গত সোমবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। এতে তিনি বেশ কিছু কথা বলেছেন। যেমন– বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কর্মসংস্থান বাড়ানো, তিন শূন্য পথে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়াসহ অনেক আকাঙ্ক্ষার কথা নির্দেশ করা হয়েছে। এই বাজেট প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক উন্নয়নের বদলে সামগ্রিক উন্নয়নের দিক এগোবে, যা হবে কল্যাণমূলক।
কথাগুলো ভালো ও প্রয়োজনীয়, তবে এর প্রতিফলন সামগ্রিক বাজেটে নেই। কথা ও কাজের এমন অমিল একটা সমস্যা বটে। আরও লক্ষণীয়, এবারের বাজেট কাঠামোগত দিক থেকে আগের বাজেটগুলোর মতোই। তাহলে গণঅভ্যুত্থানের কী তাৎপর্য প্রতিফলিত হলো?
এবারের বাজেটে আকার খানিকটা কমেছে, যা ছিল প্রত্যাশিত। কারণ এখন কোনো মেগা প্রকল্প নেই। কিন্তু আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য আগের চেয়ে খুব বেশি কমেনি।
প্রত্যাশা ছিল– গণঅভ্যুত্থানের সময় যেসব শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষ জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছে, তাদের জন্য বাজেটে বিশেষ কিছু থাকবে। যে বাজেট ঘোষিত হলো, তাতে সেসব মানুষের জন্য কী থাকল– সেটা বড় প্রশ্ন। আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এ বাজেটে তার কোনো সমাধান নেই।
উপরন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১০ মাসের শাসনামলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে লাখখানেক শ্রমিক নতুন করে বেকার হয়েছে। এ ছাড়া নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি; বিনিয়োগের অবস্থাও দুর্বল। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন করে বেকারত্ব আসার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটাকে মোকাবিলা করার জন্য বাজেটে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। এখানে ক্ষুদ্র শিল্পসহ কিছু ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়ার কথা এসেছে। কিন্তু সমস্যার গভীরতা যে রকম, সে তুলনায় সমাধান খুবই দুর্বল।
হতাশার বিষয়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে আমরা সংস্কারের অনেক কথা শুনেছি। সংস্কার মানে পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে; গতিপথে পরিবর্তন আনতে হবে। সেই গতিপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের অনুপাতে পরিবর্তন নিয়ে আসা। এখন শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের মতো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর স্বাস্থ্য খাতে রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ, যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হলো ৬ থেকে ৭ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ শতাংশও দেখা যায়। বাংলাদেশে ওই লক্ষ্যে সংস্কার হলো ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু এই সরকারের গত ১০ মাসেও এর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। আর বাজেটের পরিষ্কার চিত্রটি হচ্ছে, অনুপাতটি মোটামুটি একই রকম। বললে অত্যুক্তি হবে না, বাজেটের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে।
গত বছরেরে যে সংশোধিত বাজেট, সেখানেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কম বরাদ্দ ছিল। নতুন বাজেটেও সেটি বাড়েনি। ফলে বলা যায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অন্য অনেক খাতের মতো একই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। আর কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যেমন– হিমাগারের কথা বলা হয়েছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটি কোন সুনির্দিষ্ট উপায়ে করা হবে, তার সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার প্রক্রিয়া কী, সেটি বলা হয়নি।
আমরা পরিষ্কার– জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে পারলে, যথাযথ পরিকল্পনা আর জাতীয় মালিকানায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা হলে দাম কমে আসবে। বিদ্যুতের দাম কমবে; উৎপাদন ব্যয়ও তুলনামূলক কমে যাবে। তখন আমাদের বহু কিছু প্রয়োজন হবে না। সামগ্রিক অর্থনীতি বড় ধরনের একটা সুবিধা পাবে। সে রকম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংস্কারের জন্য এটি বড় একটি কাজ। গত ১০ মাসেও এ ব্যাপারে সরকারের তৎপরতা দেখা যায়নি।
আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগে দুটি দাবির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। একটা হলো আন্তর্জাতিক তহবিল সংস্থা (আইএমএফ); আরেকটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। আইএমএফের দাবি হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস করা, যেগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর যুক্ত। এতে দেশীয় শিল্প খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বা তাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। যেসব দেশীয় শিল্প আগে করছাড়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে ক্ষেত্রে ঝামেলা দেখা দেবে বা সেই সুযোগ আর পাবে না।
আবার আমদানি করা অনেক পণ্য শুল্কমুক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি ঘাটতি কমানোর জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এটি একটা হাস্যকর যুক্তি! কারণ যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি ঘাটতি সৃষ্টি হয়, আর বাণিজ্যে চাপ সৃষ্টির কারণে যদি শুল্ক কমানো হয়, তাহলে হয়তো দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে; তবে সরকারের রাজস্ব আয় হ্রাস পাবে। সেই রাজস্ব যে কমে যাচ্ছে, তা আবার বাড়ানোর জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রে কর ও দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটা হলে আমদানি শুল্ক ছাড়ের মাধ্যমে আমাদের আয় কমবে। দেশের মধ্যে আমদানি পণ্যের মতো যেসব পণ্য তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমে যাবে। ফলে এটি দুই দিক থেকে ক্ষতিকর হবে।
এ দুটি পরিবর্তন স্পষ্টভাবে এবারের বাজেটের মধ্য দিয়ে দেখা গেল। আইএমএফের মাধ্যমে বিভিন্ন ভর্তুকি হ্রাস, দেশীয় শিল্পে করছাড় হ্রাস এবং যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে অনেক আমদানি করা পণ্যে শুল্কছাড় কমিয়ে আনা। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে শুরুতে সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
মূলত শুধু প্রতিশ্রুতি দিলে হবে না, সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট পরিকল্পনাও থাকতে হবে। সংস্কারের জন্য ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে না পারলে পুরোনো ব্যবস্থাই থেকে যাবে। তাই বাজেট আরও পরিকল্পিত হওয়া দরকার ছিল, যাতে সংস্কারের পথে এটি শক্তি হিসেবে কাজ করে। সরকার যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে আদৌ কার্যকর সংস্কার কতটুকু হবে– তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়ে যাচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ য ক তর ষ ট র সরক র র র জন য আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
উৎপাদন খরচ বাড়বে
প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) বলেছে, উৎপাদন খাতের বড় শিল্পের কাঁচামালের ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, করপোরেট কর ও ব্যক্তি খাতের করের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করা হয়েছে। করজাল বাড়ানোর পদক্ষেপ নেই। বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানো, ব্যবসাবান্ধব হওয়া এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও এসব লক্ষ্য অর্জিত হওয়া দুরূহ।
তিনি বলেন, উৎপাদন খাতের বড় শিল্পের কাঁচামালের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমানো হবে বোধগম্য নয়। সবকিছু আইএমএফের ফরমুলা অনুযায়ী করা হয়েছে। আইএমএফের ফরমুলা অনুযায়ী চললে শিল্প ক্ষতির মুখে পড়বে। এমনিতে খরচ অনেক বেশি, জ্বালানির খরচ বেশি, ব্যাংক ঋণের সুদ অনেক বেশি এবং জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। এতসব সংকটের মধ্যেও যেসব শিল্প মোটামুটি প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে, সেখানেও শুল্ক ও কর বাড়ানো হয়েছে। গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের নগদ প্রণোদনা আস্তে আস্তে কমিয়ে আনা হচ্ছে। এর ফলে রপ্তানি খাত প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে। নগদ প্রণোদনার পরিবর্তে কোনো রাজস্ব পদক্ষেপ বাজেটে নেই। কটন সুতা ও ম্যান মেইড ফাইবারের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট প্রতি কেজিতে ৩ টাকা থেকে ৫ টাকা করা হয়েছে। এতে টেক্সটাইল শিল্প ক্ষতির মুখে পড়বে এবং সুতা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। স্টিল শিল্পের কাঁচামালের ওপর কর ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে ও সিমেন্ট শিল্পে কাঁচামালে মূসক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে দেশের আবাসন ও নির্মাণশিল্প খাতে খরচ বেড়ে যাবে।