অ্যানথ্রাক্স কী, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়
Published: 11th, October 2025 GMT
রংপুর ও গাইবান্ধা অঞ্চলে সম্প্রতি আবারও দেখা দিয়েছে অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাব। গবাদিপশুর শরীরে এই ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ ও শঙ্কা। পশুপালক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবার মনেই প্রশ্ন, কতটা ভয়াবহ হতে পারে এই রোগ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্স কোনো নতুন বা দুর্বোধ্য রোগ নয়। এটি বহু পুরনো, বৈজ্ঞানিকভাবে সুপরিচিত এবং প্রতিরোধযোগ্য একটি সংক্রমণ, যা সচেতনতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আতঙ্কিত না হয়ে প্রয়োজন গঠনমূলক পদক্ষেপ।
অ্যানথ্রাক্স কী: অ্যানথ্রাক্স হলো ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত রোগ। এটি মূলত প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়। এই জীবাণু মাটিতে বছরের পর বছর ধরে সক্রিয় থাকতে পারে স্পোর (অর্থাৎ ঘুমন্ত ব্যাকটেরিয়া) আকারে। যখন গবাদিপশু এই জীবাণুযুক্ত ঘাস বা খাবার গ্রহণ করে, তখন তারা সংক্রমিত হয়। পশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো বা সংক্রমিত মাংস খাওয়ার মাধ্যমে এই জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এলে বা সংক্রমিত মাংস ও চামড়াজাত পণ্য ব্যবহারে মানুষও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতি: রংপুর জেলার পীরগাছা, কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে ১১ জনের দেহে। এর মধ্যে পীরগাছায় আটজন, কাউনিয়ায় দুইজন এবং মিঠাপুকুরে একজন আক্রান্ত হয়েছেন। পাশাপাশি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জেও অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যেখানে মৃত গরুর মাংস কেটে বিক্রির পর ১১ জন আক্রান্ত হন।
সরকারি সূত্রে জানা যায়, রংপুর ও গাইবান্ধা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৭ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে।
অন্যদিকে, স্থানীয়দের অভিযোগ, গত দুই মাসে শতাধিক গবাদিপশু এই রোগে মারা গেছে। পীরগাছায় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত ৫০ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন, যাদের ৯০ শতাংশই সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু আতঙ্কের বশে অনেকেই গরু-ছাগলের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, গরুর মাংস খাওয়াও এড়িয়ে চলছেন। ফলে স্থানীয় খামার ও মাংস ব্যবসায় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
সরকারি উদ্যোগ: সংক্রমণ রোধে সরকারের তরফ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলায় ২০ লাখ ডোজ টিকা বরাদ্দ। রংপুর জেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার গবাদিপশুকে টিকাদান সম্পন্ন। মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো।
মৃত পশুকে গভীরভাবে পুঁতে ফেলার বা দাহ করার নির্দেশনা। পশুর মাংস বিক্রির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অনুমতির ব্যবস্থা।
কীভাবে ছড়ায়: অ্যানথ্রাক্স মানুষের শরীরে তিনটি মূল উপায়ে সংক্রমিত হতে পারে:
১.
আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এলে বা খোলা ক্ষতের মাধ্যমে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে হয়। লক্ষণ: ফোস্কা, পোড়া দাগ, কালো ক্ষত।
২. পরিপাকতন্ত্রীয় অ্যানথ্রাক্স (খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে)
অপরিষ্কৃত বা অর্ধসিদ্ধ মাংস খাওয়ার ফলে সংক্রমণ ঘটে। লক্ষণ: পেট ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, রক্তবমি।
৩. শ্বাসতন্ত্রীয় অ্যানথ্রাক্স (শ্বাসের মাধ্যমে)
চামড়া প্রক্রিয়াকরণের সময় বাতাসে ভেসে থাকা স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রবেশ করলে হয়। লক্ষণ: জ্বর, গলা ব্যথা, ফুসফুস প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: অ্যানথ্রাক্স মানুষ থেকে মানুষে সরাসরি ছড়ায় না, এটি শুধু আক্রান্ত প্রাণী বা তাদের দেহবস্তুর সংস্পর্শে এলেই সংক্রমণ ঘটে।
ভয় নয়, ব্যবস্থা নিন: রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মৃত বা অসুস্থ পশু জবাই করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো মাংস বিক্রির আগে নিশ্চিত করতে হবে সেটি নিরাপদ কি না।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ নওশের আলম বলেন, “ ভীতি নয়, সতর্কতা জরুরি। যথাযথ টিকা, পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি মানলেই এই রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। চিকিৎসাও সহজ, মৃত্যু খুবই কম। তবে স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে একসাথে কাজ করতে হবে।”
রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা: প্রাথমিক অবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক ও জীবাণুনাশক মলম কার্যকর। জটিল হলে হাসপাতালে ভর্তি করে এন্টিটক্সিন থেরাপি ও সাপোর্টিভ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
রোগ শনাক্তে ত্বকের নমুনা, রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান, ব্যাকটেরিয়া কালচার করা হয়ে থাকে।
প্রতিরোধে করণীয়: গবাদিপশুর নিয়মিত টিকা নিশ্চিত করা। অসুস্থ বা মৃত পশুর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। মৃত পশু গভীরভাবে পুঁতে ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলা। আক্রান্ত পশুর মাংস খাওয়া বা বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা। সব মাংস ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপে সিদ্ধ করে খাওয়া। পশুশ্রমিক, কসাই, খামারকর্মীদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা।স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান জোরদার করা।
ভুল ধারণা: অ্যানথ্রাক্স ছোঁয়াচে নয়। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শই মূল ঝুঁকি। ত্বকীয় রূপ দ্রুত চিকিৎসা পেলে সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। ফ্রিজে রাখা মাংস জীবাণুমুক্ত নয়। রান্না করা মাংস নিরাপদ, যদি সঠিকভাবে সেদ্ধ করা হয়
এবিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক কর্মকর্তা বলেন, “রংপুর বিভাগজুড়ে ১ হাজার ৩০৩টি হাট-বাজার থাকলেও কোথাও নেই আধুনিক কসাইখানা কিংবা সরকারি ভেটেরিনারি সার্জন। অথচ প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার পশু জবাই হলেও হয় না কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষা। এই ঘাটতির সুযোগেই বাজারে ঢুকে পড়ছে সংক্রমিত মাংস।”
তিনি বলেন, “আক্রান্ত পশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শ থেকে অ্যানথ্রাক্স মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এজন্য খামার থেকে বাজার পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নজরদারি বাড়াতে হবে।”
স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মাহবুর রহমান বলেন, “অ্যানথ্রাক্স আতঙ্কিত হওয়ার মতো রোগ নয়, তবে অবহেলা করলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। সময়মতো টিকা, সচেতনতা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সরকারি নির্দেশনা মেনে চললে রোগটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।”
ঢাকা/এএএম/ইভা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ব স থ য পর ক ষ কর মকর ত স ক রমণ ব যবস থ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করুন
অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ও অতিরিক্ত ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পর্যবেক্ষণে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৯৬ হাজার রোগীর নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে মিলেছে, ৪১ শতাংশ আইসিইউ রোগীর ক্ষেত্রে প্রচলিত কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। সব মিলিয়ে ৭ শতাংশ রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী প্যান-ড্রাগ-রেজিট্যান্স বা পিডিআর পাওয়া গেছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেই স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারক, চিকিৎসক ও নাগরিকদের জন্য এখনই সজাগ হওয়ার জন্য সতর্কবার্তা।
গত শতকের বিশের দশকে অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তর সৃষ্টি করেছিল। মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে কমানো ও গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ভূমিকা সর্বাগ্রে। শিশু, বৃদ্ধ, দুর্বল ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতাহীন মানুষের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক জীবন রক্ষাকারী। এ ছাড়া কাটাছেঁড়া, অগ্নিদগ্ধ, অস্ত্রোপচারের রোগীদের জীবন রক্ষায় অ্যান্টিবায়োটিক ভূমিকা রাখে। কিন্তু কঠিন অসুখ হলেও অ্যান্টিবায়োটিকের কল্যাণে রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে—এই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা কমে আসছে। ফলে অণুজীব ও জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। চরম ক্ষমতাধর এসব জীবাণুকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় সুপারবাগ—সাক্ষাৎ এই মৃত্যুদূত বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যবিদদের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের মতো অত্যধিক জনবহুল ও অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবার একটি দেশে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা কমে আসার ঝুঁকি অনেক বেশি। মহামারির চেয়েও বড় স্বাস্থ্যগত বিপদ আসন্ন জেনেও আমরা এখন পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কোনো নীতিমালা করতে পারিনি। ফলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসাপত্র ছাড়াই পাড়ার মোড়ের ফার্মেসিগুলোতে দেদার অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। চিকিৎসাসেবা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক নেন, আবার অনেক চিকিৎসকও প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেন। অ্যান্টিবায়োটিকের এই অপ্রয়োজনীয় ও অতিব্যবহারই জীবাণুকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী করে তুলছে।
কৃষি, গবাদিপশু, মুরগি, ডিম ও মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণহীন ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করছেন খামারিরা। খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করছে এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর তার প্রভাব গিয়ে পড়ছে। ফলে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
আইইডিসিআরের গবেষকেরা সতর্ক করেছেন, আন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বর্তমানে দেশে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এটিকে তাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি বলে শনাক্ত করেছেন। এখনই নিয়ন্ত্রণমূলক ও কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এক দশকের মধ্যেই চিকিৎসা খাতে বড় সংকট তৈরি হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাস্থ্যের নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যকর্মী ও জনসাধারণের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতার বড় ধরনের ঘাটতি আছে। এই বিপদ এড়ানোর একমাত্র পথ হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমানো।
অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি এটি ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। ফার্মেসিগুলোকে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা প্রয়োজন। গবাদিপশু, মাছ, মুরগি উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিকের ঢালাও ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।