করপোরেট সিএসআর: মানবিক দায়বদ্ধতা নাকি ব্র্যান্ডিংয়ের ছদ্মবেশ
Published: 7th, October 2025 GMT
করপোরেট সিএসআরকে অনেকটা রঙিন আয়নার মতো মনে হয়। বাইরে থেকে যতটা ঝলমলে, ভেতরে ঢুকলে ততটাই ধোঁয়াটে। ক্যামেরার সামনে এক দিনের অনুষ্ঠান, ব্যানারের সামনে ফিতা কাটা, ফটোসেশনে শিশুদের হাসি—সব মিলিয়ে এক চমৎকার পোস্টার তৈরি হয়। কিন্তু আয়নার ওপাশে কি থাকে? ভাঙা বেঞ্চে বসে থাকা স্কুলপড়ুয়া, গ্রামে চিকিৎসকের অভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি, কিংবা এককালীন সাহায্য পেয়ে পরদিন আবার হতাশায় ডুবে যাওয়া মানুষ। প্রশ্নটা তাই—সিএসআর কি সত্যিই মানুষের পাশে দাঁড়ানো, নাকি ব্র্যান্ডিংয়ের সোনালি মোড়ক?
করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) মূলত ব্যবসার মুনাফা আর সমাজের দায়িত্বকে একসঙ্গে ভাবার একটি কাঠামো। দানশীলতার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো—এটা কৌশলগত, নিয়মতান্ত্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদি হওয়া উচিত। বাংলাদেশে বড় করপোরেটগুলো প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান, স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা, দুর্যোগকালে ত্রাণ বা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নিয়ে থাকে। তবে বাস্তব চিত্রে দেখা যায়—অনেক সময় এগুলো এককালীন, ছবি তোলার মতো আয়োজন, যেগুলোর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে সিএসআরের রঙিন চিত্র থাকলেও সমাজে সেই পরিবর্তনের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ঢাকার এক এনজিও কর্মীর ভাষায়, ‘করপোরেটরা স্কুলে বই দিলেও পরের বছর সেই বইয়ের ধারাবাহিকতা থাকে না।’ গ্রামীণ শিক্ষকেরা বলেন, কোম্পানি কম্পিউটার রুম বানিয়ে দিলেও রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় এক বছরের মধ্যেই সব ভেঙে যায়। স্বাস্থ্য ক্যাম্পে এক দিন বিনা মূল্যে চিকিৎসা হলেও রোগীরা আবার পরদিন আগের মতোই অবহেলায় পড়ে থাকে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কিছু কোম্পানি বহু বছর ধরে বৃত্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে; কারও কারও উদ্যোগে গ্রামে টেকসই পানির সরবরাহ তৈরি হয়েছে; অর্থাৎ চিত্রটা একরকম নয়; কারও কাছে এটা দায়বদ্ধতার প্রয়াস, আবার কারও কাছে নিছক প্রচারণা।
এখানে কয়েকটি কারণ স্পষ্ট। প্রথমত, সিএসআরের বেশির ভাগ কর্মকাণ্ড মার্কেটিং টুলে পরিণত হয়েছে। লোগোসহ ছবি, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, মিডিয়ায় প্রচার—এসব দ্রুত ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ায়। যখনই কোনো দুর্যোগ হয়, তখন আমরা দেখি ব্যানার ঝুলিয়ে ট্রাকে ট্রাকে চাল-ডাল বিলানো হচ্ছে। সাহায্যের চেয়ে ক্যামেরায় ধরা পড়াটাই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছতা ও তৃতীয় পক্ষ মূল্যায়নের অভাব। প্রকৃত প্রভাব কেমন হলো—এটা খুব কমই প্রকাশিত হয়। কোনো প্রকল্পে ৫০ লাখ টাকা খরচ হলো বলে কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেখা গেল, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে কতজনের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন এসেছে, তা প্রায় অজানা থেকে যায়।
তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বদলে সহজ সমাধান বেছে নেয় কোম্পানিগুলো। এক দিনের ক্যাম্প করা সহজ; কিন্তু টেকসই স্বাস্থ্যসেবা চালু করা কঠিন। ফলে মানুষ এক দিনের চিকিৎসা পেলেও আবার একই দুরবস্থায় ফিরে যায়। চতুর্থত, কর নীতির সুযোগ ও নিয়ন্ত্রণহীনতা। সরকার যদি প্রকল্পগুলো যাচাই না করে, তবে করপোরেটরা নিজেদের সুবিধামতো সিএসআরের ছবি আঁকতে পারে। এ অবস্থায় সিএসআরের আড়ালে করছাড়ের সুযোগ নেওয়াই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চমত, ব্যবসার ভেতরে সিএসআরকে আলাদা বিভাগে আটকে রাখা হয়, কোর বিজনেস নীতিতে ঢোকানো হয় না। ফলে এটা থাকে বাইরের রংচটা আচ্ছাদন, আসল ব্যবসার ভেতরে যায় না। যেমন একটি কোম্পানি বাইরে বৃক্ষরোপণ করছে, কিন্তু ভেতরে তাদের কারখানা থেকে নদীতে বর্জ্য ফেলছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই চিত্র বদলানো যায়? প্রথমত, স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পের খরচ, উপকারভোগীর সংখ্যা, প্রভাবের মাত্রা খোলাখুলি প্রকাশ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে—স্বাধীন অডিট ছাড়া প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বে এটাই নিয়ম, বাংলাদেশেও সেই ব্যবস্থা আনা দরকার। তৃতীয়ত, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের পরিকল্পনা যদি তাদের প্রয়োজন বুঝে করা হয়, তবে সেটি স্থায়ী হয়। গ্রামে কম্পিউটার রুম বানানোর আগে দেখা দরকার, ওখানে বিদ্যুতের সরবরাহ আছে কি না, শিক্ষকেরা প্রশিক্ষিত কি না।
চতুর্থত, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে—শিক্ষায় বৃত্তি, টেকসই স্বাস্থ্যসেবা, নারীর কর্মসংস্থান, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ এগুলো প্রকৃত পরিবর্তন আনে। একটি স্কুলে এক দিন বই দান করলে তা সংবাদে জায়গা পায়, কিন্তু ধারাবাহিক বৃত্তি দিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছে দেওয়া সমাজে সত্যিকারের প্রভাব ফেলে। পঞ্চমত, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজকে আরও সক্রিয় হতে হবে। শুধু ছবি নয়, মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান প্রকাশ করতে হবে। সমাজের মানুষ জানতে চায়, কোন প্রকল্প সত্যিই তাদের কাজে এসেছে, আর কোনটা নিছক প্রচারণা। ষষ্ঠত, সরকারেরও উচিত বাধ্যতামূলক রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড ও অডিট সিস্টেম চালু করা।
আজকের দিনে সিএসআরের গল্প যখন সামনে আসে, তখন শুধু ছবি দিয়ে প্রচার নয়, প্রশ্নও রাখা উচিত, ‘কতদিন টিকবে এই প্রকল্প?’, ‘কারা সত্যিকারে উপকৃত হলো?’, ‘কোম্পানি কি লাভের বাইরে সমাজের দায় নিচ্ছে?’ কারণ, সিএসআর যদি শুধুই প্রচার হয়, তবে তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর; এতে মানুষের আশা তৈরি হয়, পরে হতাশায় ভাঙে। এর ফলে জনগণের করপোরেটদের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়, সমাজে হতাশা জন্ম নেয়। অথচ ব্যবসা আর সমাজের সম্পর্কটা পরস্পর নির্ভরশীল। সমাজ উন্নত না হলে ব্যবসাও দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই প্রকৃত দায়বদ্ধতাই ব্যবসার জন্য লাভজনক।
একটি দেশের করপোরেট সংস্কৃতি যত বেশি দায়বদ্ধতার চর্চা করবে, তত দ্রুত সমাজ এগোবে। আজ যদি কোম্পানিগুলো মুনাফার একটি অংশ সত্যিকার অর্থে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ বা কর্মসংস্থানে ব্যয় করে, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভিত্তি তৈরি হবে। কিন্তু যদি সবকিছুই প্রচারের জন্য হয়, তবে সমাজ যেমন বঞ্চিত হবে, ব্যবসার ভাবমূর্তিও আস্তে আস্তে নষ্ট হবে। সিএসআরের আসল শক্তি এখানেই—এটা সমাজের জন্য যেমন জরুরি, তেমনি কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি অস্তিত্বের জন্যও অপরিহার্য।
অতএব, সিএসআরকে কেবল ব্র্যান্ডিংয়ের আয়না না বানিয়ে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাই আজকের দিনের চ্যালেঞ্জ। সিএসআরের নামে ‘তামাশা’ হলে মানুষ একদিন তা চিনে ফেলবেই। কিন্তু যদি আন্তরিক উদ্যোগ থাকে, তবে সিএসআর হতে পারে বাংলাদেশের উন্নয়নের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।
মো.
রিশাদ আহমেদ, শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: করপ র ট স স এসআর র প রকল প ব যবস র উদ য গ এক দ ন প রক ত র জন য ট কসই
এছাড়াও পড়ুন:
করপোরেট সিএসআর: মানবিক দায়বদ্ধতা নাকি ব্র্যান্ডিংয়ের ছদ্মবেশ
করপোরেট সিএসআরকে অনেকটা রঙিন আয়নার মতো মনে হয়। বাইরে থেকে যতটা ঝলমলে, ভেতরে ঢুকলে ততটাই ধোঁয়াটে। ক্যামেরার সামনে এক দিনের অনুষ্ঠান, ব্যানারের সামনে ফিতা কাটা, ফটোসেশনে শিশুদের হাসি—সব মিলিয়ে এক চমৎকার পোস্টার তৈরি হয়। কিন্তু আয়নার ওপাশে কি থাকে? ভাঙা বেঞ্চে বসে থাকা স্কুলপড়ুয়া, গ্রামে চিকিৎসকের অভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি, কিংবা এককালীন সাহায্য পেয়ে পরদিন আবার হতাশায় ডুবে যাওয়া মানুষ। প্রশ্নটা তাই—সিএসআর কি সত্যিই মানুষের পাশে দাঁড়ানো, নাকি ব্র্যান্ডিংয়ের সোনালি মোড়ক?
করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) মূলত ব্যবসার মুনাফা আর সমাজের দায়িত্বকে একসঙ্গে ভাবার একটি কাঠামো। দানশীলতার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো—এটা কৌশলগত, নিয়মতান্ত্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদি হওয়া উচিত। বাংলাদেশে বড় করপোরেটগুলো প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান, স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা, দুর্যোগকালে ত্রাণ বা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নিয়ে থাকে। তবে বাস্তব চিত্রে দেখা যায়—অনেক সময় এগুলো এককালীন, ছবি তোলার মতো আয়োজন, যেগুলোর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে সিএসআরের রঙিন চিত্র থাকলেও সমাজে সেই পরিবর্তনের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ঢাকার এক এনজিও কর্মীর ভাষায়, ‘করপোরেটরা স্কুলে বই দিলেও পরের বছর সেই বইয়ের ধারাবাহিকতা থাকে না।’ গ্রামীণ শিক্ষকেরা বলেন, কোম্পানি কম্পিউটার রুম বানিয়ে দিলেও রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় এক বছরের মধ্যেই সব ভেঙে যায়। স্বাস্থ্য ক্যাম্পে এক দিন বিনা মূল্যে চিকিৎসা হলেও রোগীরা আবার পরদিন আগের মতোই অবহেলায় পড়ে থাকে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কিছু কোম্পানি বহু বছর ধরে বৃত্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে; কারও কারও উদ্যোগে গ্রামে টেকসই পানির সরবরাহ তৈরি হয়েছে; অর্থাৎ চিত্রটা একরকম নয়; কারও কাছে এটা দায়বদ্ধতার প্রয়াস, আবার কারও কাছে নিছক প্রচারণা।
এখানে কয়েকটি কারণ স্পষ্ট। প্রথমত, সিএসআরের বেশির ভাগ কর্মকাণ্ড মার্কেটিং টুলে পরিণত হয়েছে। লোগোসহ ছবি, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, মিডিয়ায় প্রচার—এসব দ্রুত ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ায়। যখনই কোনো দুর্যোগ হয়, তখন আমরা দেখি ব্যানার ঝুলিয়ে ট্রাকে ট্রাকে চাল-ডাল বিলানো হচ্ছে। সাহায্যের চেয়ে ক্যামেরায় ধরা পড়াটাই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছতা ও তৃতীয় পক্ষ মূল্যায়নের অভাব। প্রকৃত প্রভাব কেমন হলো—এটা খুব কমই প্রকাশিত হয়। কোনো প্রকল্পে ৫০ লাখ টাকা খরচ হলো বলে কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেখা গেল, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে কতজনের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন এসেছে, তা প্রায় অজানা থেকে যায়।
তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বদলে সহজ সমাধান বেছে নেয় কোম্পানিগুলো। এক দিনের ক্যাম্প করা সহজ; কিন্তু টেকসই স্বাস্থ্যসেবা চালু করা কঠিন। ফলে মানুষ এক দিনের চিকিৎসা পেলেও আবার একই দুরবস্থায় ফিরে যায়। চতুর্থত, কর নীতির সুযোগ ও নিয়ন্ত্রণহীনতা। সরকার যদি প্রকল্পগুলো যাচাই না করে, তবে করপোরেটরা নিজেদের সুবিধামতো সিএসআরের ছবি আঁকতে পারে। এ অবস্থায় সিএসআরের আড়ালে করছাড়ের সুযোগ নেওয়াই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চমত, ব্যবসার ভেতরে সিএসআরকে আলাদা বিভাগে আটকে রাখা হয়, কোর বিজনেস নীতিতে ঢোকানো হয় না। ফলে এটা থাকে বাইরের রংচটা আচ্ছাদন, আসল ব্যবসার ভেতরে যায় না। যেমন একটি কোম্পানি বাইরে বৃক্ষরোপণ করছে, কিন্তু ভেতরে তাদের কারখানা থেকে নদীতে বর্জ্য ফেলছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই চিত্র বদলানো যায়? প্রথমত, স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পের খরচ, উপকারভোগীর সংখ্যা, প্রভাবের মাত্রা খোলাখুলি প্রকাশ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে—স্বাধীন অডিট ছাড়া প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বে এটাই নিয়ম, বাংলাদেশেও সেই ব্যবস্থা আনা দরকার। তৃতীয়ত, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের পরিকল্পনা যদি তাদের প্রয়োজন বুঝে করা হয়, তবে সেটি স্থায়ী হয়। গ্রামে কম্পিউটার রুম বানানোর আগে দেখা দরকার, ওখানে বিদ্যুতের সরবরাহ আছে কি না, শিক্ষকেরা প্রশিক্ষিত কি না।
চতুর্থত, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে—শিক্ষায় বৃত্তি, টেকসই স্বাস্থ্যসেবা, নারীর কর্মসংস্থান, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ এগুলো প্রকৃত পরিবর্তন আনে। একটি স্কুলে এক দিন বই দান করলে তা সংবাদে জায়গা পায়, কিন্তু ধারাবাহিক বৃত্তি দিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছে দেওয়া সমাজে সত্যিকারের প্রভাব ফেলে। পঞ্চমত, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজকে আরও সক্রিয় হতে হবে। শুধু ছবি নয়, মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান প্রকাশ করতে হবে। সমাজের মানুষ জানতে চায়, কোন প্রকল্প সত্যিই তাদের কাজে এসেছে, আর কোনটা নিছক প্রচারণা। ষষ্ঠত, সরকারেরও উচিত বাধ্যতামূলক রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড ও অডিট সিস্টেম চালু করা।
আজকের দিনে সিএসআরের গল্প যখন সামনে আসে, তখন শুধু ছবি দিয়ে প্রচার নয়, প্রশ্নও রাখা উচিত, ‘কতদিন টিকবে এই প্রকল্প?’, ‘কারা সত্যিকারে উপকৃত হলো?’, ‘কোম্পানি কি লাভের বাইরে সমাজের দায় নিচ্ছে?’ কারণ, সিএসআর যদি শুধুই প্রচার হয়, তবে তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর; এতে মানুষের আশা তৈরি হয়, পরে হতাশায় ভাঙে। এর ফলে জনগণের করপোরেটদের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়, সমাজে হতাশা জন্ম নেয়। অথচ ব্যবসা আর সমাজের সম্পর্কটা পরস্পর নির্ভরশীল। সমাজ উন্নত না হলে ব্যবসাও দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই প্রকৃত দায়বদ্ধতাই ব্যবসার জন্য লাভজনক।
একটি দেশের করপোরেট সংস্কৃতি যত বেশি দায়বদ্ধতার চর্চা করবে, তত দ্রুত সমাজ এগোবে। আজ যদি কোম্পানিগুলো মুনাফার একটি অংশ সত্যিকার অর্থে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ বা কর্মসংস্থানে ব্যয় করে, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভিত্তি তৈরি হবে। কিন্তু যদি সবকিছুই প্রচারের জন্য হয়, তবে সমাজ যেমন বঞ্চিত হবে, ব্যবসার ভাবমূর্তিও আস্তে আস্তে নষ্ট হবে। সিএসআরের আসল শক্তি এখানেই—এটা সমাজের জন্য যেমন জরুরি, তেমনি কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি অস্তিত্বের জন্যও অপরিহার্য।
অতএব, সিএসআরকে কেবল ব্র্যান্ডিংয়ের আয়না না বানিয়ে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাই আজকের দিনের চ্যালেঞ্জ। সিএসআরের নামে ‘তামাশা’ হলে মানুষ একদিন তা চিনে ফেলবেই। কিন্তু যদি আন্তরিক উদ্যোগ থাকে, তবে সিএসআর হতে পারে বাংলাদেশের উন্নয়নের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।
মো. রিশাদ আহমেদ, শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা