রাত তখন গভীর। আরাফাতের ময়দান থেকে ফিরছিলেন ছুট্টু মিয়া। বাংলাদেশের ফেনী জেলা থেকে আসা এই ভদ্রলোক একজন অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা। সত্তরের কোঠায় পা রাখা শরীরটাও ছিল অবসন্ন, কিন্তু হৃদয়ে ছিল হজের আনন্দে পূর্ণতা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৫০ জন সহযাত্রী, সবাই হজের উদ্দেশে সৌদি আরবে আসা বাংলাদেশি।

বৃহস্পতিবার ছিল হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। আরাফাতে ইবাদত, দোয়া আর কান্নায় ভিজে গিয়েছিল দুপুর থেকে সন্ধ্যা। তারপর সবাই রওনা হন মুজদালিফার পথে—সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো হজের বিধান। রাস্তায় ছিল ভয়াবহ যানজট। সময় লাগছিল অনেক বেশি, যদিও ছুট্টু মিয়া তখনো প্রাণবন্ত। বাসে বসেই বাদাম খেলেন, আশপাশে বিলিয়েও দিলেন। এই মানুষটির সহজ আন্তরিকতায় যেন বাসটা ছিল একটা চলন্ত পরিবার। কিন্তু কোনো একমুহূর্তেই শরীর হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বিপত্তি শুরু হলো তখনই।

নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বাস একসময় মুজদালিফায় পৌঁছায়। একে একে সব যাত্রী নেমে গেলেন। কিন্তু ছুট্টু মিয়া তখনো ঘুমিয়ে। কেউ খেয়াল করেনি। বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর সবার মনে হলো সঙ্গে কেউ একজন নেই। ওই দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে ছুট্টু মিয়া আবিষ্কার করলেন—বাস খালি, চারপাশ অন্ধকার। ছুটে গেলেন বাসচালকের কাছে। ভিনদেশি বাসচালক, যাঁর মুখে একটাও শব্দ তিনি বুঝতে পারেন না। ছুট্টু মিয়াকে দেখে রীতিমতো কপাল চাপড়ালেন। চেহারায় ভয়ার্ত প্রশ্ন—এত রাতে, এই একা মানুষটা নিয়ে তিনি কী করবেন? তাঁকে আবার নতুন গ্রুপের যাত্রী তুলতে হবে বাসে।

চালক সিদ্ধান্ত নিলেন—আর বুঝে ওঠার সময় নেই। ছুট্টু মিয়াকে নামিয়ে দিলেন এক অজানা রাস্তায়। পেছনে পাথরের পাহাড়, আশপাশে কোনো দোকানপাট বা স্থাপনা নেই। জায়গাটায় কোনো চেনা মুখ নেই, নেই মুঠোফোন, নেই কারও ভাষা বোঝার ক্ষমতা। নির্জন রাস্তায় শুধু নিঃশব্দ গরম বাতাস আর দূরের আলোর ঝাপসা রেখা। তিনি বোঝাতে চাইছেন, কিন্তু কেউ বুঝছে না। আরব পুলিশকে গিয়ে বলছেন, কিছু বোঝে না। ছুট্টু মিয়ার ভাষ্যে ‘আমি কি কই হেতে বুঝে না, হেতে ঠাসঠুস কী কয়, আমি তো বুঝি না। আমি বুইঝলাম আইজগা আমার কেয়ামত। আমি শেষ, আঁর হজ আর হইত ন।’ একা একা ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, কখনো হাঁটলেন, কখনো বসে পড়লেন। একসময় পুলিশকে ইশারায় বোঝালেন, তিনি পাথর মারতে যেতে চান। পুলিশও দেখিয়ে দিল ওই দিকে। কিন্তু কোন দিকে, ছুট্টু মিয়ার কি সেটা বোঝার শক্তি আছে!

তবু হার মানেননি ছুট্টু মিয়া। ভাবলেন, জামারায় পাথর মারতে হবে তো? তাহলে পাথর জোগাড় করি! রাস্তার পাশে বসে কুড়িয়ে নিতে লাগলেন পাথর। কী অসাধারণ এক দৃশ্য—চারদিকে নিস্তব্ধতা, আর এক বৃদ্ধ মানুষ পাথর কুড়াচ্ছেন, হজের বিধান পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যেন এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেও নিজের দায়িত্ব ভুলে যাননি।

হঠাৎ যেন সব বদলে গেল। দূর থেকে একটা বাস এল। থামল একদম ছুট্টু মিয়ার সামনে। ইঞ্জিন বন্ধ। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যান ছুট্টু মিয়া। চোখ বড় হয়ে যায়—বাসভর্তি বাংলাদেশি যাত্রী! পরিচিত ভাষা, পরিচিত চেহারা। কেউ কুমিল্লা, কেউ ভৈরব, কেউ নরসিংদী থেকে আসা। এসব অঞ্চলের মানুষের ভাষা বোঝেন। নিজেও বুঝাতে পারছেন। প্রাণে পানি পেলেন ছুট্টু মিয়া। তিনি নিজের পরিচয় দেন, বলেন তাঁর বিপদের কথা। বাসের যাত্রীরা তখন আবার দুই ভাগে বিভক্ত—একদল বলছে অপেক্ষা করবে, আরেক দল হাঁটবে। ছুট্টু মিয়া হাঁটার দলে ভিড়ে যান।

সেই রাতটা তিনি কাটান হাঁটতেই হাঁটতে। কারও হাত ধরে নয়, কারও গাইড ধরে নয়—শুধু অচেনা মানুষের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে এগিয়ে চলা। পা টনটন করে, তবু সামনে এগিয়ে চলেছেন। পথে অনেকেই খাবার দিতে চেয়েছে, কিন্তু সারা রাত না খেয়েও তাঁর খেতে ইচ্ছা হয়নি।

ভোরের আলো ফোটে। একসময় তিনি চলে যান জামারায়, সবাই যখন পাথর ছুড়ছেন শয়তানের স্তম্ভে, তখন তিনিও মারলেন। দেখে দেখে, বুঝে বুঝে। এরপর মানুষের সঙ্গে মিশে চললেন হারাম শরিফের দিকে। এই পথ যে কীভাবে তিনি পাড়ি দিলেন, নিজেও বলতে পারছেন না।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার—একসময় তিনি ঠিক চিনে ফেললেন নিজের হোটেল। কীভাবে চিনলেন, তা তাঁর নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। দুপুরে হোটেলে ঢুকে সবাইকে চমকে দেন। মুয়াল্লিমের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন একজন। বিকেলে দেখা হয় কাফেলার সদস্যদের সঙ্গে—তাঁরা হতবাক! কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না, ছুট্টু মিয়া কীভাবে ফিরে এলেন। সবাই একে একে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে ছুট্টু মিয়াসহ অনেকের।

তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় চাঞ্চল্য। সবাই তাঁর গল্প শুনতে চান। হজের সেই দলের ‘তারকা’ এখন ছুট্টু মিয়া। তিনি আগ্রহ নিয়ে সবার সঙ্গে গল্প করছেন, হাসছেন, মজাও করছেন। কেবল একটুখানি আফসোস—‘বাসে পাশে জিগারে বাদাম খাওয়াইলাম, হেতে যদি একটুখানি মনে রাখত, বাসের তুন নামার আগে আওয়াজ দিত তাইলে আইজগা আর এ দশা হইত না।’

তবে ছুট্টু মিয়া একটুও মন খারাপ করেননি। বরং গর্ব নিয়ে বললেন, ‘এই হজে সবচেয়ে বড় পাওয়া, মানুষের ভালোবাসা। আমি হারাই নাই, মানুষ আমারে খুঁজে পাইছে।’

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হয়েছেন। এতে একজন শিক্ষকসহ হোটেলের দুই কর্মচারী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত তিনজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

গতকাল শনিবার রাতে উপজেলার বড়িকান্দি ইউনিয়নের বড়িকান্দি গণি শাহ মাজার বাজারের একটি হোটেলে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে উভয় পক্ষের লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন।

নিহত ব্যক্তির নাম শিপন মিয়া (৩০)। তিনি বড়িকান্দি ইউনিয়নের নুরজাহানপুর গ্রামের মোন্নাফ মিয়া ওরফে মনেক মিয়ার ছেলে। নবীনগর থানা সূত্রে জানা গেছে, ওই দুজনের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ২০টি মামলা আছে।

গুলিবিদ্ধ আহত ব্যক্তিরা হলেন বড়িকান্দি ইউনিয়নের থোল্লাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা এমরান হোসেন (৩৮) এবং হোটেলের দুই কর্মচারী—উপজেলার আলমনগর গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে ইয়াসিন মিয়া (২০) ও চরলাপাং গ্রামের রশিদ মিয়ার ছেলে নুর আলম (১৮)। এমরান উপজেলার শ্যামগ্রামের মোহিনী কিশোর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। তাঁর ভাই ঢাকায় কর্মরত পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) বিল্লাল হোসেন।

বড়িকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মনেক ডাকাত এলাকাটা শেষ করে ফেলেছেন। তাঁর কারণেই এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে। মনেক ডাকাতদের কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। গুলিতে মনেক ডাকাতের ছেলে নিহত হয়েছেন।

স্থানীয় লোকজন, প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এলাকায় মোন্নাফ মিয়া ও তাঁর ছেলে শিপনের দীর্ঘদিন ধরে একক প্রভাব ছিল। তাঁদের সঙ্গে একই এলাকার থোল্লাকান্দি গ্রামের মিস্টার মিয়ার ছেলে আরাফাত মিয়ার বিরোধ চলছিল। শনিবার রাত আনুমানিক নয়টার দিকে বড়িকান্দি গণি শাহ মাজার বাজারের একটি হোটেলে শিপন মিয়া আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে আরাফাতের নেতৃত্বে সশস্ত্র একটি দল হোটেলে ঢুকে গুলি চালায়। এতে শিপনসহ হোটেলের দুই কর্মচারী ইয়াসিন ও নুর আলম গুলিবিদ্ধ হন। গুলির শব্দে বাজারজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হামলার পর আরাফাত ও তাঁর সহযোগীরা দ্রুত পালিয়ে যান।

শিপনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর নুরজাহানপুরে পৌঁছালে মোন্নাফ মিয়ার নেতৃত্বে একদল লোক গণি শাহ মাজারের অদূরে তালতলায় এমরান হোসেনের কার্যালয়ে হামলা চালান। সেখানে এমরান গুলিবিদ্ধ হন। এরপর তাঁরা থোল্লাকান্দি গ্রামে হামলা চালিয়ে একাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। রাতে ঘটনাস্থলে অভিযান চালালেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। কারণ, উভয় পক্ষের লোকজন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সংঘর্ষ এড়াতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গুলিবিদ্ধ কাউকেই শনিবার রাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়নি। তাঁদের হয়তো অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, শিপনের ওপর হামলাকারী আরাফাত থোল্লাকান্দি গ্রামের এমরান হোসেনের আত্মীয়। এ কারণেই এমরানের কার্যালয়ে গিয়ে হামলা এবং তাঁকে গুলি করা হয়েছে।

নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিনুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিহত শিপন ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন। শিপন ও তাঁর বাবার বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ২০টি মামলা আছে। ওই ঘটনায় একজন শিক্ষকসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ঘটনার পর থেকে সবাই পলাতক। তাই কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফুটবলার থেকে রাজনীতিক: বিএনপির মনোনয়ন পেলেন আমিনুল হক
  • ঢাবি থেকে ড. জাকির নায়েককে ডক্টরেট দেওয়ার দাবি শিক্ষার্থীদের
  • কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
  • বগুড়ায় বাড়িতে হাতবোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ, আহত একজন গ্রেপ্তার
  • ‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’
  • যদি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে: এফ আর খান
  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • একসময় ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ভবিষ্যৎ তারকা, এখন ক্লাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন