প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ‘অস্তিত্ববাদ’ তথা এক্সিস্টেনশিয়ালিজম এবং অ্যাবসার্ডিজমের একটা বিরাট ধাক্কা পৃথিবীর শিল্পজগতে আঘাত করে। চিন্তাশীল মানুষ; বিশেষ করে কবি, কথাসাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী– কেউই এ থেকে মুক্তি পাননি, পাওয়ার কথাও নয়, উচিতও নয়। যুদ্ধ মনে করিয়ে দেয় মানুষের জীবন কী ভয়াবহ অর্থহীন হতে পারে! বাংলা সাহিত্যের কথায় যদি আসি, তাহলে অস্তিত্ব সংকটের রূপকার হিসেবে জীবনানন্দ দাশ আর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নাম প্রথমেই মনে পড়ে। কাজী নজরুল ইসলাম এ বিষয় নিয়ে লেখালেখির জন্য পরিচিত নন। তাঁর লেখার জগতে ছড়িয়ে আছে ব্রিটিশবিরোধী সচেতনতা, নারী-পুরুষ ও ধর্মীয় সাম্যবাদ, না পাওয়া বা হারানো প্রেমের অব্যাখ্যেয় যন্ত্রণা আর সেই সাথে মরমি, পৌরাণিক এবং সুফি প্রভাব আর সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন-সংঘাত। তবু তাঁর কিছু লেখায় মানুষের গভীরতম অস্তিত্ব-সংকট ফুটে ওঠে। বিদেশি এবং দেশি অসংখ্য লেখকের মতোই তাঁরও মনে হয়েছিল– রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, লিঙ্গবৈষম্য ইত্যাদি যদি না-ও থাকে, তবুও মানুষের অস্তিত্ব ভিত্তিগতভাবেই ফাঁপা। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে চিন্তা করলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের কোনো সার্থকতা মেলে না। সে আসে, সে যায়। কেন এল, কোথায়ই-বা গেল, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। নজরুলের ‘‘সাঁঝের তারা” সেই রকমই একটি ছোটগল্প। ছোট ছোট বাক্যে, অসাধারণ বাক্য প্রয়োগে আর শূন্যতার সার্থক বহিঃপ্রকাশে তিনি মানুষের অস্তিত্বের অসারতা ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘‘সাঁঝের তারা” পড়ার আগে কেউ যদি জীবনানন্দ পাঠ করে থাকেন, তাহলে গল্পটি পড়ার শুরুতেই তাঁর মনে পড়বে জীবনানন্দের লেখা চরণ– “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি” এবং ‘‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক”, কারণ শঙ্খের তৈরি পাহাড়ের পাদদেশে শুয়ে এই গল্পের কথক বলছেন– ‘‘সেদিন পথ-চলার নিবিড় শ্রান্তি যেন আমার অণু-পরমাণুতে অলস-ছোঁওয়া বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। .

.. তারপর কেউ কোথাও নেই। একা– শুধু একা!” জীবনানন্দের ‘‘অন্ধকার” কবিতার কথকের মতো ‘‘সাঁঝের তারা” গল্পেও নজরুল অনন্তকালের জন্য এই পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চেয়েছেন, “না, না, এখনও তো আমার ওঠবার সময় হয়নি”, ঠিক যেমন জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘‘ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে/ শিয়রে বৈশাখ মেঘ– সাদা-সাদা যেন কড়ি শঙ্খের পাহাড়।” গল্পের কথকের ঘুম শান্তিময় হয় না, কারণ ‘‘ঘুমের দেশের রাজকুমারী” বিদায় নেয় এবং ‘‘শ্রান্তি” এসে তাকে জাগিয়ে রেখে যায়। জীবনকে টেনে নিয়ে যাবার এই শ্রান্তিই হয়তো মানবজীবনের চিরসঙ্গী। তারপর একদিন জরা-ব্যাধি-মৃত্যু এসে তাকে কোলে টেনে নেয়। ‘‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা” গানের শেষেও নজরুল যেমনটি বলেছিলেন, ‘‘জ্বলিয়া মরিলি কে সংসার জ্বালায়/ তাহারে ডাকিছে মা, কোলে আয়, কোলে আয়/ জীবন প্রান্তে ওরে/ ঘুম পাড়াইতে তোরে/ কোলে তুলে নেয় মা মরণের ছলে।”
এই গল্পে নজরুল নিজেই কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গ টেনেছেন। ‘‘অশ্রু-নদীর সুদূর পারে” আর ‘‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে”– দুটো গানই মানবমনের নিবিড়তম একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা আর অসারতার কথা বলে। গল্পের কথকের স্বগতোক্তি থেকে জানতে পাই– জীবনের সবকিছুই তার কাছে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। কাউকে ডেকে, কারও সঙ্গ চেয়ে কোনো লাভ নেই। কেউ কাউকে বোঝে না। সকলেই যার যার চিন্তা আর স্বার্থের জগতে লটকে আছে, ‘‘কখনো কাউকে জীবন ভরে পেলি নে বলেই কি তোর এত কষ্ট ভাই? ... বৃথাই সে রেণু-পরিমল পথে পথে খোঁজা ভাই, বৃথা– বৃথা!”
‘‘ঘুমিয়ে বরং থাকি ভালো”, এই বাক্যটি হঠাৎই চোখের সামনে চলে এলে মনে পড়ে জীবনানন্দের লাইন– ‘‘অন্ধকারের স্তনের ভেতর, যোনির ভেতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।” জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা হয়তো প্রত্যেক শিল্পীর ভেতরই থাকে। কারও মধ্যে প্রকট, কারও মধ্যে প্রচ্ছন্ন। নজরুল আর জীবনানন্দ, দুজনের মধ্যেই সেই একই বোধ কাজ করেছিল, ‘‘আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চলে আসে/ আমি থামি–/ সেও থেমে যায়”, কারণ ‘‘সাঁঝের তারা”র কথক অনুভব করেছে, ‘‘আমার মনে এ কোন আদিম-বিরহী ভুবন-ভরা বিচ্ছেদ-ব্যথায় বুক পুরে মুলুক মুলুকে ছুটে বেড়াচ্ছে? খ্যাপার পরশমণি খোঁজার মতোন আমিও কোন্ পরশমণির ছোঁওয়া পেতে দিকে দিকে দেশে দেশে ঘুরে মরছি?” এখানে রবিঠাকুরের লেখা ‘‘কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে/ ফিরি আমি কাহার পিছে”র একটা সার্থক সমান্তরাল পাওয়া যায়।
গল্পের মাঝামাঝি এসে কথক সাঁঝের তারার দেখা পান। এই তারা কিছুটা দুষ্ট আবার খানিকটা বিরহী, যেন দুষ্টুমি দিয়ে জীবনের গভীরতর বেদনাকে আড়াল করতে চাচ্ছে। ক্ষণিকের দেখা দিয়ে সন্ধ্যাতারা অদৃশ্য হয়ে যায়। অথচ এই ক্ষণিকেই কথক খুঁজে পায় তাঁর মনের মিতাকে। স্বর্গীয় কোনোকিছুই বোধহয় দীর্ঘস্থায়ী নয়। মর্ত্যরে মানুষের চেয়ে মহাশূন্যের বিচ্ছিন্ন– নিঃসঙ্গ নক্ষত্রই যেন তাঁর আপন। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক জ নজর ল ইসল ম নজর ল

এছাড়াও পড়ুন:

শেফালি আর দীপ্তিতে নতুন মুম্বাইয়ে নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত

নাবি মুম্বাই। নয়া মুম্বাই। নতুন সেই মুম্বাইয়ে কাল নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পেল মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত।

দীপ্তি শর্মার করা ৪৬তম ওভারের তৃতীয় বলে নাদিন ডি ক্লার্কের তোলা ক্যাচটি এক্সট্রা কাভারে ভারত অধিনায়ক হারমানপ্রীত কৌরের হাতে জমা হতেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের আনন্দে মাতল পুরো ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকা ২৪৬ রানে অলআউট, ভারত ৫২ রানে জয়ী।

ভারতের জয়ের উৎসব অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল পাঁচ ওভার আগেই। লরা ভলভার্টকে ফিরিয়ে পথের কাঁটা উপড়ে ফেলেই উদ্‌যাপন শুরু করেছিল ভারতীয়রা। অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করে দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক চোখ রাঙাছিলেন ভারতের উৎসব ভন্ডুল করার। কিন্তু সেঞ্চুরি করার পরপরই ক্যাচ তুললেন ভলভার্ট। আর সেই ক্যাচ নিতে গিয়ে আমানজোত কৌর ভারতের প্রায় শত কোটি মানুষের হৃৎস্পন্দন প্রায় থামিয়ে দিয়েছিলেন। একবার নয়, দুবার নয়, তৃতীয়বারের চেষ্টাতেই ক্যাচ নিতে পারেন আমানজোত। এবারও বোলার সেই অফ স্পিনার দীপ্তি শর্মা।

৯৮ বলে ১০১ রান করে ভলভার্ট যখন ফিরলেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর ৪১.১ ওভারে ২২০/৭। এরপর শুধু আনুষ্ঠানিকতাই ছেড়েছে ভারত। দীপ্তি আরও ২টি উইকেট নিয়ে পেয়ে গেছেন ৫ উইকেট। আর ভারত হয়ে গেছে চ্যাম্পিয়ন। এর আগে ব্যাট হাতেও ৫৮ বলে ৫৮ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন দীপ্তি।

ব্যাট হাতে ৮৭ রান করা শেফালি বর্মা বল হাতে নিয়েছেন ২ উইকেট

সম্পর্কিত নিবন্ধ