২০২৪ সালের ১৭ জুলাই। বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমে প্রকাশ হলো এক তরুণের ছবি, যিনি দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সামনে এক দল সশস্ত্র পুলিশ। কিছুক্ষণ পর তাদের ছোড়া গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ওই তরুণ। তিনি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদ। ১৬ জুলাই তাঁর মৃত্যুতে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মুখে একই স্লোগানের আওয়াজ ওঠে– ‘আমার ভাই মরলো কেন?’

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে প্রথম শহীদ আবু সাইদের মৃত্যুর এক বছর পর তাঁর স্মৃতি ও মৃত্যু ঘিরে তখন ওঠা নানা প্রশ্ন নিয়ে এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।  শুক্রবার রাজধানীর পান্থপথে দৃকপাঠ ভবনে ‘বুক পেতেছি, গুলি কর: আবু সাঈদ হত্যার পাল্টা ফরেনসিক তদন্ত’ শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্র ও গবেষণালব্ধ ওই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিবরণীতে দাবি করা হয়েছিল, আবু সাঈদ প্রাণ হারিয়েছেন বিক্ষোভকারীদের ছোড়া পাথর ও ‘অজ্ঞাত’ গুলিতে। কিন্তু এই ‘অজ্ঞাত’ ব্যাখ্যাকে ঘিরেই জন্ম নেয় বহু প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া। এরই ভিত্তিতে বাংলাদেশের দৃক পিকচার লাইব্রেরি এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফরেনসিক আর্কিটেকচার যৌথভাবে পরিচালনা করে একটি স্বাধীন ও বিকল্প ফরেনসিক তদন্ত। সেই তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে নির্মাণ হয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্র ও প্রদর্শনী, যা আজ জনসমক্ষে উন্মোচন হয়। চলচ্চিত্র ও প্রদর্শনীতে ব্যবহার করা হয়েছে ফটোগ্রামেট্রি, স্যাটেলাইট চিত্র, হিট ম্যাপ, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার, ছবি ও ভিডিওর মিলিত বিশ্লেষণ। 

এতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার প্রদত্ত ঘটনার বর্ণনার সঙ্গে বাস্তবের রয়েছে গুরুতর অমিল। নানা প্রযুক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বোঝা যায়, আবু সাঈদের ওপর গুলি ছোড়ার পরিস্থিতি ছিল পূর্বপরিকল্পিত, যেখানে পুলিশের অবস্থান, গুলির দিক ও ঘটনার সময়কাল– সবই নির্দেশ করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শক্তি প্রয়োগের দিকে। এমনকি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গবেষকরা। এই ফরেনসিক প্রক্রিয়ায় ঘটনার নানা দিক খুলে যায় নতুন করে, যা শুধু একটি মৃত্যুর তদন্ত নয়, বরং সেই মৃত্যুর চারপাশে গড়ে ওঠা রাজনীতি, ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিচ্ছবি। 

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আলোকচিত্রী ড.

শহিদুল আলম। প্রিমিয়ার শোতে উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। প্রিমিয়ার আয়োজনে আলোচনায় অংশ নেন ফরেনসিক আর্কিটেকচারের বিশেষায়িত গবেষক জুমানাহ বাওয়াজির, প্রযুক্তি গবেষক নিকোলাস অ্যালিস্টার মাস্টারটন, নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল ও দৃকের নেটওয়ার্ক সমন্বয়ক পারভেজ আহমেদ রনি। আলোচনায় অংশ নেন এবং নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেন ১৬ জুলাই আবু সাঈদের মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী দৈনিক কালের কণ্ঠের রংপুর অফিসের ফটোসাংবাদিক গোলজার রহমান আদর, এনটিভির ক্যামেরাম্যান আসাদুজ্জামান আরমান এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাওহিদুল হক সিয়াম। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন এ এস এম রেজাউর রহমান।

সিয়াম তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমি যেমন করে সাইদ ভাইয়ের মাথায় হাত রাখতে পেরেছিলাম লাঠিচার্জের সময় যেন তাঁর মাথায় আঘাত না লাগে, ঠিক তেমনি যদি গুলির সময়ও রক্ষা করতে পারতাম– বারবার আমার এই কথাই মনে হয় এখন।’

আয়োজকরা জানান, এ চলচ্চিত্র এবং প্রদর্শনীর সম্মিলিত আয়োজন একটি চিন্তাশীল অনুসন্ধানী প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যা আবু সাঈদের মৃত্যু এবং এর চারপাশের রাজনৈতিক গতিবিধি সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ তৈরি করে। দর্শকদের জন্য প্রদর্শনীটি চলবে ২৬ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দৃকপাঠ ভবনের লেভেল-২-এ এটি দেখানো হবে।


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ঈদ র তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

সিলেটে অনেক শহীদের পরিবার চরম বিপাকে

‘আমার ভাই তারেক সমাজের বৈষম্য দূর করতে গিয়েছিলেন। আজ পরিবারের সদস্যরা বৈষম্যের শিকার। জুলাই ফাউন্ডেশন বা প্রশাসনের একজন লোকও সরাসরি এসে আমাদের কোনো খবর নেয়নি। তারা ঢাকায় বসে আর্থিক সহায়তার ভাগ করে দিল। মা ২০ ভাগ, আর বউ (তারেকের স্ত্রী) ৮০ ভাগ পাবে। 

এই ভাগবাটোয়ারার কারণে তারেকের স্ত্রী সামিয়া তার সন্তান রাফিকে নিয়ে পিতার বাড়ি চলে গেছেন। আমাদের কষ্ট থাকত না যদি মায়ের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে সমাধান করে দেওয়া হতো। ধৈর্য ধরে আছি, যদি কেউ ফিরে তাকায়।’

আন্দোলনে গিয়ে গত ৫ আগস্ট বিয়ানীবাজার থানার সামনে গুলিতে নিহত তারেক আহমদের বড় বোন বিএ (সম্মান) উত্তীর্ণ তান্নি আক্তার এমন অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন। সাত সদস্যের পরিবারে তারেক ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম। কম বয়সে বিয়ে করেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুারিতে মারা যান বাবা। তাঁর ওপর আরও চাপ বাড়ে। ছয় মাস পর তিনিও (তারেক) প্রাণ হারানোয় পরিবারের সদস্যরা দিশেহারা।

শুধু তারেকের পরিবার নয়, গোলাপগঞ্জে শহীদ তাজউদ্দিন ও সিলেট সদরের ইনাতাবাদ গ্রামের ওয়াসিমের পরিবারসহ অনেক শহীদের পরিবার পড়েছে চরম বিপাকে। এ ছাড়া আর্থিক সহায়তার ভাগ নিয়েও দেখা দিয়েছে বিভক্তি। কোনো কোনো শহীদের পরিবারে বিভক্তি না দেখা দিলেও প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নিয়ে আছে হতাশা। এর মধ্যে শহীদ চার কিশোর ও তরুণের পরিবার সবচেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্ত। তারা এখনও কিছুই পাননি। স্বীকৃতি পাওয়া প্রধান প্রত্যাশা হলেও তা মেলেনি। কবে মিলবে, এর উত্তরও পাচ্ছেন না তারা। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সিলেট নগরীতে সাংবাদিক তুরাবসহ চারজন, জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ছয়জন, বিয়ানীবাজারে তিনজন ও গোয়াইনঘাটে তিনজন মারা যান। সিলেট জেলায় ১৬ জন ছাড়াও জুলাই আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মারা যান জেলার আরও তিনজন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বাড্ডায় মারা যান সিলেট শহরতলির বাসিন্দা ওয়াসিম, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বিয়ানীবাজারের চারখাই কাকুরা গ্রামের সুহেল আহমদ ও হবিগঞ্জ সদরে মারা যান সিলেটের টুকেরবাজারের গৌরীপুরের মোস্তাক আহমদ। তাদের স্বীকৃতি মিললেও সহায়তার ভাগ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। শহীদ পরিবারের অনেকেই ইতোমধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকার চেক ও সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ছাড়াও বিএনপি, জামায়াত এবং সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তি পর্যায়ে অনুদান পাচ্ছেন। 

তবে জেলায় নিহত ১৬ জনের মধ্যে চারজনের ভাগ্যে জোটেনি সহায়তা ও স্বীকৃতি। তারা হলেন– গোয়াইনঘাট সদরের ফেনাই কোনা গ্রামের তরুণ ব্যবসায়ী সুমন মিয়া, পশ্চিম জাফলংয়ের ইসলামবাদ গ্রামের শ্রমিক নাহেদুল, পান্থুমাই গ্রামের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম আহমদ রাহিম ও নগরীর ঝালোপাড়ার নিখিল চন্দ্র করের ছেলে সিএনজি অটোরিকশাচালক পংকজ কুমার কর। তাদের মধ্যে পংকজের নাম তালিকায়ই আসেনি। অন্য তিনজন ৫ আগস্ট স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় মারা যাওয়ার কারণে আপত্তি তোলেন স্থানীয় প্রশাসন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিনিধিরা। তাই তাদের স্বীকৃতি জোটেনি। 

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলার সদস্য সচিব ও সেই সময়ের ছাত্র প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম জানান, মূলত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই করে মতামত দেন। সেখানে তাদের আন্দোলনে নিহত বলে উল্লেখ করা হয়নি। এ নিয়ে মামলা চলছে। 

সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাব ১৯ জুলাই নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় বিএনপির সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যান। তুরাবের মৃত্যুর আগের দিন ১৮ জুলাই শাবিপ্রবির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন মারা যান। 

নগরীতে শহীদদের আরেকজন সিএনজি অটোরিকশাচালক পংকজ কুমার কর। ৫ আগস্ট কোতোয়ালি থানার সামনে গুলিতে মারা যান তিনি। পরদিন তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তাঁর নাম তালিকায়ই আসেনি। এ জন্য তাঁর পিতা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন। একই দিন সিলেট সার্কিট হাউসের সামনে গুলিতে মারা যান পাবেল আহমদ কামরুল। তিনি গোলাপগঞ্জ ঢাকাদক্ষিণের কানিশাইল গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে। জুলাই আন্দোলনে ৪ আগস্ট সবচেয়ে তুমুল সংঘর্ষ হয় গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। ওই দিন বিভিন্ন স্থানে গুলিতে মারা যান ছয়জন। তাদের একজন উপজেলার বারকোট গ্রামের মকবুল আলীর (প্রয়াত) ছেলে তাজউদ্দিন। সরকারি সহায়তার মধ্যে নিজের নামে ১০ লাখ টাকার প্রাইসবন্ড পেয়েছেন।

এ উপজেলার অন্য শহীদরা হলেন– ধারাবহর গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম, রায়গড় গ্রামের সুরাই মিয়ার ছেলে জয় আহমদ (হাসান), ঘোষগাঁওয়ের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন, পশ্চিম দত্তরাইল গ্রামে আলাউদ্দিনের ছেলে মিনহাজ আহমদ ও শিলঘাট লম্বাগাঁও গ্রামের কয়সর আহমদের ছেলে সানি আহমদ। মিনহাজের বড় ভাই আবুল কালাম অভিযোগ করেন, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় গোলাপগঞ্জে কোনো চত্বর বা সৌধ করা যায়নি।

বিয়ানীবাজারে ৫ আগস্ট তারেক ছাড়াও একই দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে গুলিতে মারা যান নয়াগ্রামের ময়নুল ইসলাম ও ফারুক আহমদের ছেলে রায়হান উদ্দিন। সবজি বিক্রেতা নিহত ময়নুলের স্ত্রী শিরিন বেগম একটি ঘরের ব্যবস্থা ও সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য সহায়তা চান।

রাজধানীর বাড্ডায় শহীদ হন সিলেট সদরের ইনাতাবাদ গ্রামের কনর মিয়ার ছেলে ওয়াসিম। জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ৫ লাখ টাকার অনুদান এখনও জোটেনি শহীদ ওয়াসিমের পরিবারে। এর আগে ভাগ নিয়ে বিভক্তি শুরু হয় ওয়াসিমের বড় বোন শীপা বেগমের সঙ্গে। পিতার একাধিক সংসার থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শিপা জানান, তাঁর মা মারা যাওয়ার পর পিতা কনর মিয়া আর কোনো খবর নেননি তাদের।

আর্থিক সহায়তার ভাগ নিয়ে পরিবারে বিভক্তি প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ সমকালকে জানান, বিষয়টি জুলাই ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখছে। শহীদের পরিবারের যারা অসহায় তাদের নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে আবেদন করতে বলেছি।

চারজনের স্বীকৃতি না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুরুর দিকে স্থানীয় তদন্ত ও ছাত্র প্রতিনিধিদের আপত্তির কারণে তাদের নাম তালিকায় ওঠেনি। এ নিয়ে আদালতে নিহতদের পরিবার ও বিজিবির মধ্যে মামলা চলছে। এটা নিষ্পত্তির পরে তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ