দেনমোহর নির্ধারণের সঠিক পদ্ধতি
Published: 20th, November 2025 GMT
দেনমোহর (মাহর) হলো বিবাহের একটি মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্যঅংশ। কোরআন ও সুন্নাহ–উভয় মাধ্যমেই এরবাধ্যতামূলকতা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এটি স্ত্রীকে সম্মানদেওয়ার প্রতীক, আর্থিক নিরাপত্তার একটি অধিকার এবংস্বামীর দায়িত্ববোধের বাস্তব প্রতিফলন। ইসলামে দেনমোহরকোনো মূল্যচাপ নয়; বরং পরস্পরের সম্মান, সম্মতি ওন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি ব্যবস্থা।
এই নিবন্ধে আমরা দেব—দেনমোহরের গুরুত্ব, নির্ধারণেরনীতি, বাস্তব পদ্ধতি এবং ইসলামি আইনগত ব্যাখ্যা।
দেনমোহর কী এবং কেন
দেনমোহর হলো স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত একটিআর্থিক অধিকার, যা বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রী অবিলম্বে পাওয়ারযোগ্য হন। কোরআনে বলা হয়েছে,“তোমরা নারীদের তাদেরমাহর স্বেচ্ছায় (সৎভাবে) প্রদান করো।” (সুরা নিসা, আয়াত: ৪)
নবীজি (স.
এটি স্পষ্ট যে দেনমোহর কোনো উপহার নয়; বরং একটিঅধিকার।
দেনমোহর নির্ধারণ কীভাবে করা উচিত
ইসলামে দেনমোহর নির্ধারণের কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই।নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য কিছু নীতি আছে,
ক. সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারণ: স্বামীর আর্থিক অবস্থাই এখানে মূল বিবেচ্য। কোরআনে বলা হয়েছ, “সামর্থ্যবান তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেবে, আর যাঁর সামর্থ্য কম তিনি তার অবস্থান অনুযায়ী দেবেন।” (সুরা তালাক, আয়াত: ৭)
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেছেন,“মাহরের মূলনীতি হলো, স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গত নির্ধারণ।” (ইলামে আল-মুআক্কিয়িন, ৩/১৩৫, দারুস সালাম, রিয়াদ, ২০০২)
খ. অযৌক্তিক ও অযথা বেশি নয়: অত্যধিক উচ্চ দেনমোহর নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নবীজি (স.) বলেছেন,“সর্বোত্তম মাহর সেই, যা সবচেয়ে সহজ।” (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭)
সামাজিক প্রতিযোগিতা বা মর্যাদা দেখানোর জন্য অতিরিক্ত দেনমোহর নির্ধারণ ইসলামি দৃষ্টিতে অনুচিত।
আরও পড়ুনবিয়ে করার জন্য স্ত্রীকে মোহর প্রদান করা ফরজ০২ আগস্ট ২০২৩গ. স্ত্রীর সম্মতি অপরিহার্য: দেনমোহর উভয় পক্ষেরসম্মতিতে নির্ধারিত হবে। স্ত্রীর অনিচ্ছা বা চাপ প্রয়োগ করাজায়েজ নয়।
ঘ. তাৎক্ষণিক ও মুলতুবি অংশ: দেনমোহর দুই ভাগে হতেপারে, ১. তাৎক্ষণিক (মুহর মু’আজ্জাল), ২. মুলতুবি বাপরবর্তী সময়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি (মুহর মুআখখার)।উভয়টাই শরীয়তে গ্রহণযোগ্য। ৩. বাংলাদেশসহ সমাজেদেনমোহর নির্ধারণের প্রচলিত পদ্ধতি
বাংলা উপমহাদেশে প্রথাগতভাবে তিন পদ্ধতিতে দেনমোহরনির্ধারণ দেখা যায়—
ক. স্বামীর আয়ের ভিত্তিতে: মাসিক আয়, সম্পদের পরিমাণ ও আর্থিক স্থিতি বিবেচনা করে যৌক্তিক পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এটি ইসলামের সবচেয়ে নিকটবর্তী পদ্ধতি।
খ. স্ত্রী পক্ষের পারিবারিক মর্যাদার ভিত্তিতে: এটিও বৈধ, যদি পরিমাণ অযৌক্তিক না হয়।
গ. উভয় পরিবারের পারস্পরিক আলোচনায়: এটিবাস্তবসম্মত ও প্রাধান্যযোগ্য।
কোনো ক্ষেত্রেই আদালত বা কাজীর রেজিস্ট্রি বইতেঅস্বাভাবিক কম অর্থ (যেমন ১০১ টাকা) লেখা শরীয়তেরউদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
দেনমোহরের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সীমা
হানাফি মাজহাবে সর্বনিম্ন দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছিলদশ দিরহাম। তবে অধিকাংশ সমসাময়িক আলেম বলেন, “এটি নির্দিষ্ট নূন্যতম পরিমাণ নয়; বরং সময়ের সামাজিকমানদণ্ড অনুযায়ী।” (মুফতি তাকী উসমানী, ফিকহুল বুয়ূ, মাকতাবা মাআরিফুল কোরআন, করাচি, ২০১০)
সর্বোচ্চ সীমা নেই; তবে অতি উচ্চ মাহর নিরুৎসাহিত।
দেনমোহর কত হলে ভালো
১. স্বামীর ছয় মাস থেকে এক বছরের আয়ের মধ্যকার পরিমাণঅধিকাংশ ফকিহের মতে যৌক্তিক।
২. স্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এমন পরিমাণ হওয়াউত্তম।
৩. অতি সামান্য অর্থ (যেমন ৫০০ টাকা) সমাজ বাস্তবতারসঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ইসলামের উদ্দেশ্যের বিপরীত।
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, “মাহরের মূল লক্ষ্য নিরাপত্তা, সম্মান ও স্থিতি।” (আল-উম্ম, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩৫, দারুলমাআরিফ, কায়রো, ১৯৯০)
আরও পড়ুনআবু তালহার ইসলাম গ্রহণ২৫ মার্চ ২০২৫দেনমোহর প্রদান না করলে কী হবে
১. স্ত্রীর অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।
২. স্ত্রী প্রয়োজন হলে আদালতে দাবি করতে পারবেন।(ফিকহুল ইসলামি, খণ্ড ৫, পৃপৃ. ৩৩৭)।
৩. মৃত্যু বা তালাকের সময় সম্পূর্ণ দেনমোহর আদায় করতেহবে।
নবীজি (স.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি কারো অধিকার আদায়েরসামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিলম্ব করে, সে জুলুম করল।”(সহিহবুখারি, হাদিস: ২৪০০)
দেনমোহরের সামাজিক তাৎপর্য
১. স্ত্রীকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেয়।
২. স্বামীকে দায়িত্বশীল করে।
৩. বিবাহ প্রতিষ্ঠানকে সম্মানজনক রাখে।
৪. বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
৫. সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
ড. ওয়াহবা যুহাইলি লিখেছেন,“মাহর হচ্ছে ইসলামে নারীমর্যাদা প্রতিষ্ঠার অন্যতম সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থা।”(ফিকহুল ইসলামি ওয় আদিল্লাতুহু, খণ্ড ৭, পৃ. ৪৬১, দারুলফিকর, দামাস্কাস, ১৯৯৭)
দেনমোহর কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা প্রদর্শন নয়। এটি স্ত্রীকেসম্মান জানানোর ও নিরাপত্তা প্রদানের ইসলামি নীতি।সামর্থ্য অনুযায়ী, সম্মতি নিয়ে, যৌক্তিকভাবে এবংদায়িত্ববোধের সঙ্গে নির্ধারণ করাই সর্বোত্তম পদ্ধতি। ইসলামেরউদ্দেশ্য হলো, বিবাহকে সুখ, নিরাপত্তা ও মানবিকতারভিত্তিতে স্থাপন করা। দেনমোহর সেই ভিত্তির একটিঅপরিহার্য স্তম্ভ।
আরও পড়ুনইসলামে বিয়ে ও পরিবার গঠনের উদ্দেশ্য০৮ নভেম্বর ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ম ণ আর থ ক ইসল ম ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
লাল মুনিয়ার খোঁজে
শরৎ–হেমন্তসহ সারা বছরই প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখা যায় ঢাকার আফতাবনগরে। এখানে রয়েছে ঘাসবনের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা ডানাযুক্ত কিছু খুদে প্রাণ। তার মধ্যে মুনিয়া পাখি অন্যতম। বাংলাদেশে পাওয়া ছয় প্রজাতির মুনিয়া পাখি ঢাকার আফতাবনগরের ঘাসবনে দেখা যায়। তবে এই ছয় প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সংখ্যায় কম পাওয়া প্রজাতিটি হলো ‘লাল মুনিয়া’।
আমাদের গবেষণাকাজের অংশ হিসেবে আফতাবনগরে ঘাসবনের পাখি জরিপ করার সময় মুনিয়া পাখির দেখা পাই। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সাদা কাশফুলের ওপর যেন লাল আলতার ফোঁটা। এদের কোথাও কোথাও ‘আলতা মুনিয়া’ নামেও ডাকা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় Red Avadavat অথবা Strawberry Finch এবং বৈজ্ঞানিক নাম Amandava amandava। বাংলাদেশের চরাঞ্চল, নদীনালা, খালবিলের আশপাশের কিছু কিছু ঘাসবনে এদের পাওয়া যায়। তবে সংখ্যায় বেশ কম এবং সাধারণত এ দেশে কমই দেখা যায়।
এদের পুরুষ ও স্ত্রী পাখির দেহের রং আর ধরন আলাদা হয়ে থাকে। পুরুষের দেহ লাল, চোখ, ঠোঁট লাল এবং লাল দেহে সাদা তিল রয়েছে। স্ত্রীর দেহ, মাথা, পিঠ বাদামি এবং ডানা কালচে। স্ত্রী পাখিদের ঠোঁট, চোখ এবং কোমর লাল হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুম যত এগিয়ে আসে, পুরুষের দেহ তত বেশি লাল হতে থাকে।
এরা বীজভোজী পাখি। প্রধান খাদ্য হলো ঘাসের বীজ, আগাছা আর ফসলের বীজ। তা ছাড়া প্রজনন মৌসুমে এরা ছোট ছোট পোকামাকড় এবং জলাভূমিতে জমে থাকা শৈবাল খেয়ে থাকে। অন্যদিকে এরা প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, আকারে ছোট হওয়ায় এরা শিকারি পাখিদের অন্যতম খাদ্য। এভাবে এরা প্রকৃতিতে বীজ বিস্তারকারী, পোকা নিয়ন্ত্রক, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য এবং পরিবেশের স্বাস্থ্যের সূচক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
মুনিয়া বাংলাদেশের আবাসিক পাখি। সাধারণত বর্ষা বা বর্ষার পরপরই এরা প্রজনন করে থাকে। পুরুষ পাখিরা প্রজনন মৌসুমে উজ্জ্বল লাল রঙের তলদেশ, সাদা বিন্দু ও আকর্ষণীয় ঠোঁটের রং প্রদর্শন করে। পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকর্ষণ করতে গান গায়, ডানা ঝাঁকুনি ও লেজের নড়াচড়া করে। গান ও প্রদর্শনী স্ত্রী পাখিকে আকর্ষণ এবং নিজেদের এলাকা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এরা ঘন ঘাসভূমি, কৃষিভূমি বা ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকা পছন্দ করে, যেখানে এদের বাসা গোপন ও সুরক্ষা থাকে। এরা গম্বুজাকার বা গোলাকার বাসা তৈরি করে, যার পাশে ছোট একটি প্রবেশপথ থাকে। বাসা সাধারণত ঘন ঘাস বা কাঁটাযুক্ত ঝোপের মধ্যে লুকানো অবস্থায় থাকে। বাসা নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ সাধারণত ঘাস, সূক্ষ্ম ডাঁটা, পালক ও নরম উদ্ভিজ্জ তন্তু। বাসা সাধারণত মাটির ওপরে কয়েক সেন্টিমিটার থেকে প্রায় এক–দুই মিটার উচ্চতায় থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, অবৈজ্ঞানিক বসতি বিস্তার ও বনায়নহীন উন্নয়নের কারণে দ্রুত নষ্ট হচ্ছে এদের আবাসস্থল। এরা উজ্জ্বল লাল রঙের কারণে পোষা পাখি হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয়। ফলে এদের জীবন্ত সংগ্রহ ও অবৈধ শিকার অনেক জায়গায় চলছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এরা পোষা পাখি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ আইইউসিএন ২০১৫–এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এরা ঝুঁকিমুক্ত ক্যাটাগরিভুক্ত হলেও দিন দিন এদের সংখ্যা কমে আসছে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ ঢাকার আফতাবনগর। একসময় পাখি আলোকচিত্রীরা এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে এই পাখি দেখতে পেতেন। কিন্তু এখন আর সেই ঝাঁক দেখা যায় না, কিছুসংখ্যক টিকে আছে; তবে যেভাবে নির্বিচার বাসস্থান ধ্বংস আর নগরায়ণ হচ্ছে, তাতে বেশি দিন হয়তো এখানে এদের দেখা যাবে না।
শুধু মুনিয়া নয়, অন্যান্য আবাসিক পাখিসহ নানান পরিযায়ী পাখি এখানে আসে খাবারের সন্ধানে। এ জন্য পাখি আলোকচিত্রীদের কাছে এই জায়গা বেশ জনপ্রিয়। ঢাকার মধ্যে এই সুন্দর জীববৈচিত্র্যপূর্ণ আবাসস্থল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা না গেলে প্রকৃতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।
মোহাম্মদ ফিরোজ জামান: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উজ্জল দাস: শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়