আমাদের দেশে আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে অনত্যম হচ্ছে ভারত প্রসঙ্গ। কখনো মোদি-ইউনূস বৈঠক বা মোদির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি অথবা স্থলপথ ব্যবহারে ভারতের বিধিনিষেধ কিংবা কখনো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা ও বিশ্লেষণ হবেই। এসব আলোচনার মধ্যে একটি বিষয় আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে মোদিই ভারত নন ও ভারতই মোদি নয়। ভারতের একটি শক্ত শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি রয়েছে, যা মোদির নীতি আওতার বাইরে।

মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ১৯৪৮ সালে মুসলমানদের জানমাল রক্ষার জন্য অনশন করেছিলেন। জওহরলাল নেহরু ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারত কেন মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বতোভাবে সমর্থন, সহায়তা দিয়েছিলেন। ভারতের আরও অনেক নেতাই ছিলেন, যাঁদের মাধ্যমে আমাদের কাছে ভারতের পরিচয় উজ্জ্বলতর ছিল।

মাত্র কয় মাস আগে আমাদের পরিচয় ছিল ‘হাসিনার বাংলাদেশ’ বা বাংলাদেশই হাসিনা। গত ৫ আগস্ট, এক দিনে আমাদের এই পরিচয় উবে গেল। ছাত্র-জনগণের বিক্ষুব্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের পরিচয়কে বদলাতে হলো। এখন চেষ্টা করছি আমাদের পরিচয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে যোগ করতে এবং একটা শক্ত শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি গড়তে।

ভারতে সরকার পরিবর্তনের জন্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রয়োজন হয় না। তারা প্রতি পাঁচ বছরে নির্বাচন করছে এবং অনেক নির্বাচনেই তারা সরকারে ক্ষমতাসীনদের হটিয়ে নতুনদের রাষ্ট্রভার দিয়েছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি ভারতের সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। সেই নির্বাচনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হটিয়ে বিরোধী দলের ক্ষমতায় আসার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। বিরোধী পক্ষের মধ্যে নেতৃত্বের বিরোধ সেই সুযোগকে নষ্ট করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

মোদির সরকারি নীতি নিয়ে বাংলাদেশে অনেকের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈরিতা এবং কাশ্মীরে তাঁর নির্যাতননীতি আমাদের দেশের লোকদের দারুণভাবে আহত করেছে। তার ওপর কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলাকে ছুঁতো ধরে মোদি যেভাবে একটা প্রতিবেশী দেশকে শায়েস্তা করতে আক্রমণ চালান, তা অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বেশ ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৪ সালের নির্বাচনে, ভারতের লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে মোদির দল বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি আসন, একক সংখ্যা গরিষ্ঠের চেয়েও বেশ কম। অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোটে বেঁধে মোদি প্রধানমন্ত্রিত্বে কোনোরকমে টিকে রয়েছেন। এই আঞ্চলিক দলগুলোর একটি হলো বিহারের জনতা দল (জেডি-ইউ), যার নেতা নীতীশ কুমার।

নীতীশ কুমার ছিলেন মোদিবিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ গঠনের একজন প্রধান কারিগর। কিন্তু নির্বাচনের অল্প কয় দিন আগে নীতীশ কুমার মোদির জোটে যোগ দেন। কারণ, প্রবীণতম নেতা হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন ইন্ডিয়া জোটের আহ্বায়ক হতে। কিন্তু কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এর বিরোধিতা করেছিলেন বলে আমরা জানি। যদি নীতীশ কুমার ইন্ডিয়া জোটে থেকে যেতেন, তা হলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত।

যেকোনো দেশে সরকার পরিচালনায় দুটি স্তর থাকে। নিচের স্তরটি হলো শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি। তার ওপরে পলিসি বা নীতিনির্ধারণ। ভিত্তি রাষ্ট্রের, আর পলিসি হলো যাঁরা সরকার গঠন করেছেন তাঁদের। গণতান্ত্রিক সরকারে, যেকোনো রাজনৈতিক দলকে তাদের পলিসি বা নীতি জনগণের কাছে গ্রহণীয় করে নির্বাচিত বা পুনর্নির্বাচিত হতে হয়।

আরও পড়ুনমোদির ব্যক্তিপূজার পররাষ্ট্রনীতি ভারতকে বন্ধুহীন করেছে ০১ জুন ২০২৫

মোদির সরকারি নীতি নিয়ে বাংলাদেশে অনেকের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈরিতা এবং কাশ্মীরে তাঁর নির্যাতননীতি আমাদের দেশের লোকদের দারুণভাবে আহত করেছে। তার ওপর কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলাকে ছুঁতো ধরে মোদি যেভাবে একটা প্রতিবেশী দেশকে শায়েস্তা করতে আক্রমণ চালান, তা অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বেশ ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের শাসকদের নীতি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো ছাড়াও ভারতের আরও অনেক পরিচয় আছে। তার একটা হলো, ভারতের নিয়মতান্ত্রিক ফেডারেল শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি।

১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ দুই ভাগ করল। ভারত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে একটা মজবুত গণতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক পথে এগিয়ে গেল। পাকিস্তান বেছে নিল প্রাসাদ রাজনীতি ও অনিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। আইয়ুব খান এসে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেন।

একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর আমরা পাকিস্তানের পথই বেছে নিলাম। এতে যোগ করলাম নতুন উপাদান—খুনোখুনি ও ফ্যাসিবাদ। স্বাধীনতার পর আমাদের সুযোগ ছিল গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যাওয়ার। আমরা সেই সুযোগ গ্রহণ করিনি। এখন আবার সুযোগ এসেছে একটা নিয়মতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতিতে এগিয়ে যাওয়ার। এই উদ্যোগে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতের সাংবিধানিক পদ্ধতিগুলো যাচাই করতে কোনো দোষ নেই।

মানি শংকর আয়ার ভারতের একজন সাবেক আমলা, বর্তমানে কংগ্রেস দলের নেতা। ভারতের গণতন্ত্র সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, ‘১৯৪৭ সাল থেকে প্রায় ১৫০টি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তবে এত বড় আকার ও বৈচিত্র্যের দেশ হিসেবে ভারতই কেবল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তাই নয়; বরং ৭৮ বছর ধরে তা টিকিয়ে রেখেছে।’

ভারতে ২৮টি রাজ্য এবং ৮টা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে। ভারতের মজবুত ফেডারেল সরকার ও রাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসন ২০০ ভাষাভাষীর এতগুলো রাজ্যকে একত্রে রাখতে সহায়তা করেছে। অবশ্য অনেক রাজ্যেই মাঝেমধ্যে ফেডারেশন থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছে। ভারত সরকার শক্ত হাতে তা প্রতিহত করেছে।

ভারতের ফেডারেল শাসনব্যবস্থার কিছু জিনিস আমাদের উপকারে লাগতে পারে। এগুলো পর্যালোচনা করতে অথবা এগুলোতে কোনো ভালো কিছু আছে কি না, তা বিবেচনা করতে আমাদের ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে হবে না বা তাদের কোনো শর্ত মানতে হবে না।

ভারতের নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হয়? তিনজনের একটি বাছাই কমিটিতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী, একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। তাঁরাই প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করেন তাঁদের বাছাই করা ছয়জন থেকে তিনজনকে চূড়ান্তভাবে বেছে নিতে। ৭৮ বছরের ঐতিহ্যই ভারতীয় নির্বাচনী পদ্ধতিকে রক্ষা করে রেখেছে। নির্বাচনের উত্তাপে, অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে পক্ষপাতিত্ব, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইত্যাদি বলে অভিযোগ করেন, কিন্তু নির্বাচনের পরে সবাই হার-জিত মেনে সংসদে আসন গ্রহণ করেন।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নির্বাচনেও যথেষ্ট সতর্কতা রয়েছে তাদের শাসনতন্ত্রে। একজন বিচারকের পদ খালি হলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কতগুলো নাম প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রীকে পাঠান। এগুলো অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয়। তারপর প্রধানমন্ত্রী একজনকে সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করেন।

সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতি প্রধান বিচারপতি হন। ভারতীয় বিচারে কখনো কখনো বিচারকের জাত, ধর্ম ও মনোভাব বিচার কার্যে প্রভাব ফেলে। একে বলা যায় ‘ব্যক্তিগত পক্ষপাত’। যদিও উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কখনো হয়নি। ১৯৭৫ সালে কয় মাসের জন্য জরুরি শাসন ঘোষণা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় শাসনতন্ত্র ও সুপ্রিম কোর্টকে পরীক্ষায় ফেলেন। পরবর্তী সময় এ জন্য তাঁকে অনেক বড় শাস্তি পেতে হয়েছিল।

শাসনতান্ত্রিক শৃঙ্খলা পুরো মাত্রায় সম্পূর্ণভাবে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে, আমাদের নতুন শুরুটাও খুব ভালো হচ্ছে না। কয় দিন আগে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে এড়িয়ে অবরোধ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা একটা রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করিয়ে নিয়েছে। এর জন্য আর একটু ধৈর্য ধরে বিচার বিভাগের ওপর নির্ভর করা কি যেত না?

আরেকজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা মেয়র হওয়ার জন্য লোক জড়ো করে ঢাকা মিউনিসিপ্যালটিতে তালা লাগিয়ে দিলেন। তিনি কি পরের নির্বাচনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন না? দাবি করা দোষের কিছু নয়, তবে মব তৈরি করে চাপ সৃষ্টি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়।

সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ই-মেইল: [email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র জন ত ক আম দ র প ব চ রপত র জন য র পর চ ন কর ছ মন ত র র ওপর র একট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী

চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।

বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

নিখুঁত নয়

জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।

গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’

জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।

জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।

তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।

আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

তবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।

ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।

বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’

তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’

কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’

আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।

এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’

আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ