখন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার ফলে এ ধরনের গ্রেপ্তার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও ঝুঁকিতে পড়বে।
তার ওপর একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তিকে পুরোপুরি বাইরে রাখার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিপুলসংখ্যক ভোটারকে কার্যত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করবে। অধিকাংশ আওয়ামী লীগ সমর্থক অন্য কোনো দলকে সমর্থন করবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম; বরং তারা হয়তো শ্রেফ ভোট দিতেই আগ্রহ হারাবে। এর ফলে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী আবারও এমন এক নির্বাচনের মুখোমুখি হবে, যেখানে তাদের সমর্থিত দল ব্যালটে অনুপস্থিত থাকবে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো সবচেয়ে বেশি এসেছে, তার একটি হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে অস্বীকার করা। এটা অবশ্যই সত্য। অথচ এখন সংস্কারমুখী হিসেবে পরিচিত অন্তর্বর্তী সরকার সেই একই ভুল করতে যাচ্ছে, লাখ লাখ নাগরিকের জন্য কোনো অর্থবহ রাজনৈতিক বিকল্পহীন একটি জাতীয় নির্বাচনের পথে অগ্রসর হয়ে।
তাহলে এই লাখ লাখ মানুষ, যাঁদের এখন রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, তাঁরা কোথায় যাবেন? নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এক বিশ্লেষক যেমন বলেছিলেন, ‘বাদ দেওয়া থেকে ক্ষোভ জন্মায়, তা শান্তিপূর্ণ রূপান্তরকে অকার্যকর করে তোলে এবং প্রায়ই নতুন অস্থিতিশীলতার চক্রকে উসকে দেয়।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা মানে একটি ইতিমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত গণতন্ত্রকে প্রতিশোধমূলক ও একপক্ষীয় ব্যবস্থায় রূপান্তর করা, যেখানে অপরাধীরাও শহীদে পরিণত হতে পারে এবং একটি বিভক্ত সমাজ আরও গভীরভাবে মেরূকৃত হয়ে উঠতে পারে।’ এটাই এই নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি।
সমানভাবে উদ্বেগজনক হলো নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার যে প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছে। মনে হচ্ছে সরকার উচ্চকণ্ঠ একদল বিক্ষোভকারীর চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এদের দাবিগুলো ছিল কঠোর ও অনমনীয়। অথচ বৃহত্তর পরিণতির বিষয়ে তেমন কোনো ভাবনা এই প্রক্রিয়ায় পরিলক্ষিত হয়নি।
গত শনিবার সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সরকারের উদ্দেশে বলেন, যদি আগামী এক ঘণ্টার মধ্যেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ঘোষণা না আসে, তাহলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া হবে। এর আগেই শাহবাগ এলাকাটি বিক্ষোভকারীরা দখল করে রেখেছিল। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়া হবে না এবং আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
এই বক্তব্যের ঠিক এক ঘণ্টা পর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে বসে এবং নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই আইন উপদেষ্টা সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা দেন যে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলো। অথচ এর আগের দিনই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সরকারের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যাটি ছিল দুর্বল এবং তা তড়িঘড়ি করে তৈরি করা বলে মনে হয়েছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্বেগই যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তব। কিন্তু এত কঠোর পদক্ষেপ না নিয়েও এসব মোকাবিলা করা যেত। সেসব পদক্ষেপ আইনি ও গণতান্ত্রিকভাবে আরও অনেক বেশি সমর্থনযোগ্য করারও উপায় ছিল।
নৈতিক দায়বদ্ধতাই যদি একমাত্র বিবেচ্য মানদণ্ড হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের যথার্থতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই থাকত না। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এর চেয়ে অনেক বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে, যেখানে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্থিতিশীলতার ওপর এর প্রভাবকে বিবেচনায় নিতে হয়। এসব দিক বিচার করলে দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঝুঁকি এর সম্ভাব্য উপকারিতার তুলনায় বেশি।
কিন্তু আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। এখন এর ফলাফল দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ডেভিড বার্গম্যান সাংবাদিক। বহু বছর ধরে আইসিটির বিচার কার্যক্রম ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখছেন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ষ দ ধ কর র গণত ন ত র ক র জন ত ক ব স ব ক র কর চ হ ন ত কর র র জন ত ক স ব ধ নত উপদ ষ ট আগস ট র অবস থ ন র সমর থ সরক র র দল র স র জন য র একট ধরন র র ওপর অপর ধ দলট র সবচ য় আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘ব্যবহারিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের’ ঘোষণা চীনের
রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘ব্যবহারিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের’ ঘোষণা দিয়েছে চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সাম্প্রতিক মস্কো সফরের পর আজ বৃহস্পতিবার এ ঘোষণা দিয়েছে বেইজিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয় দিবসের বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজে অংশ নিতে গত সপ্তাহে মস্কোয় গিয়েছিলেন সি। সির মস্কো সফরের পরপরই এ ঘোষণা এল।
কয়েক বছর ধরে মস্কো-বেইজিংয়ের সম্পর্ক বাড়ছিল। ইউক্রেনে ২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়।
সির সাম্প্রতিক মস্কো সফর পশ্চিমারা ভালোভাবে নেয়নি। ইউক্রেনের মিত্রদেশগুলোর অভিযোগ, মস্কোকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুদ্ধ চালাতে সহায়তা দিচ্ছে বেইজিং।
পশ্চিমাদের এসব অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছে বেইজিং। তাদের দাবি, এই সংঘাতে তারা নিরপেক্ষ। ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সির মস্কো সফর নিয়ে আজ চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জিয়াং বিন নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। চীন কীভাবে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করবে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে জিয়াং বিন বলেন, ‘আমাদের সামরিক পর্যায়ের সম্পর্কটা “উচ্চপর্যায়ের”।’ চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটে পোস্ট করা এক উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।
চীনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত উল্লেখ করে জিয়াং বিন বলেন, ‘আমরা কৌশলগত পারস্পরিক আস্থা আরও গভীর করতে, কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার করতে এবং ব্যবহারিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ করতে কাজ করছি।’
জিয়াং বলেন, এসব উদ্যোগ ‘নতুন যুগে চীন-রাশিয়া সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারত্বের বিষয়বস্তুকে আরও সমৃদ্ধ করবে’।
এসব পদক্ষেপ ‘বিশ্বের কৌশলগত স্থিতিশীলতা রক্ষা ও জোরদারে’ সহায়তা করবে বলেও মন্তব্য করেন জিয়াং বিন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মস্কোয় দীর্ঘ বৈঠক শেষে সি চিন পিং বলেছিলেন, চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতার এই সময়ে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক ‘ইতিবাচক শক্তি’ নিয়ে হাজির হয়েছে।
জিয়াং বিন আরও বলেন, বেইজিং-মস্কো ‘প্রভাবশালীদের জুলুমের’ বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সরাসরি কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করলেও যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করেই সি এ কথা বলেছেন বলে ধারণা করা হয়।
তখন পুতিন নিজেও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সির সঙ্গে তাঁর ‘ঐতিহ্যগতভাবে উষ্ণ, বন্ধুসুলভ’ আলোচনা হয়েছে। তিনি সিকে ‘প্রিয় বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেন।