দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনুন
Published: 7th, October 2025 GMT
কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাতাকান্দি-রায়পুর সড়কে দক্ষিণ আকালিয়া খালের ওপর নির্মাণাধীন সেতুটি এখন ভাঙা হচ্ছে। নির্মাণাধীন অবস্থাতেই সেতু ভেঙে ফেলার এই দৃশ্য আমাদের প্রকৌশল ব্যবস্থার গভীরতম সংকটের প্রতিচ্ছবি।
৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য এই সেতু এখন ত্রুটিপূর্ণ নকশা, ঢালাইয়ের ভুল ও প্রশাসনিক অনিয়মের কারণে অপচয় ও অব্যবস্থাপনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আরও বিস্ময়কর হলো, এই অর্ধসমাপ্ত প্রকল্পের বিপরীতে ইতিমধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি অর্থের ব্যয় ঘটেছে, কিন্তু সেতু পায়নি জনগণ। উল্টো তা ভাঙার কারণে তাঁরা নতুন ভোগান্তির মুখে পড়েছেন।
সরকারের উচিত হবে, এ ঘটনায় কঠোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। কেবল তদন্ত কমিটি গঠন বা দায়সারা প্রতিবেদন নয়। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা ও ঠিকাদারকে আইনের আওতায় আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ রাষ্ট্রীয় অর্থ নিয়ে এমন প্রহসনের দুঃসাহস না দেখায়।এই ব্যর্থতার দায় কোনো একক প্রতিষ্ঠানের নয়। দায় বহন করতে হবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), প্রকল্প-সম্পৃক্ত প্রকৌশলী, তদারক কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান—সবাইকে। কাজের গুণমান যাচাই, নকশার অনুমোদন, বিল পাস—সবই যাঁদের দায়িত্ব ছিল, তাঁদের চোখের সামনে এমন নির্মাণত্রুটি কীভাবে ঘটল? রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত কোনো প্রকল্পে এমন গাফিলতি নিছক পেশাগত ভুল নয়। এটি দায়িত্ববোধের অবক্ষয় ও জবাবদিহিহীন প্রশাসনিক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের মাত্র ৬০ শতাংশ সম্পন্ন করেই বিপুল অঙ্কের বিল তুলে নিয়েছে। এরপর কাজ ফেলে চলে গেছে। নকশা ও নির্মাণের ত্রুটি যাঁরা অনুমোদন করেছেন, তাঁরা অপরাধের অংশীদার। প্রকল্পের অর্থ অপচয় মানে জনগণের রক্তঘাম উপার্জিত সম্পদের অপচয়। এটি অর্থনৈতিক দুর্নীতির পাশাপাশি নৈতিক বিপর্যয়ও বটে।
সরকারের উচিত হবে, এ ঘটনায় কঠোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। কেবল তদন্ত কমিটি গঠন বা দায়সারা প্রতিবেদন নয়। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা ও ঠিকাদারকে আইনের আওতায় আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ রাষ্ট্রীয় অর্থ নিয়ে এমন প্রহসনের দুঃসাহস না দেখায়।
সরকারকে বুঝতে হবে, একটি সেতুর পতন আসলে এক বৃহত্তর নৈতিক পতনের রূপক। দক্ষিণ আকালিয়ার এই সেতু শুধু ভেঙে যায়নি, এই ঘটনা ভেঙে দিয়েছে নাগরিক আস্থা, কৃষকের প্রত্যাশা ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের মেরুদণ্ড। আজ যদি দায় নির্ধারণ ও দণ্ড নিশ্চিত না হয়, তবে কাল হয়তো ভাঙবে আরও বড় কিছু। আর তা হলো রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রকল প র প রক শ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
লক্ষ্মী শুধু বাণিজ্যের নন, সৌন্দর্যেরও প্রতীক
‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’—বাংলার একটি প্রাচীন প্রবাদ। একসময় বাঙালি বণিক সম্প্রদায়ের লোকজন সমুদ্রপথে নৌকা করে দূরদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন বলে এই প্রবাদের সূচনা। এরপর যুগে যুগে সামাজিক, রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক—বহু পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটেছে এই শস্যশ্যামল বঙ্গদেশে। ফলে এই প্রবাদের মূল লক্ষ্যেও পরিবর্তন হয়েছে।
কারণ, কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রারও আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে গত দেড় শ বছরের ইতিহাসে। তবু এই প্রবাদের অন্যতম মূল সূত্র ‘লক্ষ্মী’র লক্ষ্যে আজও নতুন প্রজন্ম আশাবাদী। তাই আজও বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের প্রায় প্রতিটি ঘরেই লক্ষ্মীর আবাহন জারি রয়েছে।
লক্ষ্মী মূলত ধনসম্পদের দেবী। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, সেন বংশের রাজত্বকালে বঙ্গভূমিতে লক্ষ্মীপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তখন বাংলার ঘরে ঘরে শস্যকে লক্ষ্মীর প্রতীকরূপে কলার বেড়কে পূজা করা হতো।
যদিও বাংলার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বস্তুত দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজগরী উৎসবের সহিত লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোন সম্পর্কই ছিল না।’ এ প্রসঙ্গে আরও জানা যায়, লক্ষ্মীর পৃথক প্রতিমাপূজা খুব প্রচলিত নয়। ‘এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি, শস্য-প্রাচুর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘটলক্ষ্মী ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা।’
লক্ষ্মী আসলে শ্রী ও সুরুচির প্রতীক। বৈদিক যুগে মহাশক্তি রূপে পূজিত হলেও আজ তিনি সম্পদ ও সৌন্দর্যের দেবী।
আরও পড়ুনশারদীয় দুর্গোৎসব শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা হয়১৭ অক্টোবর ২০২৪বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে লক্ষ্মীর সমাদর সারা বছর চালু ছিল এবং আছেও। বছরের সব সময়ই এই দেবী পূজিত হন ঘরে ঘরে।
বাঙালি হিন্দু পরিবারের ঘরে উঁকি দিলেই দেখা যাবে লক্ষ্মীর সযত্ন আসনের, যেখানে থাকে একটি ঘট, সিঁদুরের কৌটা, কাঠ বা পিতলের প্যাঁচা, কড়ি, ধানের ছড়া ও দেবীর ছবি। প্রতি বৃহস্পতিবার গৃহস্থ পরিবারের গৃহবধূটি সুর করে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তেন।
তবে নিত্যদিনের এই লক্ষ্মীবরণ ছাড়াও বছরের নানা সময়ে লক্ষ্মীকে বিশেষভাবে পূজা করা হয়। যেমন ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার হয় ভাদ্রলক্ষ্মী পূজা, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, কার্তিকের দীপান্বিতা অমাবস্যায় মহালক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।
আসলে গ্রামবাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতির সঙ্গে লক্ষ্মীপূজার সম্পর্ক গভীর। কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।একইভাবে অঘ্রান, পৌষ ও মকরসংক্রান্তিতেও লক্ষ্মীপূজার আয়োজন হতে দেখা যায়। তবে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে আশ্বিনের শারদপূর্ণিমা তিথির কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার প্রচলন সর্বাধিক।
সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষ এই পূজায় অংশগ্রহণ করেন। আসলে গ্রামবাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতির সঙ্গে লক্ষ্মীপূজার সম্পর্ক গভীর। কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
ফলে লক্ষ্মীপূজার আচার ও রীতি পালনে দেখা যায় ধানের গোলা পর্যন্ত দেওয়া আলপনায় ধানের ছড়া, ধানের শিষের প্রতীকী চিহ্ন, সঙ্গে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। সাধারণত সূর্যাস্তের পর পূর্ণিমা তিথিতেই পূজা করা হয়ে থাকে। একসময় লক্ষ্মীপূজা করা হতো সরা, কলার বেড় ও নবপত্রিকায়।
আরও পড়ুনআলোর উৎসবের দিন দীপাবলি৩১ অক্টোবর ২০২৪প্রতিমাপূজার চল আগে ছিল না। কলার বেড় তৈরি হতো ধান, হলুদ, মানকচু, তুলসী ও আখের ডগা দিয়ে। সেগুলোকে বেড় দিয়ে বেঁধে নতুন বস্ত্র পরিয়ে বেদিতে বসিয়ে পূজা করা হতো।
আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথির এই পূজাকে কেন ‘কোজাগরী’ বলা হয়, তার উত্তরে জানা যায়, কোজাগরী শব্দের ব্যুৎপত্তি ‘কো জাগতি’ থেকে। অর্থাৎ ‘কে জেগে আছ?’ এখানে দেখা যায়, যাঁর ধনসম্পত্তি কিছুই নেই, তিনি পাওয়ার আশায় জাগেন, আর যাঁর ধনসম্পত্তি আছে, তিনি হারানোর ভয়ে জেগে থাকেন। উভয়ের জন্যই রাত জাগা এখানে প্রাধান্য।
বাংলার প্রধান শস্য ধান। ধানের ছড়া তাই লক্ষ্মীর অন্যতম প্রতীক। ধান বা অন্যান্য শস্যজাত খাদ্যের অপচয় তিনি অপছন্দ করেন।শাস্ত্রে বলে, ধনসম্পত্তি ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী এই শারদপূর্ণিমার রাতে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন বাংলার বুকে। তিনি যাঁদের বাড়ির দরজা খোলা পান, তাঁদের ওপর প্রীত হয়ে আশীর্বাদ করেন। বন্ধ দুয়ারের ঘরে তিনি প্রবেশ করেন না। দেবীর আসার অপেক্ষায় গৃহস্থরা রাত জেগে বসে থাকেন।
ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদের অপেক্ষায় থাকা বাঙালি হিন্দুরা তাই রাত জেগে আরাধনা সেরে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। অনেকে মনে করেন, দেবী লক্ষ্মী এই বসুন্ধরাকে ধনধান্যে ভরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পূজা গ্রহণ করতেই মর্ত্যে নেমে আসেন এই সময়ে।
শস্যসম্পদের দেবী যেহেতু লক্ষ্মী, তাই তাঁর বাহনরূপে প্যাঁচার ভূমিকাটির বিশেষ তাৎপর্য আছে বলে প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা মনে করেন। বাংলার প্রধান শস্য ধান। ধানের ছড়া তাই লক্ষ্মীর অন্যতম প্রতীক। ধান বা অন্যান্য শস্যজাত খাদ্যের অপচয় তিনি অপছন্দ করেন।
ধানের খেত বা গোলায় ইঁদুর এই শস্যের খুব ক্ষতি করে। এদিকে প্যাঁচার খাদ্য হলো ইঁদুর। প্যাঁচা তাই ইঁদুর বিনাশ করে খাদ্যশস্য রক্ষায় সহায়তা করে। লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে প্যাঁচার উপস্থিতি তাই তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও পড়ুনধর্ম–সম্প্রদায়ের পরিচয় ছাপিয়ে আনন্দই যেখানে মুখ্য ০১ অক্টোবর ২০২৫