ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় চার জনপ্রতিনিধির বাড়ি থেকে ভিডব্লিউবি (ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট) প্রকল্পের ৬৮ বস্তা চাল জব্দ করেছে যৌথ বাহিনী। এ সময় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক সংরক্ষিত নারী সদস্যসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে থানায় মামলা হয়েছে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার দরিকান্দি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হাসান মিয়া (৪২), ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হবি সরকার (৪৫), ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাবিব মিয়া (৩৫) ও সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য পারভীন আক্তার (৫০)। চাল দরিকান্দি ইউনিয়নের অসহায় ও দুস্থ ৯৩ জন উপকারভোগী নারীর মধ্যে বিতরণ করার কথা ছিল।

পুলিশ ও উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ভিডব্লিউবি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ পাওয়া চাল উপকারভোগীদের মধ্যে বিতরণ না করে ইউপি সদস্যরা নিজেদের বাড়িতে রেখেছেন—এমন খবর পেয়ে গতকাল রাতে চার ইউপি সদস্যর বাড়িতে অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এ সময় ইউপি সদস্য পারভীনের বাড়িতে ১৭ বস্তা, হবি সরকারের বাড়িতে ৭ বস্তা, হাবিব মিয়ার বাড়িতে ২৫ বস্তা ও হাসান মিয়ার বাড়ি থেকে ১৯ বস্তা চাল জব্দ করা হয়। প্রত্যেক বস্তায় ৩০ কেজি করে চাল ছিল। এ ঘটনায় ওই চার জনপ্রতিনিধিকে আটক করে যৌথ বাহিনী। পরে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা রাবেয়া সুলতানা বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেন।

রাবেয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ইউপি সদস্যদের বাড়ি থেকে মোট ৬৮ বস্তা চাল জব্দ করা হয়েছে। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের অধীনে ভিডব্লিউবি প্রকল্পে ১ হাজার ৭১৭ জন উপকারভোগী আছেন। এর মধ্যে জব্দ করা ৬৮ বস্তা চাল দরিকান্দির ৯৩ জন উপকারভোগীর জন্য বরাদ্দ ছিল। গত বছর ওই চারজন ইউপি সদস্যর চাল বরাদ্দের মেয়াদ শেষ হয়েছিল। চলতি মে মাসে পাঁচ মাসের চাল তাঁরা বরাদ্দ পেয়েছিলেন।

বাঞ্ছারামপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফেরদৌস আরা প্রথম আলোকে বলেন, ৬৮ বস্তা চাল জব্দসহ একজন সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য ও তিনজন ইউপি সদস্যকে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে আটক করেছে। দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বাঞ্ছারামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় সংরক্ষিত আসনের এক নারীসহ চার ইউপি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স রক ষ ত বর দ দ র ইউপ উপজ ল সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

প্লাস্টিক পলিথিন বিষে বিপদে সুন্দরবন

নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রতিকূলতা সয়ে টিকে থাকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এবার মানুষের তৈরি হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। প্লাস্টিক-পলিথিন ও মাছ শিকারে ব্যবহৃত বিষ এই বনের প্রাণ-প্রকৃতির অস্তিত্বের জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক ও পলিথিনের মতো অপচনশীল বর্জ্য শুধু সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নয়, বরং দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের জন্যও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এসব বর্জ্য নদীনালা ও খালের প্রবাহকে ব্যাহত করছে, নষ্ট করছে মাছ ও জলজ প্রাণীর প্রজননক্ষেত্র। পাশাপাশি বনের ভেতরে নতুন গাছপালা জন্মানো ও বিস্তারের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন বিভাগের শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে একটি গবেষণা করা হয়। এ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সুন্দরবনে প্রতি লিটার পানিতে অন্তত দুটি মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং প্রতি কেজি মাটিতে সাড়ে সাত শতাধিক মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবন ও এর সংলগ্ন নদ-নদী-খাল থেকে শিকার করা প্রতি কেজি মাছ ১০-১৫ মিলিগ্রাম মাইক্রোপ্লাস্টিক বহন করছে। ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি থাকার পাশাপাশি কিডনি ও লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে সক্ষম এ মাইক্রোপ্লাস্টিক সুন্দরবনের প্রকৃতি, পরিবেশ, উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষতি করছে।  
সম্প্রতি পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন কদমতলা, হরিনগর, নীলডুমুর ও কৈখালী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীগুলোতে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক-পলিথিন ভেসে বেড়াচ্ছে। খাবার কাজে ব্যবহৃত প্লেটের (একবার ব্যবহারযোগ্য) পাশাপাশি ভাসমান সেসব প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে কোমল পানীয়সহ খাবার পানির বোতল। এ ছাড়া চানাচুর, চিপস, বিস্কুটসহ নানা প্রকার খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেটসহ বিভিন্ন পণ্য বহনের কাজে ব্যবহৃত পলিথিনও ভাসতে দেখা গেছে এসব নদীতে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে প্লাস্টিকের একবার ব্যবহারযোগ্য প্লেট ও গ্লাস ব্যবহারের জনপ্রিয়তা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। পারিবারিক সব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন। ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত সেসব প্লাস্টিক-পলিথিন ধ্বংস না করে বরং নানাভাবে তা পাশের নদী-খালে ফেলা হচ্ছে। জোয়ার-ভাটায় সেসব প্লাস্টিক-পলিথিন সুন্দরবনসহ আশপাশের নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে সুন্দরবন ও এর সংলগ্ন নদ-নদী দূষিত হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ছে জীব ও প্রাণবৈচিত্র্য। শিকার করা মাছর পেটে প্লাস্টিক-পলিথিনের অস্তিত্ব পাওয়ার দাবি করে স্থানীয়রা জানান, পলিথিনে আটকে মাছ ও কচ্ছপের মৃত্যুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তারা। এ ছাড়া অপচনশীল এসব বর্জ্যের আধিক্যে সুন্দরবনের চর ও ফাঁকা জায়গায় গাছপালার বিস্তার কমে গেছে। 
শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন তীরবর্তী মধ্য খলিশাবুনিয়া গ্রামের যুবক মতিউর রহমানের ভাষ্য, পেশায় ট্রলারচালক হওয়ায় সারাক্ষণ তাঁকে নদীতে থাকতে হয়। ফলে প্রতিনিয়ত সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক-পলিথিন ভাসতে দেখেন তিনি। তিন পুরুষ ধরে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মতিউরের দাবি, আগের মতো আর সুন্দরবনের চরে পর্যাপ্ত গাছ জন্মাচ্ছে না। নতুন গাছ না জন্মানোয় সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে ভাঙনের দৃশ্য অনেকের মতো তাঁর চোখও এড়ায়নি। ভাটার সময় চর ও বনের মধ্যে প্লাস্টিক-পলিথিন আটকে যাওয়া অংশে বীজ পড়েও চারা গজানোর সুযোগ মিলছে না বলে দাবি তাঁর। 
বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের নুরুন্নাহার বেগমের স্বামী প্যারালাইসিস হওয়ায়বদলে তিনি সুন্দরবন-সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীতে মাছের পোনা ধরে সংসার সামলাচ্ছেন। নুরুন্নাহার জানান, ভাটার সুযোগে চরে নামলে অধিকাংশ সময় তাঁর জালে উঠে আসে পানির মধ্যে থাকা পলিথিন। লোকালয় থেকে এসব পলিথিন ভেসে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা এসব প্লাস্টিক-পলিথিনের ক্ষতির বিষয়ে জানেন না। কিছু না ভেবেই আরও অনেকের মতো তিনিও ব্যবহার অনুপযোগী প্লাস্টিক-পলিথিন পাশের নদীতে ফেলে দেন।  
নীলডুমুর বাজারের ব্যবসায়ী শরিফ উদ্দীনের ভাষ্যমতে, তিনি কাইন ও লাউ ভোলা মাছের পেটের মধ্যে পলিথিন পেয়েছেন। পলিথিনে জড়িয়ে মৃত কচ্ছপ নিয়ে ফিরতে দেখেছেন জেলেদের। অসাধু কিছু বনজীবী বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের পাশাপাশি সঙ্গে নিয়ে যাওয়া পলিথিন ও প্লাস্টিক বনের মধ্যে ফেলে দেন বলে অভিযোগ তাঁর। 
সুন্দরবনের দূষণ নিয়ে কাজ করা ইয়ুথ নেট গ্লোবালের সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়কারী ইমাম হোসেনের মতে, প্লাস্টিক-পলিথিনে সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকসহ পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার সুন্দরবনের অস্তিত্বকে রীতিমতো ‘চ্যালেঞ্জ’ জানাচ্ছে। 
উপকূলের সুরক্ষা ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করা এ তরুণের দাবি, সুন্দরবনের নদ-নদীতে থাকা প্লাস্টিক-পলিথিনের কারণে মাছসহ উদ্ভিদের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি বৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবন তার অনুকূল পরিবেশ হারাচ্ছে। প্লাস্টিক-পলিথিনের  উপস্থিতি সুন্দরবনের প্রাণীর ওপর নানাভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তিনি জানান, আরও বেশি ক্ষতি হওয়ার আগেই সুন্দরবনের নদ-নদীগুলো প্লাস্টিক-পলিথিনের দূষণমুক্ত করা দরকার। সেজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টিসহ আইনের কঠোর প্রয়োগ খুবই জরুরি।  
বেসরকারি সংগঠন রূপান্তরের জেলা সমন্বয়কারী ও ইকো-সুন্দরবন প্রকল্প কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া জানান, সুন্দরবনকে প্লাস্টিক-পলিথিন ও বিষের প্রভাবমুক্ত রাখতে তারা স্থানীয়দের সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিতে সেখানকার মাটি ও পানি দূষণমুক্ত রাখার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি জানান, উপকূলবর্তী এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনা অতি জরুরি।   
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মিলন হোসেন বলেন, সুন্দরবনের নদ-নদীতে বিষ দিয়ে শিকার করা মাছ মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ছাড়া লেইদসহ অপরাপর ক্ষতিকর পদার্থ থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। 
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জার হাবিবুর রহমান জানান, সুন্দরবনে আসা পর্যটকদের প্লাস্টিক-পলিথিন ব্যবহারে সতর্ক করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পর্যটকবাহী কয়েকটি নৌযানকে জরিমানা করা হয়েছে। বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারিদের আইনের আওতায় আনতে সহযোগিতার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। বেশির ভাগ প্লাস্টিক-পলিথিন উপকূলবর্তী বাজারসহ এলাকার বাসিন্দাদের মাধ্যমে নদ-নদীতে ছড়াচ্ছে বলে দাবি তাঁর।
শ্যামনগরের ইউএনও রনী খাতুন জানান, সুন্দরবনকে দূষণমুক্ত রাখতে যেখানে সেখানে প্লাস্টিক-পলিথিন না ফেলতে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। বিভিন্ন অংশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে স্থানীয়দের উৎসাহিত করা হচ্ছে। উপকূলবাসীকে মায়ের মতো আগলে রাখা সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়দের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ