সরকারি প্রতিষ্ঠানটি কি অবহেলায় ধ্বংস হবে
Published: 20th, November 2025 GMT
খামার ব্যবসায় এখন আগ্রহী হচ্ছেন অনেক তরুণ উদ্যোক্তা। তাঁদের সাফল্যে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে সরকারি মুরগি প্রজনন খামার। কিন্তু রাজবাড়ীতে এমন একটি প্রতিষ্ঠান অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় তিন একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ীর সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার একসময় এ অঞ্চলের ডিম, মাংস উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। অথচ এখন তা জরাজীর্ণ অবকাঠামো, জনবলসংকট ও আমলাতান্ত্রিক উদাসীনতায় কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ১৪ জনের জায়গায় কাজ করেন মাত্র ৫ জন। এ অবস্থায় কোনো সরকারি স্থাপনা টিকে থাকতে পারে না। দুঃখজনক হলো, এই বিপর্যয়ের দায় কেউ নিচ্ছে না, বরং বছরের পর বছর সমস্যা দেখেও চোখ বন্ধ করে আছে কর্তৃপক্ষ।
১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে বন্ধ হয়েছে হ্যাচারি সেবা। এর পর থেকে খামারটি শুধু নামেই ‘প্রজনন’ খামার। কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, জেনারেটর, পানির পাম্প থেকে শুরু করে গাড়ি—সবকিছু অব্যবস্থাপনায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে। শেডগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম, কর্মচারীদের আবাসিক ভবন বসবাসের অনুপযোগী, পানির ট্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি পরিত্যক্ত ঘরগুলো এখন মাদকসেবীদের আড্ডাস্থল।
এদিকে বাজারের তুলনায় কম দামে মুরগির বাচ্চা পাওয়ায় সাধারণ মানুষ এখানে ভিড় করেন। কিন্তু খামারের উৎপাদন সামান্য হওয়ায় অধিকাংশই খালি হাতে ফিরে যান। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও নিয়মিত বাচ্চা সরবরাহ নিশ্চিত না করলে এই খামার কখনোই পুনরুজ্জীবিত হবে না। অথচ বছরের পর বছর শূন্য পদ পূরণের আবেদন ধুলায় পড়েই থাকে। বরাদ্দ না থাকায় জরাজীর্ণ শেডগুলো সংস্কারও করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলো শুধু একের পর এক আশ্বাস দিয়ে দায় সারছে। এমনটা চলতে পারে না। জরুরি ভিত্তিতে এই খামারের পূর্ণ সংস্কার, জনবল নিয়োগ, হ্যাচারি আবার চালু এবং নষ্ট যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজবাড়ীর এই গুরুত্বপূর্ণ খামারকে অব্যবস্থাপনার বেদিতে বলি দেওয়া আর চলতে পারে না। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে খামারটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে আর বেশি সময় লাগবে না।
রাজবাড়ীর এই খামার শুধু মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের কেন্দ্রই নয়, স্থানীয় বাজারে মুরগির সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা, দরিদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সাশ্রয়ী দামে মুরগির বাচ্চা দেওয়া, যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি—সবকিছুতেই এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সঠিকভাবে চালু হলে এটি জেলার প্রাণিসম্পদ খাতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো আর দেরি না করে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেবে। যথাযথ সংস্কার, জনবল নিয়োগ ও হ্যাচারি চালুর মাধ্যমে এই খামারকে আবারও লাভজনক ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই খ ম র ম রগ র সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে প্রজনন হার হঠাৎ বাড়ছে
বাংলাদেশ কি উল্টো পথে হাঁটছে? দেশের নারীদের মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) এখন ২ দশমিক ৪। বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করে প্রজনন হার কমিয়ে ২ দশমিক ১৭ করতে পেরেছিল। এখন আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে এই উল্টো যাত্রা আগে কখনো দেখা যায়নি।
একজন নারী তাঁর প্রজনন বয়সে (১৫ থেকে ৪৯ বছর) যত সন্তানের জন্ম দেন, সেটাকে বলা হয় মোট প্রজনন। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের নারীরা গড়ে ছয়টি বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ টিএফআর কমানোর চেষ্টা করেছে। অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বড় অর্জনের একটি এই জন্মহার কমানো।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফ যৌথভাবে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০২৫ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ময়মনসিংহ বিভাগে প্রজনন হার সবচেয়ে বেশি, ২ দশমিক ৮। সবচেয়ে কম রাজশাহী বিভাগে, ২ দশমিক ২। সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের নারীদের মধ্যে এবং কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর নারীদের মধ্যে টিএফআর বেশি।
টিএফআর বাড়ছে, এর অর্থ আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও কর্মকৌশল সঠিক পথে নেই। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বেশি। টিএফআর বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারেজনসংখ্যাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামস্বাধীনতার পর বাংলাদেশে টিএফআর ছিল ৬ বা তার বেশি। মিকস ও অন্যান্য উৎসের তথ্য ব্যবহার করে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮২ সালে টিএফআর ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৭। এরপর তা কমতে থাকে। ১৯৯৪ সালে টিএফআর কমে হয় ৩ দশমিক ৪। টিএফআর আরও কমতে থাকে, ২০০৪ সালে তা কমে হয় ৩। ২০১২ সালে ছিল ২ দশমিক ৩ এবং ২০২২ সালেও একই হার। ২০২৪ সালের দিকে তা ছিল ২ দশমিক ১৭ বা তার কাছাকাছি।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে টিএফআর কখনো কমতে দেখা যায় না। হয় ক্রমাগত কমেছে, না হয় কয়েক বছর ধরে স্থির অবস্থায় ছিল। যেমন ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির ছিল। টিএফআর কেন কমছে না, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।
টিএফআর কীভাবে কমেছিলস্বাধীনতার পর জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল অধিক জনসংখ্যা জাতীয় অর্থনীতির বাধা। সরকার জনসংখ্যা কমানোর নীতি গ্রহণ করে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ওপর জোর দেওয়া হয়। মানুষের হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কর্মকৌশল দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা কর্মকাণ্ড চালু করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালিত টেলিভিশন ও বেতার এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী ছাড়াও এনজিওরা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
গত কয়েক দশকে সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বেড়েছে। মানুষ সহজে হাতের কাছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা দোকান থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনতে পারে। এর পাশাপাশি নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এসব উপাদানও টিএফআর কমাতে সহায়তা করেছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির ছিল। টিএফআর কেন কমছে না, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।বাংলাদেশের উদ্দেশ্য ছিল টিএফআর ২ দশমিক ১–এ নিয়ে যাওয়া; তা হয়নি। টিএফআর বেড়ে যাওয়ার অর্থ জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ এমনিতেই জনবহুল দেশ। তারপরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি বেড়ে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি আছে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে।
জনসংখ্যাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিএফআর বাড়ছে, এর অর্থ আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও কর্মকৌশল সঠিক পথে নেই। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বেশি। টিএফআর বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।’