লাখ লাখ লোকের মাঝে হারিয়ে যেভাবে ফিরলেন ফেনীর ছুট্টু মিয়া
Published: 11th, June 2025 GMT
রাত তখন গভীর। আরাফাতের ময়দান থেকে ফিরছিলেন ছুট্টু মিয়া। বাংলাদেশের ফেনী জেলা থেকে আসা এই ভদ্রলোক একজন অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা। সত্তরের কোঠায় পা রাখা শরীরটাও ছিল অবসন্ন, কিন্তু হৃদয়ে ছিল হজের আনন্দে পূর্ণতা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৫০ জন সহযাত্রী, সবাই হজের উদ্দেশে সৌদি আরবে আসা বাংলাদেশি।
বৃহস্পতিবার ছিল হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। আরাফাতে ইবাদত, দোয়া আর কান্নায় ভিজে গিয়েছিল দুপুর থেকে সন্ধ্যা। তারপর সবাই রওনা হন মুজদালিফার পথে—সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো হজের বিধান। রাস্তায় ছিল ভয়াবহ যানজট। সময় লাগছিল অনেক বেশি, যদিও ছুট্টু মিয়া তখনো প্রাণবন্ত। বাসে বসেই বাদাম খেলেন, আশপাশে বিলিয়েও দিলেন। এই মানুষটির সহজ আন্তরিকতায় যেন বাসটা ছিল একটা চলন্ত পরিবার। কিন্তু কোনো একমুহূর্তেই শরীর হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বিপত্তি শুরু হলো তখনই।
নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বাস একসময় মুজদালিফায় পৌঁছায়। একে একে সব যাত্রী নেমে গেলেন। কিন্তু ছুট্টু মিয়া তখনো ঘুমিয়ে। কেউ খেয়াল করেনি। বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর সবার মনে হলো সঙ্গে কেউ একজন নেই। ওই দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে ছুট্টু মিয়া আবিষ্কার করলেন—বাস খালি, চারপাশ অন্ধকার। ছুটে গেলেন বাসচালকের কাছে। ভিনদেশি বাসচালক, যাঁর মুখে একটাও শব্দ তিনি বুঝতে পারেন না। ছুট্টু মিয়াকে দেখে রীতিমতো কপাল চাপড়ালেন। চেহারায় ভয়ার্ত প্রশ্ন—এত রাতে, এই একা মানুষটা নিয়ে তিনি কী করবেন? তাঁকে আবার নতুন গ্রুপের যাত্রী তুলতে হবে বাসে।
চালক সিদ্ধান্ত নিলেন—আর বুঝে ওঠার সময় নেই। ছুট্টু মিয়াকে নামিয়ে দিলেন এক অজানা রাস্তায়। পেছনে পাথরের পাহাড়, আশপাশে কোনো দোকানপাট বা স্থাপনা নেই। জায়গাটায় কোনো চেনা মুখ নেই, নেই মুঠোফোন, নেই কারও ভাষা বোঝার ক্ষমতা। নির্জন রাস্তায় শুধু নিঃশব্দ গরম বাতাস আর দূরের আলোর ঝাপসা রেখা। তিনি বোঝাতে চাইছেন, কিন্তু কেউ বুঝছে না। আরব পুলিশকে গিয়ে বলছেন, কিছু বোঝে না। ছুট্টু মিয়ার ভাষ্যে ‘আমি কি কই হেতে বুঝে না, হেতে ঠাসঠুস কী কয়, আমি তো বুঝি না। আমি বুইঝলাম আইজগা আমার কেয়ামত। আমি শেষ, আঁর হজ আর হইত ন।’ একা একা ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, কখনো হাঁটলেন, কখনো বসে পড়লেন। একসময় পুলিশকে ইশারায় বোঝালেন, তিনি পাথর মারতে যেতে চান। পুলিশও দেখিয়ে দিল ওই দিকে। কিন্তু কোন দিকে, ছুট্টু মিয়ার কি সেটা বোঝার শক্তি আছে!
তবু হার মানেননি ছুট্টু মিয়া। ভাবলেন, জামারায় পাথর মারতে হবে তো? তাহলে পাথর জোগাড় করি! রাস্তার পাশে বসে কুড়িয়ে নিতে লাগলেন পাথর। কী অসাধারণ এক দৃশ্য—চারদিকে নিস্তব্ধতা, আর এক বৃদ্ধ মানুষ পাথর কুড়াচ্ছেন, হজের বিধান পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যেন এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেও নিজের দায়িত্ব ভুলে যাননি।
হঠাৎ যেন সব বদলে গেল। দূর থেকে একটা বাস এল। থামল একদম ছুট্টু মিয়ার সামনে। ইঞ্জিন বন্ধ। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যান ছুট্টু মিয়া। চোখ বড় হয়ে যায়—বাসভর্তি বাংলাদেশি যাত্রী! পরিচিত ভাষা, পরিচিত চেহারা। কেউ কুমিল্লা, কেউ ভৈরব, কেউ নরসিংদী থেকে আসা। এসব অঞ্চলের মানুষের ভাষা বোঝেন। নিজেও বুঝাতে পারছেন। প্রাণে পানি পেলেন ছুট্টু মিয়া। তিনি নিজের পরিচয় দেন, বলেন তাঁর বিপদের কথা। বাসের যাত্রীরা তখন আবার দুই ভাগে বিভক্ত—একদল বলছে অপেক্ষা করবে, আরেক দল হাঁটবে। ছুট্টু মিয়া হাঁটার দলে ভিড়ে যান।
সেই রাতটা তিনি কাটান হাঁটতেই হাঁটতে। কারও হাত ধরে নয়, কারও গাইড ধরে নয়—শুধু অচেনা মানুষের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে এগিয়ে চলা। পা টনটন করে, তবু সামনে এগিয়ে চলেছেন। পথে অনেকেই খাবার দিতে চেয়েছে, কিন্তু সারা রাত না খেয়েও তাঁর খেতে ইচ্ছা হয়নি।
ভোরের আলো ফোটে। একসময় তিনি চলে যান জামারায়, সবাই যখন পাথর ছুড়ছেন শয়তানের স্তম্ভে, তখন তিনিও মারলেন। দেখে দেখে, বুঝে বুঝে। এরপর মানুষের সঙ্গে মিশে চললেন হারাম শরিফের দিকে। এই পথ যে কীভাবে তিনি পাড়ি দিলেন, নিজেও বলতে পারছেন না।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার—একসময় তিনি ঠিক চিনে ফেললেন নিজের হোটেল। কীভাবে চিনলেন, তা তাঁর নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। দুপুরে হোটেলে ঢুকে সবাইকে চমকে দেন। মুয়াল্লিমের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন একজন। বিকেলে দেখা হয় কাফেলার সদস্যদের সঙ্গে—তাঁরা হতবাক! কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না, ছুট্টু মিয়া কীভাবে ফিরে এলেন। সবাই একে একে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে ছুট্টু মিয়াসহ অনেকের।
তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় চাঞ্চল্য। সবাই তাঁর গল্প শুনতে চান। হজের সেই দলের ‘তারকা’ এখন ছুট্টু মিয়া। তিনি আগ্রহ নিয়ে সবার সঙ্গে গল্প করছেন, হাসছেন, মজাও করছেন। কেবল একটুখানি আফসোস—‘বাসে পাশে জিগারে বাদাম খাওয়াইলাম, হেতে যদি একটুখানি মনে রাখত, বাসের তুন নামার আগে আওয়াজ দিত তাইলে আইজগা আর এ দশা হইত না।’
তবে ছুট্টু মিয়া একটুও মন খারাপ করেননি। বরং গর্ব নিয়ে বললেন, ‘এই হজে সবচেয়ে বড় পাওয়া, মানুষের ভালোবাসা। আমি হারাই নাই, মানুষ আমারে খুঁজে পাইছে।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সুনামগঞ্জে সেনাবাহিনীর অভিযানে গোলাগুলি, একজনের মরদেহ উদ্ধার
সুনামগঞ্জে জগন্নাথপুর উপজেলার একটি গ্রামে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে সেনাবাহিনীর অভিযানকালে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এসময় এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
রোববার সন্ধ্যার দিকে এ ঘটনা ঘটে। রাত ১১টার দিকে এই সংবাদ লেখা পর্যন্ত সেনাবাহিনী ওই গ্রাম ঘিরে রেখেছে বলে জানা গেছে।
নিহত ব্যক্তির নাম আবু সাঈদ (৩১)। তিনি পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলার তারপাশা গ্রামের তাজ মিয়ার ছেলে। আবু সাঈদ পেশায় মোটর মেকানিক।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের হাতিয়া গ্রামের বাসিন্দা বর্তমান চেয়ারম্যান যুবলীগের নেতা একরার হোসেন ও একই গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আতিকুর রহমানের মধ্যে গ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। এর জেরে দুদিন ধরে গ্রামে উত্তেজনা চলছিল। উভয় পক্ষের মধ্যে গত শুক্রবার পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। এর আগেও দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি ও গুলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। অস্ত্র প্রদর্শন হয়েছে প্রকাশ্যে।
রোববার বিকেলে সেনাবাহিনীর একটি দল অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে ওই গ্রামে অভিযান চালায়। খবর পেয়ে হাতিয়া থেকে সন্ত্রাসীরা নৌকায় করে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী জগন্নাথপুর উপজেলার গাদালিয়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেনাবাহিনী সেখানে গিয়ে ওই গ্রামে ঘেরাও দিলে সেখানে আশ্রয় নেওয়া সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। এ সময় সেনাবাহিনী গুলি চালায়। পরে ওই এলাকায় আবু সাঈদের লাশ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভুঞা রোববার রাত ১১টায় বলেন, আমাদের কাছে আসলে কোনো তথ্য নেই। এটি হাওরের দুর্গম একটি এলাকা। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আছেন। পুলিশ জগন্নাথপুর থেকে রওনা হয়েছে। নৌকায় যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগবে।
সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, গত ২০ জুন ২০২৫ তারিখ, দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যুবলীগ নেতা একরার আহমেদের লোকজনের সঙ্গে একই ইউনিয়নের বিএনপির সভাপতি আতিকুর রহমানের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গুলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং একজন গুলিবিদ্ধ হয়। এছাড়াও একরার আহমেদ ও তার অনুসারীরা প্রায়ই বর্ণিত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে আসছিল। এ ধরনের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সুনামগঞ্জ থেকে আজ রোববার (২২ জুন) তারিখে সেনাবাহিনীর একটি টহল দল অস্ত্রধারীদের ধরতে হাতিয়া গ্রামে অভিযান চালায়। বিকেলে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখে এক পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনীও গুলি চালায়। পরবর্তীতে একরার বাহিনীর সন্ত্রাসীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করে। টহল দল ওই স্থানে গিয়ে একজনের মরদেহ দেখতে পায়। এই ব্যক্তি কার গুলিতে মারা গেছেন নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বর্তমানে যৌথবাহিনী ওই এলাকায় অস্ত্রধারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে। এখনও (রাত সাড়ে ১১ টা) ওখানে অভিযান চলছে। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।