‘আকাশছোঁয়া বনে’ বদলে যাচ্ছে শহুরে জীবন
Published: 5th, June 2025 GMT
১০ বছর আগে মিলানের পুরনো এক শিল্পাঞ্চলে গড়ে উঠেছিল দুটো ব্যতিক্রমী ভবন। কংক্রিটে মোড়া দালান নয়, ওগুলো ছিল সবুজে ঘেরা, গাছে-গাছে আচ্ছাদিত ‘উঁচু এক বন’। বসকো ভার্টিকেল নামের এই ভবন তখন যা ছিল এক অভিনব স্বপ্ন; আজ তা হয়ে উঠেছে ভবিষ্যতের শহরের পথনির্দেশক।
স্থপতি স্টেফানো বোয়েরির মাথায় এই ভাবনা আসে ২০০৭ সালে, দুবাইয়ের তৎকালীন নির্মাণযজ্ঞ দেখে। মরুভূমির মাঝখানে গড়ে ওঠা চকচকে ভবনগুলো সূর্য আলো প্রতিফলিত করে চারপাশ আরও গরম করে তুলছিল। তখনই তাঁর মনে হয়- কাঁচ নয়, গাছের সবুজ পত্র-পল্লবে মোড়ানো হোক ভবন। গাছ, পাখির সঙ্গে মানুষেরাও থাকুক প্রকৃতির মাঝে।
এভাবেই জন্ম নেয় বিশ্বের প্রথম ‘উলম্ব বন’। এখন সেখানে দুই হাজার গাছ আর হাজার হাজার লতা-গুল্মের সমাহার। ছাদে লাগানো সৌরপ্যানেল আর ভূগর্ভস্থ পানি টেনে গাছগুলোর প্রাণবন্ত অস্তিত্ব। সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত ভবন। আর এসব গাছের যত্ন নেন ‘ফ্লাইং গার্ডেনার’রা। যারা দড়িতে ঝুলে প্রতিদিন কাজ করেন ভবনের গায়ে!
এই ভবনের ১০ বছর পূর্তিতে বেরিয়েছে নতুন বই। নাম বসকো ভার্টিকেল: মরফোলজি অফ এ ভার্টিকেল ফরেস্ট। বইটিতে আছে পৃথিবীর নামজাদা স্থপতি ও চিন্তকদের লেখা, যাঁরা বলছেন- এই ভবন আসলে একটা বার্তা, ‘শহরের জায়গাগুলো থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতিকে আবার ফিরিয়ে আনতেই হবে।’
শুধু মানুষ নয়, গাছ-পাখির জন্যও ঘর
এই উঁচু বনকে বইটিতে বলা হয়েছে ‘এটা আদতে গাছ আর পাখির ঘর, কিন্তু এখানে মানুষও বাস করে।’ ভাবনাটা চমৎকার: মানুষ একা না, বরং প্রকৃতির সাথেই তার জীবন। বৃটিশ জীববিজ্ঞানী কলিন টাজের বই দ্যা সিক্রেট লাইফ অফ ট্রি’সের উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝানো হয়েছে, গাছ কেবল শোভা নয়; এরা কার্বন শোষণ করে, ছায়া দেয়, অক্সিজেন ছাড়ে, আর আমাদের ভালো রাখে। জেন গুডল বলছেন, শহরের বাড়বাড়ন্ত থামবে না। তাই এখনই সময় শহরকে প্রকৃতির বন্ধুতে পরিণত করার।
বসকো ভার্টিকেলের সাফল্যের পর মিলেছে অনুপ্রেরণা। দুবাই, ডেনভার, আন্টওয়ার্প থেকে কায়রো সবখানেই গড়ে উঠছে উঁচু সবুজ ভবন। নেদারল্যান্ডসের ট্রুডো ভার্টিকাল ফরেস্ট তো সামাজিক আবাসন প্রকল্প। যেখানে ভাড়া মাত্র ৬০০ ইউরো! কম খরচেই মিলছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
ফ্রান্সের মন্টপেলিয়ারে নির্মাণাধীন ‘দ্যা সিক্রেট গার্ডেনস’ প্রকল্পে থাকবে ছাদকৃষি আর বৃষ্টির পানির পুনঃব্যবহারের সুবিধা। স্থপতি ভিনসেন্ট ক্যালেবো বলছেন, ‘এটা শুধু ভবন নয়, এটা এক জীবনদর্শন।’ ফিলিপাইনের ‘দ্যা রেইনবো ট্রি’ ভবনেও গাছের যত্ন নেন বাসিন্দারাই। গাছে-ফুলে ঘেরা ব্যালকনি, কমিউনিটি গ্রিনহাউস আর শহুরে মৌচাক; সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় বন্ধুত্ব আর সামাজিক সংযোগ।
গবেষণা বলছে, সবুজ জায়গায় থাকা মানুষ বেশি সুখী। নেদারল্যান্ডসে এক অফিসে দেখা গেছে, গাছ থাকলে কর্মীরা বেশি খুশি থাকে, এমনকি ভালো থাকে তাদের স্বাস্থ্যও। ওয়েলসের এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ এলাকায় থাকা মানুষদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতার হার ৪০% কম!
এ কারণেই হাসপাতালেও আসছে উলম্ব বন। বেলজিয়ামের হস্পিউড টুয়েন্টি ওয়ান কিংবা মিলানের নতুন পলিক্লিনিকো হাসপাতালে গাছপালা, উন্মুক্ত ছাদবাগান- সবই রোগীর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বাড়ানোর জন্য।
সিঙ্গাপুরের জুয়েল চাঙ্গি বিমানবন্দর, আমস্টারডামের হোটেল জাকার্তা, রটারডামের দ্যা ডিপোট সবখানে দেখা মিলছে গাছপালায় মোড়া দালানের। তাইওয়ানের ২১ তলা ভবন ‘তাও ঝু ইন ইউয়ান’ ভবনটি ডিজাইন করা হয়েছে ডিএনএর ডাবল হেলিক্স গঠন অনুসারে। এখানে আছে ২৩ হাজার গাছ, যেগুলো বছরে ১৩০ টন কার্বন শোষণ করে। আর ভবনটির ডিজাইন এমন যে, আলাদা করে কুলার কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়না। প্রকৃতির দেয়া রোদ-বাতাস ব্যবহার করে নিজেই শীতল থাকে ভবনটি।
এইসব সবুজ ভবন মাটির ব্যবহারও কমায়, যার ফলে বাড়ে খোলা জায়গা, কমে বন্যার ঝুঁকি। ক্যালেবো বলছেন, ‘শহর আর পরিবেশের শত্রু নয়, বরং সমাধান হতে পারে- যদি আমরা সেখানে গাছকে জায়গা দিই।’
ভবিষ্যতের শহর: বন-নগরের হাতছানি
চীনের লিউঝৌ শহরে গড়ে তোলা হচ্ছে সম্পূর্ণ সবুজ ‘ফরেস্ট সিটি’, যেখানে থাকবে ৩০ হাজার মানুষ। নিজেই উৎপন্ন করবে নিজের জ্বালানি। মেক্সিকোর ক্যাঙ্কান স্মার্ট ফরেস্ট সিটিতেও থাকবে গাড়িমুক্ত পরিবেশ। কেবল টেকসই পরিবহন ব্যবস্থাই ব্যবহার করবে তারা।
এ যেন এক নতুন শহর, নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন। মিলানের বসকো ভার্টিকেলের মতো ভবন এখন শুধু দালান নয়- এরা এক প্রতিবাদ, এক আহবান। স্টেফানো বোয়েরি লিখেছেন, ‘এই ভবন আমাদের বলে- মানুষের জায়গায় প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। এইটুকুই যথেষ্ট।’ সূত্র: বিবিসি
ভাষান্তর- আসিফ মাহমুদ
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব শ প রক ত র ব যবহ র ফর স ট বলছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
শরীয়তপুরের সেই বিদ্যালয়টি অবশেষে ভেঙেই পড়ল পদ্মা নদীতে
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়নের ১৫১ নম্বর উত্তর মাথাভাঙা মান্নান সরকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি পদ্মা নদীতে ভেঙে পড়েছে। বিলীন হয়ে গেছে বিদ্যালয়ের ৩০ শতাংশ জমি। বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবন নদীতে বিলীন হওয়ায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। সোমবার বিকেলে ভবনটির একটি অংশ নদীতে ভেঙে পড়ে।
ভেদরগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়ন পদ্মা নদীর চরে অবস্থিত। ইউনিয়নটির একদিকে মুন্সিগঞ্জ ও আরেক দিকে চাঁদপুর জেলা। ওই এলাকাটির চার দিক দিয়ে পদ্মা নদী প্রবাহিত হয়েছে। ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর মাথাভাঙা চরবানিয়াল গ্রামে ৪০০ পরিবারের বসবাস। ওই গ্রামের বাসিন্দারা নদীতে মাছ শিকার ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁদের মধ্যে পড়ালেখার আগ্রহ কম। এ ছাড়া গ্রামটিতে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। ২০১৭ সালে ওই গ্রামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে সরকার। পরের বছর ২০১৮ সাল থেকে বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালু করা হয়। একতলা একটি পাকা ভবনের চারটি কক্ষে পাঠদান কার্যক্রম চলছিল। সোমবার বিকেলে বিদ্যালয় ভবনের একটি অংশ নদীতে ভেঙে পড়েছে।
আরও পড়ুনযেকোনো সময় পদ্মায় বিলীন হতে পারে শরীয়তপুরের বিদ্যালয়টি১৯ ঘণ্টা আগেবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষকেরা জানান, ২০২৩ সালে বিদ্যালয়টি পদ্মার ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে। তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সেখানে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করে। এ বছরের জুন মাসে সেই বালুর বস্তা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভবনটি রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ভাঙনের কবল থেকে বিদ্যালয় ভবনটি রক্ষার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বিদ্যালয় ভবনটি ভাঙনের মুখে পড়লে ৪ সেপ্টেম্বরের থেকে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। রোববার বিদ্যালয়ের আসবাব ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার পদ্মার চরাঞ্চলে উত্তর মাথঅভাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে