সুব্রত বাইন আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড নোটিশ প্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। যার বিরুদ্ধে ৩০টির অধিক খুনের মামলা রয়েছে। প্রায় সব মামলাতেই সাজাপ্রাপ্ত তিনি। গত ২৭ মে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনারবাংলা সড়কের একটি তিনতলা বাড়ি থেকে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী তারই সহযোগী মোল্লা মাসুদসহ গ্রেপ্তার হন তিনি।

সুব্রত বাইনদের মত শীর্ষ সন্ত্রাসী আটকের সংবাদ দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। তবে সুব্রত বাইনের মত শীর্ষ সন্ত্রাসী আটকে জনমনে যতটা না আলোচনার জন্ম দেয়, তার চেয়ে বেশি আলোচিত হয় কুষ্টিয়া থেকে আটকের বিষয়। জনমনে প্রশ্ন সুব্রত বাইনদের মত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কীভাবে কুষ্টিয়াকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়? কাদের ছত্রছায়ায় তাদের আগমন, তাদের মিশনই বা কী? সহযোগীসহ সুব্রত বাইনকে আটকের পর তার মিশন সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে অনেক কিছু উঠে এলেও কুষ্টিয়ায় কীভাবে আসেন, কেনই বা আসেন পরিস্কার তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। 

তবে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে সুব্রত বাইন ও তার সহযোগী যে বাড়ি থেকে আটক হয়েছেন সেই বাড়িটি ভাড়া করে দেন হেলাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। তিনি সুব্রত বাইন যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, তার দক্ষিণ পাশের তিনতলা বাড়ির বাসিন্দা। যে বাড়ি থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী উদ্ধার করে সিসি টিভি’র ডিভাইসসহ গুরুত্বপুর্ণ ডকুমেন্ট। 

দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীকে কুষ্টিয়ায় আশ্রয়দাতা হেলাল উদ্দিন এক রহস্যময় ব্যক্তি। পেশায় পার্টস ব্যবসায়ী হলেও তার রয়েছে আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বাড়ি ভাড়া, বাসা থেকে খাবার রান্না করে খাওয়ানো ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা হেলালকে নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। 

সেনাবাহিনীর এতবড় অভিযানের পরও হেলাল গ্রেপ্তার না হওয়ায় সুব্রত বাইনদের কুষ্টিয়া অবস্থান সম্পর্কে রয়েছে ধোঁয়াশা। যে এলাকা হতে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তার হয়েছে সেই কালিশংঙ্করপুর এলাকার মানুষও চরম ভীতির মধ্যে রয়েছে। 

তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে কুষ্টিয়া হতে গ্রেপ্তার হওয়ায় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জিজ্ঞাসাবাদে তাদের মিশন সম্পর্কে জানিয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা করার পরিকল্পনা করছিল। কুষ্টিয়ায় আস্তানা গড়ে তোলার বিষয়টি পরিস্কার হতে আশ্রয়দাতা হেলালকে গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে। বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। হেলালের বিষয়েও খোঁজ-খবর নে্ওয়া হচ্ছে।

কে এই হেলাল উদ্দিন
২৭ মে ভোর থেকে পরিচালিত সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ আটকের পর থেকেই ঘুরে ফিরে আসে হেলালের নাম। কারণ, হেলালের মাধ্যমেই সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনারবাংলা সড়কের তিনতলা ওই বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে ওঠেন। 

বাড়িটি চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা পৌরসভার প্রয়াত মেয়র মীর মহিউদ্দিনের। হেলালের পরিবারের সাথে প্রথম মোল্লা মাসুদের পরিচয় হয়। তার পর আসেন সুব্রত বাইন। মূলত, হেলাল উদ্দিনের বাবা প্রয়াত আব্দুল কুদ্দুসের সাথেই প্রথমে পরিচয় ঘটে সুব্রত বাইনের। বাংলাদেশের কোন এক ভারতীয় সীমান্তে বসবাস করতেন আব্দুল কুদ্দুস। এই আব্দুল কুদ্দুস গত তিন মাস আগে মৃত্যুবরণ করছেন। ভারত সীমান্তে বসবাসের সুবাদে তার সাথে পরিচয় হয় সুব্রত বাইনের। সেই সূত্র ধরে সুব্রত বাইনদের সাথে যোগাযোগ। হেলালদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলনা। জমি কেনাবেচা থেকেই কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে তাদের। 

শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সাথে পরিচয়ের পর থেকে কপাল খুলে যায় হেলালদের পরিবারের। সুব্রত বাইনের সহায়তায় পাড়ি জমান দুবাইয়ে। সেখানে সুব্রত বাইনও বেশ কয়েক বছর থেকেছেন। বছর দশেক দুবাইয়ে অবস্থান শেষে বছর দেড়েক আগে দেশে ফিরে আসেন হেলাল। অপরাধ জগতে যখন সুব্রত বাইনদের জয়জয়কার, তখন মাঝে মধ্যেই হেলালদের বাড়িতে আসতেন সুব্রত বাইনেরা। মাস দেড়েক আগে বাসিন্দা হয়ে যান কালিশংকরপুরের আলোচিত ওই তিনতলা বাড়ির। যে বাড়ি থেকে ২৭ মে তারই সহযোগী মোল্লা মাসুদসহ আটক হন। উদ্ধার হয় অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা বারুদ।

স্থানীয় বাসিন্দা মানিক হোসেন বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরেই হেলালের বাড়িতে একটি খয়েরি রঙের বিলাসবহুল গাড়ি আসত। ওই গাড়িতে যারা আসত তাদের মধ্যে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে দেখেছি। আরো যারা আসত তাদের দেখলে চিনতে পারব। পরে মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন মীর মহিউদ্দিনের তিনতলা বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকত। তারা আটক হলে জানতে পারি ওরাই দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ।”

স্থানীয় অপর বাসিন্দা শাহীন জানান, মানুষ হিসেবে ওরা সামাজিক ছিল না। প্রতিবেশীদের সাথে ভালো আচরণ করত না। হেলালের ছোট ভাই বেলাল যিনি দুবাই থাকেন- তিনিসহ অন্য ভাইগুলোর ব্যবহার একই রকম। তাই তাদের সাথে কেউ যোগাযোগ রাখত না। সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের এই সদস্য কয়েক বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে বসবাস করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ফেরত আসেন। এই হেলাল দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের বেশ ঘনিষ্ঠ।

কুষ্টিয়ার যে বাড়ি থেকে সুব্রত ও মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেই বাড়িটি তিনিই ভাড়া করেছিলেন। বিশ্বস্ত মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাশকতা ও গুপ্ত হত্যার মিশনে অস্ত্র ও লজিস্টিক সাপোর্টের কাজটি তার করার কথা ছিলো।

একই এলাকার আরেক বাসিন্দা শাহজাহান তপন জানান, হেলালরা চার ভাই। সবার বড় রাশিদুল ইসলাম। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামীয়া কলেজে পিওন পদে চাকরি করেন। মেজোভাই হাফিজ বাড়িতে তৈরি মোটরপার্টসের ব্যবসা করেন। সেজো হেলাল উদ্দিন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তিনিই। সম্প্রতি দুবাই থেকে এসেছেন। সবার ছোট ভাই বেলাল বর্তমানে দুবাইয়ে চাকরি করছেন। 

যে বাড়িতে তারা বসবাস করেন ওই বাড়িটি তাদের নিজের। ১৫-১৬ বছর আগে এই বাড়িটি তারা কিনে নেন। তার আগে কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, হাউজিং এলাকার রুবেল নামে এক ব্যক্তির সাথে হেলালের ঘনিষ্ঠ সখ্যতা ছিল। আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাথেও হেলালের ওঠাবসা রয়েছে। হেলালের চালচলন ওঠাবসা অন্যদের থেকে আলাদা। সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসেবে নিজেকে জাহির করতেন।

রাজনৈতিক পরিচয় 
রাজনৈতিকভাবে হেলালদের সখ্যতা গড়ে ওঠে আওয়ামী লীগের সাথে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের সাথে তাদের পরিবারের বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হেলালের বড় ভাই রাশিদুল ইসলাম কুষ্টিয়া ইসলামীয়া কলেজে পিওন পদে যে চাকরিটা পেয়েছেন তা দিয়েছেন হানিফই। সেই সুবাদে রাশিদুলের পরিবারের সদস্যরা হানিফের প্রতি একটু বেশিই অনুগত। 

পিটিআই রোডের হানিফের বাড়ির সামনের টিনশেডে প্রায়ই বসতেন তিনি। যেকারণে হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। বিগত সংসদ নির্বাচনেও কোমর বেঁধে হানিফের পক্ষে কাজ করেছেন তারা।

রহস্যময়ী সুন্দরী নারী কে 
হেলালের আশ্রয়ে থাকা সুব্রত বাইন এবং মোল্লা মাসুদের সাথে এক সুন্দরী নারীকেও দেখা গেছে ওই বাড়িতে। যে বাড়িতে থাকতেন সুব্রত বাইনেরা। সুব্রত বাইন আর মোল্লা মাসুদকে খুব একটা দেখা না গেলেও স্থানীয়রা ওই বাড়ির সামনে মাঝে মধ্যেই জামা-কাপড় মেলে দিতে দেখতে পান তাকে। তবে তিনি আসলে কে, কি তার পরিচয় তা জানতে পারেনি কেউই। 

দ্বিতীয় তলায় থাকা কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, “ওপর থেকে প্রায় দেখতে পেতাম একজন নারী প্রায়ই জামা কাপড় মেলে দেন। তিনি যে নিচতলাতেই থাকতেন সেটি নিশ্চিত।”
গত মঙ্গলবার (২৭ মে) সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তারের পর প্রশ্ন ওঠে তাদেরই সাথে ওই ফ্লাটে থাকা সুন্দরী নারীটি আসলে কে? নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেউ কেউ বলেন ওই নারী সুব্রত বাইনের স্ত্রী হবে হয়ত। আবার কেউ বলেন তিনি আসলে তাদের রক্ষিতা। হেলালের মাধ্যমেই আগত ঘটে তার।

সুব্রত বাইনের আমলনামা 
সুব্রতর নামে ৩০টিরও অধিক খুনের মামলা রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোতেই এই সন্ত্রাসী সাজাপ্রাপ্ত, এছাড়াও অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজিসহ প্রায় ১০০ মামলার আসামিও তিনি। ২০০১ সালে পুরস্কার ঘোষিত এই শীর্ষ সন্ত্রাসী আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্নার নোটিশপ্রাপ্ত। ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী সময়ে তার আশ্রয়দাতারা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাওয়ার কারণে পেশাদার এই অপরাধী সাধারণ জনগণের সাথে মিশে যায়। 

২০০১ থেকে ভারতে সেদেশের গোয়েন্দা সংস্থা আইবি’র (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) ছত্রছায়ায় ছিলেন সুব্রত। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী তাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে অবস্থান করা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন উলফা, নাগাল্যান্ড লিবারেশন ফ্রন্টের নেতাসহ, মোস্তাকিম চাপ কাবাব-এর মালিক মোস্তাকিমকে হত্যা করিয়েছে। 

বিশেষ সূত্রমতে, বর্তমানে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কাজ করছে তিমোথি সুব্রত বাইন হিসেবে পরিচিত এই সন্ত্রাসী।

ঢাকা/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র পর ব র র ওই ব ড় এল ক র ইসল ম ত নতল করপ র সহয গ অবস থ আটক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঈদুল আজহার স্মৃতি ও সামাজিকতা

ইসলাম শুধু প্রার্থনার ধর্ম নয়, উৎসবেরও ধর্ম। ইসলাম ধর্মানুসারীরা বছরে দুটি ঈদ পালন করেন। এই দুটি ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। উৎসব হলেও দুই ঈদের সঙ্গে প্রার্থনার অনুষঙ্গও থাকে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা– দুটি ঈদেই নামাজ হয়। এ নামাজ আদায় করতে হয় জামাতে। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে। ঈদের জামাত এমন একটি অনুষ্ঠান, যেটি গরিব-ধনী সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে।

ঈদের জামাতে নতুন কাপড়, পারতপক্ষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে অংশগ্রহণ করতে হয়। আতর-সুগন্ধি মাখাও কাম্য। এক কথায় বলা যায়, পূত-পবিত্র হয়ে ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতে হয়। জামাত শেষে মুসল্লিরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির প্রকাশ ঘটায়। মসজিদ হোক অথবা ঈদগাহ, সেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র পরিবেশে নামাজ আদায় করা হয়। এভাবে ঈদ হয়ে ওঠে এক প্রাণবন্ত আনন্দ উৎসব, যা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারের মধ্য দিয়ে ঐহিক ও পারলৌকিক পরিত্রাণ অর্জনে সমুজ্জ্বল।  

ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যে হৃদয়কে স্পর্শ করে। ঈদুল ফিতর পালিত হয় রমজানের শেষে। এই ঈদ আসে আত্মসংযমের পর আনন্দের উৎসব হিসেবে। ঈদুল আজহা ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের উৎসব। ঈদুল আজহার ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। এর সূচনা হয়েছিল হজরত ইব্রাহিমের (আ.) মাধ্যমে। আল্লাহর আদেশে প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করতে খাস নিয়তে উদ্যত হয়েছিলেন তিনি। পিতা-পুত্র কারও এই কোরবানিতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছার অভাব ছিল না। আল্লাহ শুধু পরীক্ষা করলেন। দেখা গেল, পুত্রের কোরবানি পরিণত হয়েছে একটি দুম্বার কোরবানিতে। সেই থেকে ঈদুল আজহার কোরবানির সূচনা। 

ঈদুল আজহার অনুষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ব মুসলমানের আরেকটি বড় উৎসব জড়িয়ে আছে। উৎসবটি হলো বার্ষিক হজ পালন। হজ একাধারে বিশ্ব মুসলিমের মিলন উৎসব, অন্যদিকে এটি আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ারও উৎসব। হজ পালনকারীরা লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি উচ্চারণ করে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হন। হজরত ইব্রাহিমের স্বহস্তে নির্মিত কাবাঘর হজ উৎসবের মূল কেন্দ্র। হজের সময় প্রত্যেক হাজিকে কোরবানি করতে হয়। হজের সময় সেলাইবিহীন বিশেষ কাপড় পরিধানের বিধান রয়েছে। সবাই এক ধরনের কাপড় পরে। যার ফলে ধনদৌলতের পার্থক্য ঘুচে যায়।

আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। প্রতিবছর ঈদুল আজহার উৎসবে শামিল হয়েছি পরম আনন্দের সঙ্গে। শৈশব ও কৈশোরে যখন পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল ছিলাম তখন কোরবানির দায়িত্ব পালন করতেন পিতা। আমরা ভাইবোন কোরবানি করা পশুর গোশত তৃপ্তিভরে খেয়েছি। কোরবানির সময়ে একটি পরম উৎসাহের কাজ হলো, কোরবানির পশু ক্রয় করা। আমার পিতা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ভাগে কোরবানি দিতেন। বেশির ভাগ সময় গরু কোরবানি করা হতো। এই কোরবানির অংশীদাররা একত্র হয়ে পশুর হাটে যেতেন কোরবানির গরু কেনার জন্য। আমার বয়স যখন ১০ বা তার কাছাকাছি, সেই সময় থেকে আব্বার সঙ্গে হাটে গিয়েছি গরু কেনার জন্য। 

আমার শৈশবে পিতা ছিলেন থানা পর্যায়ে শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তখন পশুর হাট বসত ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে। এখনকার মতো তখন প্রশাসনিক থানাগুলো পৌরসভায় পরিণত হয়নি। পশুর হাট বসানোকে কেন্দ্র করে টেন্ডারবাজিও হতো না। তখনও রুগ্‌ণ ও সুস্থ পশু আলাদা করে দেখার বাস্তব ব্যবস্থা ছিল না। অবশ্য থানা পর্যায়ে ভেটেরিনারি অফিসার ছিলেন। এই অফিসারকে সক্রিয় হতে দেখিনি। লোকজন বাহ্যিকভাবে পশুর দেহ পরীক্ষা করে কোরবানির পশু কিনত। কোনো কোনো বছরে আব্বা খাসি কোরবানি দিতেন। সেই সময় কোরবানির পশু জবাই করতেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। তিনি এ জন্য কোনো হাদিয়া নিতেন কিনা, মনে করতে পারি না।

কোরবানির আগে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেছি মসজিদে। আমার আব্বার চাকরিজীবনের প্রথমদিককার সাত বছর কেটেছিল চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থানায়। হাজীগঞ্জের বড় মসজিদটি খুবই বিখ্যাত। আজও সেই মসজিদ সগৌরবে বিদ্যমান। আব্বার হাত ধরে মসজিদে যেতাম এবং বেশির ভাগ সময় প্রথম কাতারেই বসতাম। জামাতে যোগ দেওয়ার জন্য আব্বা নতুন কাপড় কিনে দিতেন। 

কোরবানি হয়ে গেলে গোশত ভাগাভাগি করা হতো। এ সময়ে কৌতূহলবশত কোরবানির পশু প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে দেখার জন্য উপস্থিত থাকতাম। গোশত বাসায় নিয়ে আসার পর তা থেকে আলাদা করা হতো গরিব মানুষের অংশ। সেই সময় দেশের অধিকাংশ মানুষ খুবই গরিব ছিল। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তির ওপর জীবন নির্বাহ করত। কোরবানির দিন তারা গোশতের জন্য বাসার সামনে ভিড় করত। এদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, প্রত্যেককে এক-দুই টুকরোর বেশি গোশত দেওয়া যেত না। পারিবারিক জীবনে এসে নিজেই কোরবানি দিতে শুরু করেছি। আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। যতদিন শারীরিকভাবে পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম ততদিন নিজেই কোরবানির হাটে গিয়েছি গরু কেনার জন্য। আমার সঙ্গে প্রায় প্রতিবছরের অংশীদার ছিল আমার ছোট ভাই মাহফুজ উল্লাহ। আজ সে বেঁচে নেই। তাই আর একসঙ্গে কোরবানি করা হয় না। মনে বড় কষ্ট পাই। 

দেশের জনসংখ্যা আমার ছোটবেলার তুলনায় অন্তত চার গুণ হয়েছে। সেই তুলনায় দারিদ্র্যের হার অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। গরিবের হক কোরবানির গোশত বিতরণ করার জন্য আগের মতো ভিক্ষুকরা ভিড় করে না। অবশ্য কিছু ভিক্ষুক এখনও বিদ্যমান, তবে ঘরে ঘরে গিয়ে ভিক্ষা করার রেওয়াজ প্রায় উঠে গেছে। গরিবদের নামে কোরবানির গোশত বিতরণ করতে হলে কে হকদার, তা খুঁজতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কিন্তু ভিক্ষুক নয়, এমন লোকদের মধ্যেই কোরবানির গোশত বিতরণ করি। এদের মধ্যে অধস্তন কর্মচারীরাও রয়েছে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশে থাকার সময় ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষে কোরবানি করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিবারের বাকি সদস্যরা দেশে কোরবানি করেছে। বিদেশে কোরবানি করতে না পারলেও দেশি বন্ধুদের নিয়ে ঈদুল আজহার নামাজ ইসলামিক সেন্টারে আদায় করেছি। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা। বন্ধুবান্ধব দ্বারা নানা রকম মিষ্টান্নে আপ্যায়িত হয়েছি। 

ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা– ঈদ দুটি বহু বছর ধরে ঢাকায় পালন করছি। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় সেখানে ঈদ করেছি। ঈদের সময় ঢাকা থেকে নাড়ির টানে লাখ লাখ মানুষ গ্রামমুখী হয়। ঈদযাত্রায় প্রচণ্ড বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। যাত্রীদের দ্বিগুণ-তিন গুণ বাস ভাড়া গুনতে হয়। রেলে টিকিট কিনতে হয় কালোবাজারে। নানা চেষ্টা করেও এই অনিয়ম রোধ করা যাচ্ছে না। ঢাকা থেকে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই হয়ে লঞ্চগুলো যাত্রা করে বিপজ্জনকভাবে। তবে গত ঈদুল ফিতরের ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় ঈদযাত্রীরা পরিকল্পনা করে যাতায়াত করেছেন। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ভিড় ও হয়রানি হয়নি বললেই চলে। এবারের ঈদুল আজহার ছুটিও বেশ দীর্ঘ। আশা করি, সবাই সহি-সালামতে এই ঈদের সময় প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পৌঁছাতে পারবেন। আল্লাহর কাছে সবার শান্তি ও আনন্দ কামনা করছি। আশা 
করি, আমরা সবাই ঈদুল আজহার ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হবো। 

মাহবুব উল্লাহ্: অর্থনীতিবিদ; প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ