শুধু বাহবা নয়, কাঠামো দিন নারীদের ফুটবলে
Published: 8th, July 2025 GMT
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেওয়া শুধু ক্রীড়াক্ষেত্রে একটি বড় অর্জন নয়, এটি নারী জাগরণের প্রতীকও। এই জয় প্রমাণ করে, চেষ্টা থাকলে বাংলাদেশের মেয়েরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা দাপট দেখাতে পারেন। বাহরাইনের মতো ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ৩৬ ধাপ এগিয়ে থাকা দলকে ৭ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারকে তাদেরই মাঠে ২-১ গোলে হারিয়ে নারী এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গড়েছে ইতিহাস। নিজেদের চেয়ে পেছনে থাকা তুর্কমেনিস্তানকেও গুঁড়িয়ে দিয়েছে ৭ গোলে। তিন ম্যাচে ১৬ গোল করে মাত্র একটি হজম—এই পরিসংখ্যান শুধু বিজয়ের নয়; মাঠে প্রতিপক্ষকে শাসনেরও।
দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশকে প্রথমবার এশিয়ার শীর্ষ মঞ্চে নিয়ে গেছেন মেয়েরা। আগামী বছরের মার্চে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে ১২ দলের এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্ব। সেখানে সেরা ছয়ে থাকলে ২০২৭ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার জন্য সরাসরি সুযোগ মিলবে। সেরা আটে থাকলে থাকবে আন্তমহাদেশীয় প্লে-অফে খেলার সুযোগ। বলা চলে, বিশ্বকাপের হাতছানিতে এখন বাংলাদেশ।
এই কৃতিত্ব মেয়েদের। নানা সীমাবদ্ধতা জয় করে তাঁরা এ পর্যায়ে পৌঁছেছেন। মিয়ানমার যাওয়ার আগে তাঁদের ঝুলিতে ছিল টানা দুটি সাফ শিরোপা। এখন যোগ হয়েছে তার চেয়েও বড় অর্জন। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্য, দেশে মেয়েদের জন্য কোনো টুর্নামেন্ট নেই। নিয়মিত লিগ হয় না। সর্বশেষ লিগ হয়েছে ১৩ মাস আগে, সেটিও নামমাত্র। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে) কোনোমতে ধরেবেঁধে কয়েকটা দল এনে লিগ করতে হয়। বড় বড় ক্লাব নারী ফুটবলে আগ্রহী নয়।
মেয়েরা একে একে সাফল্য দিলেও দেশে নারী ফুটবলের কোনো কাঠামোই গড়ে ওঠেনি। শুধু বাফুফে ভবনে দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন ক্যাম্পেই তাঁদের পথচলা। কয়েক বছর আগে এই ক্যাম্পে খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল ৩০ জনের মতো, এখন সেটা ৭০ ছুঁয়েছে। কিন্তু ভবনের আবাসনব্যবস্থা বাড়েনি। উন্নত আবাসন এখন জরুরি।
মেয়েদের আর্থিক দিকটিও রয়ে গেছে ভঙ্গুর। ২০২২ সাফজয়ী দলকে দেড় কোটি টাকা আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছিল প্রথম আলো। মেয়েরা তখন মাসিক বেতনের আওতায় এলেও প্রায়ই তা বকেয়া পড়েছে। এখনো শীর্ষ নারী ফুটবলারদের মাসিক বেতন সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার টাকা। মেয়েরা ম্যাচ ফি পাওয়ার কথা, সেটাও বকেয়া থাকে মাসের পর মাস।
২০২৩ সালে আর্থিক সংকটের অজুহাতে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইয়ে মেয়েদের পাঠায়নি বাফুফে। গত বছর অক্টোবরে সাফ শিরোপা ধরে রেখে ঢাকায় ফেরার পর মেয়েদের জন্য বাফুফে দেড় কোটি টাকার বোনাস ঘোষণা করলেও আট মাসেও তা দেওয়া হয়নি। এমনকি রোববার মধ্যরাতে মেয়েরা দেশে ফেরার পর রাত তিনটায় হাতিরঝিলে যে জমকালো সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাতে হাজারো দর্শকের উচ্ছ্বাস, ডিজিটাল আয়োজন, কর্মকর্তাদের ভাষণ—সব থাকলেও ছিল না শুধু আর্থিক পুরস্কার বা তার ঘোষণা।
বাফুফের উচিত শুধু বকেয়া বোনাস পরিশোধ নয়, মেয়েদের জন্য নতুন আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। লিগ দ্রুত আয়োজন করতে হবে। প্রয়োজন টুর্নামেন্ট এবং শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ। শুধু মুখে বাহবা নয়, বাস্তব পরিকল্পনা ও পদক্ষেপে নারী ফুটবলের পাশে দাঁড়ানো এখন বাফুফের দায়িত্ব। খাবারের মান বাড়ানো, সময়মতো বেতন ও ম্যাচ ফি পরিশোধ করতে হবে। উন্নতির জন্য আরও বিদেশি কোচ আনাও জরুরি।
এই মেয়েরা যদি এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এশিয়ার শীর্ষ স্তরে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে কাঠামোগত সহায়তা পেলে তাঁদের বিশ্বমঞ্চে পৌঁছানো সময়ের ব্যাপার। যতবার তাঁরা মাঠে ইতিহাস গড়েছেন, ততবারই দেশের ফুটবলে সাংগঠনিক নড়বড়ে ছবি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখন দরকার নারী ফুটবলারদের প্রতিশ্রুত ভবিষ্যৎ গড়া।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ টবল র আর থ ক র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
মাধ্যমিকে কর্মবিরতি, বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি
চার দফা দাবিতে দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা গতকাল সোমবার লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এর ফলে ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গতকালের বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে গিয়ে ফিরে যায়।
তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে কর্মচারীদের পাহারায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে তিন দফা দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের একাংশ কর্মবিরতি পালন করছে। গতকাল থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার বলেছেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সরকারি কর্মচারী বিধি লঙ্ঘনের দায়ে তাঁদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় বাসসকে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলনের নামে যা করছেন, তা সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল। সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য আপনাদের কিন্তু তৈরি থাকতে হবে। এখানে সরকার একেবারে দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।’
মাধ্যমিকে কর্মবিরতিবাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৪ অনুযায়ী, সারা দেশে ১৯ হাজার ১১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সাধারণ বা জেনারেল) রয়েছে। এর মধ্যে ৬৩১টি সরকারি। মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৭৯ লাখ। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ৪ লাখ ৮৬ হাজারের বেশি। সরকারি মাধ্যমিকে মোট শিক্ষক ১৩ হাজারের বেশি।
চার দফা দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে। দাবিগুলো হলো—এক. সহকারী শিক্ষক পদকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেট প্রকাশ। দুই. বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষকদের বিভিন্ন শূন্য পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন দ্রুত কার্যকর করা। তিন. সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ দেওয়া। এবং চার. ২০১৫ সালের আগের মতো সহকারী শিক্ষকদের ২ থেকে ৩টি ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বর্ধিত বেতন-সুবিধা বহাল করে গেজেট প্রকাশ।
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দাবির বিষয়ে তাঁরা প্রথমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে শিক্ষকেরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু দাবি না মানায় লাগাতার কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন।
কর্মবিরতির কারণে বিভিন্ন বিদ্যালয় আগের দিন রোববার নোটিশ দিয়ে গতকালের পরীক্ষা স্থগিত করে। আবার শিক্ষার্থীরা গতকাল কোনো কোনো বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে পারে, পরীক্ষা হবে না। রাজধানীর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে পড়ুয়া এক ছাত্রের বাবা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সন্তান বিদ্যালয়ে গিয়েও ফিরে এসেছে। বিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, তাঁরা মৌখিকভাবে পরীক্ষা হবে না বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল আগের দিন রোববার নোটিশ দিয়ে পরীক্ষা না নেওয়ার কথা জানিয়েছে। গতকাল সকালে খুলনার সরকারি করোনেশন গার্লস হাইস্কুলের একজন শিক্ষক জানান, তাঁদের বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হচ্ছে না।
গতকাল সকালে খুলনা জিলা স্কুলের সামনে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সরফুদ্দিন আয়ান বলে, ‘আজ গণিত পরীক্ষা ছিল, তবে হবে না—এটা জানতাম না। এসে দেখি, পরীক্ষা হচ্ছে না।’ তার মতো খুলনার কয়েকটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা একই সমস্যায় পড়ে। তারা বিদ্যালয়ে যাওয়ার পর শিক্ষকদের কর্মবিরতির খবর পায়।
রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে পরীক্ষা না হওয়ার খবর পাঠিয়েছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় এ প্রতিবেদক মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখতে পান, বেশ কিছু ছাত্র রয়েছে বিদ্যালয় চত্বরে। অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্র বলল, তাদের পরীক্ষা হয়েছে। তবে পরীক্ষার হলে গার্ড দিয়েছেন কর্মচারীরা। পরে কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কর্মচারীদের দিয়ে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
তবে শিক্ষকেরা দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা হতে দেননি। বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাহমিনা ইয়াসমিন বলেন, আদিষ্ট হয়ে বিধি মোতাবেক পরীক্ষা কার্যক্রম চলমান রেখেছেন।
সেখান থেকে পাশের মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, সেই বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী গতকাল পরীক্ষা ছিল না।
সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক মোহাম্মদ ওমর ফারুক গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি তাঁদের ডেকে দাবিগুলো পূরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে তাঁরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন। অন্যথায় তাঁদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চলবে।
প্রাথমিকে একাংশের কর্মবিরতিসহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছে প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ। প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে। পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আপাতত ১১তম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় আজ ২ ডিসেম্বর পরীক্ষা বর্জনসহ লাগাতার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে।
অবশ্য গতকাল সকালে ঢাকায় বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যায়। লালবাগ শিক্ষা এলাকার একটি বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক সকালে পরীক্ষা শুরুর কথা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কড়া বার্তা আছে। আর সাধারণত ঢাকার বিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের কর্মসূচি সব সময়ই কম পালিত হয়।