বাড়তি আয়ের আশায় অনলাইনে বিনিয়োগ, ১০ দিনে কোটি টাকা খোয়ালেন ব্যাংক কর্মকর্তা
Published: 22nd, June 2025 GMT
চাকরিতে বেতন ধরাবাঁধা। অনেকেই তাই চাকরির পাশাপাশি বাড়তি আয়ের পথ খোঁজেন। পুরান ঢাকার এক ব্যাংক কর্মকর্তাও আরেকটু সচ্ছলতার আশায় অনলাইনে বিনিয়োগ করেছিলেন। ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নয়; ১০ দিনের ব্যবধানে বিনিয়োগ করেছিলেন ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। সেই টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছেন প্রতারকেরা।
গত ২১ মে লালবাগ থানায় অজ্ঞাত ওই প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী ওই ব্যাংক কর্মকর্তা। তাঁর ভাষ্য, চাকরির পাশাপাশি বাড়তি আয়ের আশায় কথিত ‘আপওয়ার্ক ফ্রন্টডেস্ক–২০২৩’–এ গত বছরের ডিসেম্বরে কাজ শুরু করেছিলেন। শুরুর দিকে কয়েক দিন ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে কয়েক হাজার টাকা ‘আয়’ও করেন। একপর্যায়ে তাঁকে কথিত আপওয়ার্কের অংশীদার হওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। সেই ফাঁদে পা দিয়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এক কোটি টাকা ওই প্ল্যাটফর্মের কথিত পরিচালকদের দেওয়া ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। পরে অংশীদার হওয়ার কাগজ পেয়ে দেখেন সেটি ভুয়া। প্রতারকদের মুঠোফোন বন্ধ।
বিপুল অঙ্কের টাকা খুইয়ে চরম হতাশ হয়ে পড়েন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা। কয়েক দিন ঘরবন্দী হয়ে থাকেন। স্ত্রী, মা–বাবাসহ আত্মীয়স্বজন তাঁর পাশে দাঁড়ান। আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু করেন। মামলা করেন প্রতারকদের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। অনলাইনের কোনো প্ল্যাটফর্মে আগে কখনো কাজ করিনি। পরে হোয়াটসঅ্যাপের একটি বার্তা পেয়ে কাজ শুরু করি। ডিজিটাল প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে নিজের সঞ্চিত অর্থ ও ধারদেনা করে আমি এক কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছি।’
যেভাবে ১০ দিনে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ
ওই ব্যাংক কর্মকর্তার বয়স ৩৬ বছর। জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। ব্যবসাশিক্ষায় স্নাতক পাসের পর কয়েক বছর আগে একটি বেসরকারি ব্যাংকে যোগ দেন। তাঁর বর্তমান কর্মস্থল পুরান ঢাকায়।
ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ১১ ডিসেম্বর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে নাজনীন নামের এক নারীর খুদে বার্তা আসে। তাতে লেখা ছিল, অনলাইনে পার্টটাইম জব (খণ্ডকালীন চাকরি) করা যাবে। প্রতিষ্ঠানের নাম আপওয়ার্ক। তিনি আপওয়ার্কের একজন প্রতিনিধি। চাকরির পাশাপাশি বাড়তি আয়ের আশায় তিনি (ব্যাংক কর্মকর্তা) ওই হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় প্রভাবিত হয়ে কথিত আপওয়ার্কের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করেন।
পরে ব্যাংক কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপে একটি ইউটিউব চ্যানেলের লিংক পাঠানো হয়। তিনি সেই চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেন। এ জন্য তাঁর মুঠোফোনে ১৫০ টাকা দেওয়া হয়। পরে ব্যাংক কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপে আরেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামের একটি চ্যানেলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই চ্যানেলে যোগ দেন তিনি। টেলিগ্রাম চ্যানেলে কথিত আপওয়ার্ক ফ্রন্টডেস্ক ২০২৩–এ কাজ শুরু করেন।
প্রথমে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ তিনজনকে একটি গ্রুপে যুক্ত করা হয়। তাঁদের একজন নারী। ব্যাংক কর্মকর্তাকে অনলাইনে কাজ দেওয়া হতো। একটি কাজ শেষ করার পর তাঁর বিকাশ নম্বরে ২ হাজার ১০০, ২ হাজার ৮০০ টাকা করে আসত। এভাবে কয়েক দিন কাজ করার পর তাঁর বেশ কয়েক হাজার টাকা আয় হয়। একপর্যায়ে তাঁকে (ব্যাংক কর্মকর্তা) কথিত আপওয়ার্কের ভিআইপি গ্রুপে যুক্ত করা হয়। সেখানে কাজ করার পর মোটা অঙ্কের টাকা তাঁর ব্যাংক হিসাবে আসে।
ভুক্তভোগী ব্যাংক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আগে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করিনি। তবে আপওয়ার্কসহ কয়েকটি প্ল্যাটফর্মের নাম জানতাম। যখন হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে আপওয়ার্কে কাজ করার অফার (প্রস্তাব) দেওয়া হয়, তখন ভেবেছি সেটা সত্যিকারের আপওয়ার্ক। আমার মুঠোফোনের হিসাবে তখন অনেক টাকা যুক্ত হয়, তখন আমাকে ক্রিপ্টো অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয়। আমি ক্রিপ্টো অ্যাকাউন্ট খুলি।’
ওই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্রিপ্টো অ্যাকাউন্টের টাকা উত্তোলনের জন্য আমাকে আরও বিনিয়োগ করতে বলা হয়। আমিও বিনিয়োগ করি। একপর্যায়ে আপওয়ার্কের একজন আমাকে ওই কোম্পানির অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দেন। আমি রাজি হই। আমাকে তাঁরা বেশ কয়েকটি ব্যাংক হিসাব দেন। সেই ব্যাংক হিসাবে ১০ দিনের (গত বছরের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর) ব্যবধানে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি।’
ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে আপওয়ার্কের এক ব্যক্তি নিজেকে পরিচালক হিসেবে দাবি করেন। ব্যাংক কর্মকর্তাকে অংশীদারত্বের একটি অনুলিপিও (কপি) অনলাইনে পাঠান তিনি। তবে সেটি ভুয়া।
ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি আপওয়ার্কের পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন বলেও দাবি করেন। আপওয়ার্কের অংশীদার হওয়ার যে কাগজ আমাকে পাঠানো হয়, তা সঠিক বলে দাবি করেন। একপর্যায়ে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আপওয়ার্কের ফ্রন্টডেস্ক নামের ওই প্রতিষ্ঠান ভুয়া। আমি তাঁদের কাছে টাকা ফেরত চাই। এর পর থেকে তাঁদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর বন্ধ।’
জানতে চাইলে মামলার তদারক কর্মকর্তা ও লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা কামাল খান প্রথম আলোকে বলেন, কথিত অনলাইনে কাজের প্ল্যাটফর্ম আপওয়ার্ক ফ্রন্টডেস্ক পুরোটা ভুয়া। সংঘবদ্ধ একটি প্রতারক চক্র ব্যাংক কর্মকর্তাকে অনলাইনে কাজ করানোর ফাঁদে ফেলে এক কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগীর মামলাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
ব্যাংক কর্মকর্তার বাবা ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। তাঁদের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে পুরান ঢাকায়। সেখানেই পরিবারের সঙ্গে থাকেন। ওই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিজিটাল প্রতারকেরা আমাকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিলেন, আমি আমার স্বাভাবিক বোধ–জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। বাবা–মা ও আত্মীয়স্বজনের কাছে নানা অজুহাত দেখিয়ে কয়েক লাখ টাকা ধার নিই। আবার আমি ক্রেডিট কার্ডেও ঋণ করি। এভাবে ধারদেনা করে কোটি টাকার বেশি প্রতারকদের দেওয়া ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়েছি। সেই ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করলে ওই প্রতারকদের ধরা সম্ভব হবে।’ তাঁর সঙ্গে যাঁরা প্রতারণা করেছেন, তাঁদের সবাইকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করবে বলে আশা করেন ওই ব্যাক কর্মকর্তা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র হ য় টসঅ য প অ শ দ র হওয় র ক কর মকর ত র প ল য টফর ম ব ন য় গ কর একপর য য় ড স ম বর কর ছ ল ন ওই ব য কর র প ১০ দ ন ক র এক ক জ কর প রথম র একট
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনা হাসপাতালে ‘নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ’ নির্দেশ দেন, শুনতে পান ইমরান
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিয়েছেন শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান।
আজ সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এ মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিলেন আবদুল্লাহ আল ইমরান। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিদর্শনে গিয়ে শেখ হাসিনা ‘নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল ইমরান এই নির্দেশ শুনেছেন বলে জানান।
জবানবন্দিতে শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর বাঁ হাঁটুর নিচে গুলি লাগে।
আবদুল্লাহ আল ইমরান বলেন, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুর্নবাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) তাঁর চিকিৎসা চলছিল। গত বছরের ২৬ অথবা ২৭ জুলাই সকাল ৯টা-১০টার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা তাঁর কাছে যান। শেখ হাসিনাকে তিনি ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করেন। শেখ হাসিনা তাঁকে ‘আপা’ বলে ডাকতে বলেন।
আবদুল্লাহ আল ইমরান আরও বলেন, তিনি কোথায় পড়াশোনা করেন, হলে থাকেন কি না, কেন থাকেন না, সে সম্পর্কে শেখ হাসিনা জানতে চান। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, আমি আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে? আমি বলি, পুলিশ আমাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে কারা ছিল, সেটা আমি জানি না। আমার পর আরও চার থেকে পাঁচজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে শেখ হাসিনা যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন হেল্পডেস্কের কাছে গিয়ে “নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ” অর্ডার দিয়ে যান, যা আমি শুনতে পাই।’
তবে ‘নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ’ মানে কী, তখন বুঝতে পারেননি বলেও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান। তিনি বলেন, একপর্যায়ে তিনি দেখেন, যথাসময়ে তাঁর অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে পারছেন না। তাঁর বাবা হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে চাইলেও নিতে পারছিলেন না। তখন তিনি বুঝতে পারেন ‘নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ’–এর মানে। তাঁর পা কেটে তাঁকে কারাগারে নিতে চেয়েছিল।
এ ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দায়ী করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান।
গতকাল রোববার এই মামলার প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন মাইক্রোবাসচালক খোকন চন্দ্র বর্মণ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় গতকাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন ও সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়।
গত বছরের জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার এক বছরের মাথায় এই মামলার মাধ্যমে সেই অপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো।
আরও পড়ুনমানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিচার শুরু ১১ ঘণ্টা আগেআসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক। তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ, অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনসহ যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো।
এ মামলায় একমাত্র গ্রেপ্তার হওয়া আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি ইতিমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি তিনি এ মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ (দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্য বিবরণ প্রকাশ করেন যে আসামি; সাধারণত তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হয়েছেন। গতকাল তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। মামলার কার্যক্রমের কিছু অংশ বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।