মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর
Published: 9th, August 2025 GMT
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে এক বাঙালি যুবক গণপিটুনিতে নিহত হন। পরদিন জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে সহিংসতায় গণপিটুনিতে মারা যান এক পাহাড়ি ব্যক্তি। রাতে জেলা সদরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে দুই পাহাড়ি যুবক নিহত হন। এ ঘটনার জেরে ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে অনিক কুমার চাকমা নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
পাহাড়ে সহিংসতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু গত বছর অনেক দিন পর পাহাড়ে এত বড় সহিংসতা ঘটল।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ওপর নিপীড়নের সংখ্যা কমেনি গত এক বছরে। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নে। যে সংস্কারপ্রক্রিয়া চলছে, সেসবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দাবির প্রতিফলন নেই। পাহাড়ে ভূমি কমিশনের কাজ বন্ধ।
এমন অবস্থায় আজ ৯ আগস্ট পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আদিবাসী মানুষের অধিকার রক্ষা ও ভবিষ্যৎ গড়ার লড়াইয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ভূমিকা’।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সহিংস হামলায় নিহত হন চারজন। এরপর চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে হামলা, জমি দখল, হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা কমেনি।
সংখ্যা বা ধরন যেদিক থেকেই বিচার করুন, আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন মোটেও কমেনি। বিশেষ করে পাহাড়ে সহিংসতার এমন ধরন আগে দেখা যায়নি।কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছেইক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশন গতকাল শুক্রবার চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। সেখানে দেখা গেছে, এ সময়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের ওপর ২৪টি নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২১টি ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, তিনটি সমতলে। ছয়জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দুজন নিহত হয়েছেন।
পাহাড় ও সমতল মিলিয়ে গ্রেপ্তারের পর মৃত্যু, বিনা বিচারে আটক, মারধর, হেনস্তা এবং জোর করে ধর্মান্তরিত করার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ৩৪টি ঘটনা ঘটেছে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংখ্যা বা ধরন যেদিক থেকেই বিচার করুন, আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন মোটেও কমেনি। বিশেষ করে পাহাড়ে সহিংসতার এমন ধরন আগে দেখা যায়নি।’
খাগড়াছড়ি শহরের দুই পাহাড়ি যুবক নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা নিয়ে সদর থানার ওসি আবদুল বাতেন মৃধা বলেন, মামলাটি এখনো তদন্তাধীন।
রাঙামাটিতে প্রকাশ্যে পিটিয়ে নিহত অনিক চাকমার মামলার বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি সাহেব উদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় ৬ জন গ্রেপ্তার আছে। মামলার তদন্ত চলছে।
‘সংস্কারে জায়গা হয়নি’এ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর একটিতে চাকমা সার্কেল প্রধান ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়কে একটি কমিশনে থাকার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। গত বছরের অক্টোবরে এ বিষয়ে দেবাশীষ রায় প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘সংস্কার কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা আমাকে ওই কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর কীভাবে সেই নিয়োগ প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল, সেটা আমি বলতে পারব না।’
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনে যথাক্রমে নিরূপা দেওয়ান ও ইলিরা দেওয়ানকে রাখা হয়। কিন্তু সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি মোটেও সুবিচার করা হয়নি বলে মনে করেন নিরূপা দেওয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনে ‘আদিবাসী’ শব্দটিই নেই। অথচ প্রধান উপদেষ্টা গত বছরের আগস্ট মাসে দেশে এসে এ শব্দ নিজেই উচ্চারণ করেছিলেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি একেবারে উপেক্ষা করা হয়েছে।
রাজধানীর বুকে এমন হামলা হবে তা কোনো দিন ভাবিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আশা ছিল, আমাদের ওপর সহিংসতা কমবে; কিন্তু আচরণে হতাশ হয়েছি।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা ‘সরকারের আচরণে হতাশ হয়েছি’জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঁচ পাতাসহ একটি গাছের গ্রাফিতি পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই পাঁচ পাতার নাম ছিল, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আদিবাসী।’ এতে লেখা ছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে এই গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদ জানিয়ে তা সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে বাঙালিদের (মূলত পাহাড়ের অভিবাসিত) একটি সংগঠন। একপর্যায়ে সেটি সরিয়েও নেয় এনসিটিবি।
এর প্রতিবাদে ঢাকায় থাকা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। ১৫ জানুয়ারি মতিঝিলের এনসিটিবি ভবনের দিকে মিছিল নিয়ে গেলে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হন। তাঁদের একজন রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। পরে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়কও হন। রুপাইয়া বলছিলেন, ‘রাজধানীর বুকে এমন হামলা হবে তা কোনো দিন ভাবিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আশা ছিল, আমাদের ওপর সহিংসতা কমবে; কিন্তু আচরণে হতাশ হয়েছি।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম নব ধ ক র দ র ওপর সরক র র গত বছর প রথম বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
বরিশালে হরিজন সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের উচ্ছেদপ্রক্রিয়ায় স্থিতাবস্থা
বরিশাল সিটি করপোরেশনের হরিজন সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের উচ্ছেদপ্রক্রিয়ায় তিন মাসের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার রুলসহ আদেশ দেন।
‘উচ্ছেদ–আতঙ্কে হরিজন সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা’ শিরোনামে ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটিসহ এ নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী উৎপল বিশ্বাস, সৌমিত্র সরদার, বিপ্লব কুমার পোদ্দার ও হিন্দোল নন্দী সোমবার রিটটি করেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিভাস চন্দ্র বিশ্বাস, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী অনুপ কুমার সাহা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জামিলা মমতাজ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইকরামুল কবির।
অন্যতম রিট আবেদনকারী উৎপল বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের হরিজন সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের কলোনি থেকে উচ্ছেদ করা থেকে বিরত থাকতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে চার আইনজীবী রিটটি করেন। ১৭০ বছর ধরে তাঁরা ওখানে আছে। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দিয়ে উচ্ছেদপ্রক্রিয়ায় তিন মাসের জন্য স্থিতাবস্থার আদেশ দিয়েছেন। ফলে যে যেভাবে আছে, সেভাবে থাকবে, অর্থাৎ আপাতত তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। হরিজন সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া কেন অবৈধ ঘোষণা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।’
প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্ছেদ-আতঙ্কে আছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের হরিজন সম্প্রদায়ের (সুইপার) একটি কলোনির বাসিন্দারা। নগরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাঠপট্টি এলাকার ওই কলোনিতে ৩৯টি সংখ্যালঘু হরিজন পরিবার বসবাস করে। সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, আগামী দুর্গাপূজার পর তাদের এই কলোনি ছেড়ে দিতে হবে। এতে উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন এই কলোনির বাসিন্দারা।
এই উচ্ছেদপ্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে নগর ভবনে গিয়ে কলোনির বাসিন্দারা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাসিন্দাদের দাবি শতাধিক বছর ধরে তাঁরা নগরের কাঠপট্টি এলাকার এই কলোনিতে বসবাস করে নগরের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করছেন। এত বছরেও তাঁদের উচ্ছেদের চেষ্টা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ তাঁদের নতুন জায়গায় যেতে বলা হয়েছে, যা তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।