বাজারে চাউলের মূল্য পুনরায় বৃদ্ধি পাইবার বিষয়টি শুধু উদ্বেগজনক নহে, বিস্ময়করও বটে। সরু চাউলই শুধু নয়, মোটা চাউলের মূল্যও বৃদ্ধি পাইয়াছে প্রতি কেজিতে অন্তত পাঁচ টাকা, যাহার ভোক্তা হইল নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। উপরন্তু নূতন করিয়া চাউলের মূল্য এমন সময় বৃদ্ধি পাইয়াছে যখন সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় নিম্নআয়ের মানুষের তো বটেই, সিংহভাগ মানুষের অন্যতম শিরঃপীড়ার কারণ। বস্তুত রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিবিধ কারণে বহু কলকারখানা এবং ব্যবসায় ক্ষেত্রেও স্থবিরতা চলিতেছে, যাহার বৃহৎ ধাক্কা পড়িয়াছে উক্ত শ্রেণি-গোষ্ঠীর উপর। ইহাও উল্লেখ্য, গত কয়েক বৎসরে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জরিপে দেখা গিয়াছে, সমাজের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারগুলি প্রায় সম্পূর্ণ ভাতের উপর নির্ভরশীল। তাহাদের আয়ের বৃহৎ অংশ খাদ্য সংগ্রহেই ব্যয় হয়। ফলে বিশেষত মোটা চাউলের বাজারে এহেন ঊর্ধ্বগতির নেতিবাচক প্রভাব সমাজের বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনযাত্রার সংকটকে বৃদ্ধি করিবে। প্রসঙ্গত রবিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাসে সরু চাউলের মূল্য ছিল ৭২ হইতে ৮০ টাকা কেজি, যাহা জুনে দাঁড়াইয়াছে ৭২ হইতে ৮৫ টাকা। মোটা চাউলের মূল্য৫৫ হইতে বৃদ্ধি পাইয়া হইয়াছে ৬০ টাকা, যাহা গত চার মাস যাবৎ অপরিবর্তিত ছিল।
মাত্র কিছুদিন পূর্বে বোরো ধান কৃষকের ঘরে আসিয়াছে। দেশের মোট চাউলের চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশের জোগানদাতা এই মৌসুমে এইবার বাম্পার ফলন ফলিয়াছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে চাউল আমদানিও যথেষ্ট। চাউলের মূল্যে ঊর্ধ্বগতি তাই আমাদের নিকট বিস্ময়কর। এইদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানাইয়াছেন, কোরবানির ঈদের পর হইতে এই অতিরিক্ত মূল্যে চাউল বিক্রয় হইতেছে।
শুরুতে বাজারে সরু চাউলের দাম বৃদ্ধি পাইয়াছে, যাহার প্রভাব পড়িয়াছে মোটা এবং অন্যান্য চাউলে। তাহাদের দাবি, এক সপ্তাহ যাবৎ আড়তগুলি চাহিদানুযায়ী চাউল সরবরাহ করিতেছে না; চাউলকল বন্ধ থাকিবার অজুহাত দেখাইতেছে। অবশ্য চাউলকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি দাবি করিয়াছেন, কোনো কল বন্ধ নাই। বৎসরের এই সময়ে দাম বৃদ্ধিরও কোনো কারণ নাই। তবে আলোচ্য পরিস্থিতিতে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বাজার নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলি যে উল্লেখযোগ্য কিছুই করিতেছে না– তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। অবশ্য অভিজ্ঞতা বলে, উহারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের উপর ক্ষণে ক্ষণে ব্যাঘ্রের ন্যায় ঝাঁপাইয়া পড়িলেও চাউলকল মালিকগণের বিরুদ্ধে বরাবরই মার্জারসদৃশ আচরণ করিয়া থাকে। দেশে মজুতদারি বন্ধে ২০১২ সালে প্রণীত প্রতিযোগিতা আইনটির প্রয়োগ অদ্যাবধি দৃশ্যমান নাই। অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর সকলেই আশা করিয়াছিল, অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় চাউলের বাজারেও বিগত আমলে সক্রিয় সিন্ডিকেটের প্রভাব হ্রাস পাইবে। প্রকৃতপক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারও দায়িত্ব গ্রহণের অব্যবহিত পর এমনই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করিয়াছিল।
চাউলের দাম বৃদ্ধি পাইলে শুধু ব্যক্তি বা পরিবারই যে ভোগান্তিতে পড়ে, তাহা নহে। সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতাতেও উহা ইন্ধন দিতে পারে– এই কথা আমরা এই স্তম্ভেই বহুবার বলিয়াছি। তাই ভরা মৌসুমে চাউলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয় দ্রুত খতাইয়া দেখা জরুরি বলিয়া আমরা মনে করি। সরকারি পর্যায়ে চাউল আমদানি লইয়া যে ভাবনা চলিতেছে, তাহার বাস্তবায়নও দ্রুত হইতে হইবে। শুধু উহাই নহে, ইতোমধ্যে অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করিয়া দেওয়া টিসিবির বিশেষ কার্ডধারীদের মধ্যে চাউল বিতরণ কর্মসূচি প্রবর্তন করা যাইতে পারে। খোলাবাজারে বিক্রয় কর্মসূচির আওতায় ভর্তুকি মূল্যে চাউল বিক্রয়ের কার্যক্রমও পুনরায় শুরু করা যায়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ উল র ম ল য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত-চীন সম্পর্কের আসলে কতটা উন্নতি হতে পারে
দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও চীন এখন ধীরে এবং সতর্কভাবে সম্পর্ক জোরদার করার পথে হাঁটছে। একদিকে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু করার আলোচনা, অন্যদিকে উচ্চপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় সফরের ধারাবাহিকতা—যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনিশ্চিত নীতির প্রেক্ষাপটে সবই ঘটছে।
দুই দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত এমন কয়েকটি সূত্র জানায়, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আগামী সপ্তাহে নয়াদিল্লি সফরে যাবেন। সেখানে তিনি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সেখানে হিমালয় সীমান্ত বিরোধ নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। ২০২০ সালে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর এটি হবে দ্বিতীয় বৈঠক।
চলতি মাসের শেষ দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীন সফরে যাচ্ছেন। সেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করবেন। সাত বছরের মধ্যে এটি হবে তাঁর প্রথম চীন সফর। চীনে তিনি সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন।
গত বছরের অক্টোবরে সীমান্ত টহল চুক্তির পর সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বশেষ এসব ঘটনা ঘটছে। পাঁচ বছরের অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির কারণে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও আকাশপথে যোগাযোগ বেশ ব্যাহত হচ্ছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিগত কয়েক সপ্তাহে ভারত-চীনের সম্পর্কে বেশ উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনার মধ্যে এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ট্রাম্প ভারতীয় রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। ওয়াশিংটনের কৌশলগত অংশীদারদের মধ্যে এটি অন্যতম সর্বোচ্চ হার।
অন্যদিকে এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নিজেদের মধ্যে শুল্কযুদ্ধ আরও ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে। ফলে চীনের পণ্যের ওপর সম্ভাব্য তিন অঙ্কের শুল্ক এড়ানো গেছে।
চীন ও ভারত ইতিমধ্যে ২০২০ সাল থেকে স্থগিত থাকা সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু করতে সম্মত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাধা কমানোর বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে হিমালয়ের তিনটি সীমান্তপথে বাণিজ্য আবার চালুর বিষয়ও রয়েছে।
গত অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে ১২ হাজার ৭০৭ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের তুলনায় সীমান্ত বাণিজ্যের পরিমাণ বেশ কম। এরপরও সীমান্তপথ খুলে দেওয়াকে আবার চালু হওয়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নির্ধারিত সব বাণিজ্যপথের মাধ্যমে সীমান্ত বাণিজ্য আবার চালুর বিষয়ে আমরা চীনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’
বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়ন
চীন রয়টার্সকে জানায়, তারা সীমান্ত বাণিজ্য আবার চালু করতে প্রস্তুত। দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সীমান্ত বাণিজ্য ‘গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’ রেখেছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরও বলেন, সরাসরি ফ্লাইট যত দ্রুত সম্ভব আবার চালুর জন্য বেইজিং নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফ্লাইট চালুর বিষয়ে সঠিক সময়সীমা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ইতিমধ্যে ভারতের সরকারি চিন্তন প্রতিষ্ঠান চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য বিনিয়োগের কঠোর নিয়ম শিথিল করার প্রস্তাব দিয়েছে, যা অতিরিক্ত যাচাইয়ের শর্ত তৈরি করেছিল। এটিকে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততায় সম্ভাব্য পরিবর্তনের আরেকটি ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারতের সরকারি চিন্তক প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দিয়েছে, চীনা কোম্পানির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যাচাইয়ের নিয়ম কিছুটা যেন শিথিল করা হয়। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে সম্ভাব্য পরিবর্তনের আরেকটি ইঙ্গিত হিসেবে একে দেখা যাচ্ছে।