পুরো মাঠের ফসল যখন ঘরে উঠে আসে, তখন হয় ঘোড়দৌড় আর ঘুড়ি ওড়ানো মেলা। ঘুড়ি যেন নেশার মতো টানত—মৃধা দাদু স্মৃতির দুয়ার খুলে একটু যেন নড়েচড়ে বসলেন।
মনের মধ্যে ভাঙাচোড়ার সুর বুঝতে পারলাম।
মৃধা দাদু সম্পর্কে শুধু আমার বা আমাদের দাদু নন, বরং আমার বন্ধুদের, বন্ধুদের বন্ধুরও দাদু তিনি। সব সময় দুষ্টুমি আর ইয়ার্কিচ্ছলে মিশে আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটি সেভাবে গড়ে নেন তিনি নিজেই। দেখা হলেই দাদু বলে একটু হলেও দুষ্টুমি, ইয়ার্কি করবেনই। অমায়িক ব্যবহার আর আচরণের জন্য আমাদের সবার প্রিয় তিনি। লম্বায় ছয় ফুট উচ্চতা ছাড়িয়ে। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। বলা যায় গ্রামের মুরব্বিদের মুরব্বি এই মৃধা দাদু। পুরো নাম আবুল হোসেন মৃধা। এলাকায় তাঁর সমবয়সী লোক খুব কমই বেঁচে আছেন। মুখে বেশ লম্বা দাড়িতে মেহেদি লাগিয়ে লাল করে রাখেন দাদু, যে কারণে চেহারায় কমলার উজ্জ্বল হলদে আভা তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোট ছিলেন না, প্রায়ই যুদ্ধের সময়ের বেশ কিছু স্মৃতি বর্ণনা করেন। তাঁর মুখে যেকোনো গল্প বাচনভঙ্গির কারণে চমৎকার হয়ে ওঠে। খুব মিশুক আর তেজি মানুষ মৃধা দাদু। এখনো বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি মোটেই। কথা ও শরীর দুটোই সামর্থ্যবানের মতো। এলাকার কলেজ, কেন্দ্রীয় ইদগাহ ও গ্রামের মসজিদের সভাপতি ছিলেন। এখন বয়স হয়েছে, মসজিদে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান। মসজিদে আজান দেন পাঁচ ওয়াক্ত। কেউ মারা গেলে মাইকে ঘোষণা দেন—শোক সংবাদ, শোক সংবাদ, বাঁশো গ্রামনিবাসী, কবিয়াল মোকসেদ মোল্যার বড় পুত্র.
মসজিদের মাইকে গুরুত্বপূর্ণ মাসলা মাসায়েল পড়েন শবে বরাত বা ঈদে মিলাদুন্নবীতে। রমজান মাসে সাহরিতে সবাইকে ডেকে তোলেন ঘুম থেকে। মাইকে কোরআন তিলাওয়াত ও গজল শোনান মুঠোফোনের মাধ্যমে। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মসজিদের নতুন নির্মিত ভবনের টাকা উত্তোলনের আলোচনায় দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমি আবুল হোসেন মৃধা। মসজিদের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান মুয়াজ্জিন। রোজ কিয়ামতের দিন সব ধ্বংস হয়ে গেলেও মসজিদ ধ্বংস হবে না...’
এলাকার নানা স্মৃতি ও গল্প মৃধা দাদুর কাছ থেকে আমরা পাই। রসিয়ে সেসব গল্পের বাস্তবসম্মত বর্ণনা দেন তিনি। তাঁর শৈশবের, যৌবনের নানা গল্প রয়েছে। সেসব গল্পে তিনি নায়ক, বাস্তবেও তিনিই নায়ক। মৃধা দাদুর বাড়ি ঘেঁষে আছে একটা প্রকাণ্ড বাগান। বনবাঁদাড়ে যেমন গাছ থাকে, তেমনই। কোনো নির্দিষ্ট গাছ নয়, হরেক রকম গাছ। বনবিড়াল, বেজি, শিয়াল, সাপ নিজেদের মতো বাস করে, খেলা করে, বাসা বানায়, বাসা ভাঙে এই বাগানে। পাখিদের কিচিরমিচির সমান্তরাল চলে। দিনের বেলায়ও দুর্বল হৃদয়ের মানুষ এই বাগানে একা যেতে ভয় পায়। ভূতের ভয়, সাপখোপের ভয়, জিন–পরির ভয়। তবু যে মানুষের একেবারেই আনাগোনা নেই বাগানের মধ্যে, তেমনটাও নয়।
বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। বলা যায় গ্রামের মুরব্বিদের মুরব্বি এই মৃধা দাদু। এলাকায় তাঁর সমবয়সী লোক খুব কমই বেঁচে আছেন। মুখে বেশ লম্বা দাড়িতে মেহেদি লাগিয়ে লাল করে রাখেন দাদু, যে কারণে চেহারায় কমলার উজ্জ্বল হলদে আভা তৈরি হয়। খুব মিশুক আর তেজি মানুষ মৃধা দাদু।বাগানের ভেতর দিয়ে পায়ে চলার মতো ছোট্ট একটা পথ রয়েছে। গ্রামের মানুষেরা বাগানে পাতা কুড়ায়, ডাল ভেঙে রান্নার খড়ি বানায়। মরা গাছপালা কেটে নিয়ে যায়। পাখি শিকার করতে আসে অনেকেই। বাগানটা নোংরা নয়, যে কারণে শিশুরা একসঙ্গে ফুল ছিঁড়তে যায়। বেতফল, কায়োজাঙাল, ড্যাপল, ডেউয়া, বঁইচি, খুদে জাম খেতে যায়। খেলনার অনুষঙ্গ কুড়াতে যায়। কেউ বেলি ফুল, ঘাসফুল, জাম, খেজুর, ভেন্না খুঁজে কুড়িয়ে নেয়। খেজুরগুটি, কাঁঠাল পাতা, ভেন্নার গুটি, লাটিম দিয়ে বিভিন্ন খেলা এদের সবার প্রিয়। বিকেলে দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা বউচি খেলে, গোল্লাছুট খেলে, দাড়িয়াবাঁধায় মেতে ওঠে। পুকুর বা নদীতে সাঁতারের প্রতিযোগিতা হয়।
মৃধা দাদুদের বাড়ির পাশের বাগান পেরিয়ে ছোট্ট মাঠের পরই আবার খাঁ বাড়ির বাগান। ওই বাগান আরও বড়। ২০২০ সাল পর্যন্তও ওই বাগানের পাশ দিয়ে যেতে ভয়ে গা–ছমছম করত। বাগান থেকে শিয়াল বেরিয়ে লোকালয়ে এসে হাঁস-মুরগির মতো মানুষের বাচ্চা পর্যন্ত ধরে নিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক অরণ্যে ঘেরা সবুজ তৃণভূমি যেন পশু ও পাখিদের অভয়াশ্রম। পাখিশিকারিরা পাখি শিকার করতে প্রতিদিন আসত এ বাগানে। আমরা নানা কিসিমের ফল ও বন্য ফুল-ফলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দল বেঁধে ওই বাগানে যেতাম। বেতফল, ঢেঙ্কর, গাব, খই, ডেউয়া, খুদে জাম, মেজো জাম, বুনো জামরুলসহ বিভিন্ন ফলের বাহার ছিল এই বাগান। যদিও খুব ভেতরে যাওয়ার সাহস দেখাতাম না, তবু এসব ফলের লোভ প্রায়ই আমাদের বাগানের দিকে টানত।
মৃধা দাদু আবার বলতে শুরু করেন, এলাকায় প্রয়োজনের চেয়ে জঙ্গল ছিল বেশি। প্রচুর গাছপালা ছিল সর্বত্র। প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচে ফলমূল, কাঠের শতবর্ষী গাছ দেখা যেত। গাছকে আশ্রয় ভাবত সবাই। খুব প্রয়োজন না থাকলে গাছ কাটত না কেউ। ফলে নির্মল পরিবেশ ছিল। এত গরম, শীত, অনিয়মিত বৃষ্টি ছিল না। আবহাওয়ার একটা নিয়মতান্ত্রিক অবস্থা ছিল। ছয়টি ঋতুকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যেত। প্রকৃতি আমাদের স্বভাবকবি বানিয়েছে। গান তৈরি হতো, সুর দিতে বাদ্যযন্ত্র লাগত না। আমাদের বাদ্যযন্ত্র ছিল বাতাসে হেলে যাওয়া বাঁশপাতার শব্দ, সন্ধ্যার ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক, নৌকার গলুইয়ে লাগা ঢেউয়ের তাল।
ছয়টি ঋতুকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যেত। প্রকৃতি আমাদের স্বভাবকবি বানিয়েছে। গান তৈরি হতো, সুর দিতে বাদ্যযন্ত্র লাগত না। আমাদের বাদ্যযন্ত্র ছিল বাতাসে হেলে যাওয়া বাঁশপাতার শব্দ, সন্ধ্যার ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক, নৌকার গলুইয়ে লাগা ঢেউয়ের তাল।ইদানীং দুপুরের কড়া রোদ মিলিয়ে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায় হঠাৎ। মাঝেমধ্যে একপশলা বৃষ্টিও হয়। কিন্তু গরমের কোনো হেরফের হয় না। চারপাশে যেমন ভ্যাপসা গরম, তেমনই থাকে; বরং আরেকটু যেন গরম বেড়ে যায়। প্রথম রাতে ঘুমানোর আগপর্যন্ত গরম মোটেই কমে না, অথচ শেষ রাতের দিকে আবার শীত পড়ে। ফলে কাঁথা গায়ে দিতে হয়। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণ মৃধা দাদুর শরীর ও মনে প্রভাব ফেলছে। বয়সের কারণে আগের মতো সব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না তিনি। হুটহাট রেগেও যান আশপাশের কারও কারও ওপর। কোনো কাজ অগোছালো হলে বা কাজ পছন্দ না হলে এমনটা বেশি হয়।
খাঁ বাড়ি ও মৃধা দাদুর বাড়ির পাশের বাগানগুলো অতীত হয়েছে। সেই বাগানের জায়গায় এখন বৈদ্যুতিক আলোর ছড়াছড়ি, বিলাসবহুল দালান। কে বলবে একদিন ওখানে, ওই জঙ্গলে যেতে আমাদের গা–ছমছম করত!
মৃধা দাদুর কণ্ঠে আক্ষেপের সুর—সময় বদলেছে। খেলার মাঠ নেই। বাগান নেই। ঘোড়দৌড়ের রাস্তা নেই, ঘুড়ি ওড়ানোর সেই দিগন্তজোড়া আকাশ নেই, গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেলা নেই। শিশুরা প্রকৃতির সান্নিধ্য পাচ্ছে না। রোবোটিক জীবন তাদের। বইয়ের ব্যাগ বড় হয়েছে কিন্তু ব্রহ্মতালু খালি হতে শুরু করেছে। চার বছর বয়স থেকেই জোর করে শিশুদের ওপর পড়ালেখা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ওদের শৈশব। প্রযুক্তি এর সঙ্গে ঠুকে দিয়েছে আসক্তির শেষ পেরেকটি। শিশুরা মুঠোফোন, ট্যাব, কম্পিউটারের বিভিন্ন খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিকেলে প্রকৃতির সঙ্গে খেলাচ্ছলে সময় কাটায় না তারা। বন্ধুত্ব ও নেতৃত্ব ছোটবেলায় তৈরি হচ্ছে না। পারিবারিক বন্ধন আলগা হচ্ছে। বিকলাঙ্গ একটি ভবিষ্যৎ গড়ে উঠছে।
এখন আর কেউ বৃক্ষের প্রতি আলাদা টান অনুভব করে না। গাছেদের প্রয়োজনের কথা ভাবে না। বনজঙ্গল উজাড় হয়ে গেছে, যেন মরুভূমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। মানুষের কি গাছপালার প্রতি কোনো আগ্রহ তৈরি হবে না? পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নেবে না মানুষ? এভাবে চললে একদিন গ্রামও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং একই কারণে একদিন ধ্বংস হবে পৃথিবী।
দাদু ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলেন।
বড়দের প্রচুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন মৃধা দাদু। কেউ গাছ না লাগিয়ে শুধু বিক্রি করতে গেলে রেগে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা কি তাহলে অক্সিজেনের বদলে ঘরবাড়ি খেয়ে বাঁচবা?’
নির্বিকার সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। যেন পৃথিবীতে নতুন কিছুই ঘটছে না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব দ যযন ত র আম দ র স র ম রব ব মসজ দ র প রক ত
এছাড়াও পড়ুন:
মৃধা দাদু ও আমাদের নস্টালজিয়া
পুরো মাঠের ফসল যখন ঘরে উঠে আসে, তখন হয় ঘোড়দৌড় আর ঘুড়ি ওড়ানো মেলা। ঘুড়ি যেন নেশার মতো টানত—মৃধা দাদু স্মৃতির দুয়ার খুলে একটু যেন নড়েচড়ে বসলেন।
মনের মধ্যে ভাঙাচোড়ার সুর বুঝতে পারলাম।
মৃধা দাদু সম্পর্কে শুধু আমার বা আমাদের দাদু নন, বরং আমার বন্ধুদের, বন্ধুদের বন্ধুরও দাদু তিনি। সব সময় দুষ্টুমি আর ইয়ার্কিচ্ছলে মিশে আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটি সেভাবে গড়ে নেন তিনি নিজেই। দেখা হলেই দাদু বলে একটু হলেও দুষ্টুমি, ইয়ার্কি করবেনই। অমায়িক ব্যবহার আর আচরণের জন্য আমাদের সবার প্রিয় তিনি। লম্বায় ছয় ফুট উচ্চতা ছাড়িয়ে। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। বলা যায় গ্রামের মুরব্বিদের মুরব্বি এই মৃধা দাদু। পুরো নাম আবুল হোসেন মৃধা। এলাকায় তাঁর সমবয়সী লোক খুব কমই বেঁচে আছেন। মুখে বেশ লম্বা দাড়িতে মেহেদি লাগিয়ে লাল করে রাখেন দাদু, যে কারণে চেহারায় কমলার উজ্জ্বল হলদে আভা তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোট ছিলেন না, প্রায়ই যুদ্ধের সময়ের বেশ কিছু স্মৃতি বর্ণনা করেন। তাঁর মুখে যেকোনো গল্প বাচনভঙ্গির কারণে চমৎকার হয়ে ওঠে। খুব মিশুক আর তেজি মানুষ মৃধা দাদু। এখনো বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি মোটেই। কথা ও শরীর দুটোই সামর্থ্যবানের মতো। এলাকার কলেজ, কেন্দ্রীয় ইদগাহ ও গ্রামের মসজিদের সভাপতি ছিলেন। এখন বয়স হয়েছে, মসজিদে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান। মসজিদে আজান দেন পাঁচ ওয়াক্ত। কেউ মারা গেলে মাইকে ঘোষণা দেন—শোক সংবাদ, শোক সংবাদ, বাঁশো গ্রামনিবাসী, কবিয়াল মোকসেদ মোল্যার বড় পুত্র...
মসজিদের মাইকে গুরুত্বপূর্ণ মাসলা মাসায়েল পড়েন শবে বরাত বা ঈদে মিলাদুন্নবীতে। রমজান মাসে সাহরিতে সবাইকে ডেকে তোলেন ঘুম থেকে। মাইকে কোরআন তিলাওয়াত ও গজল শোনান মুঠোফোনের মাধ্যমে। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মসজিদের নতুন নির্মিত ভবনের টাকা উত্তোলনের আলোচনায় দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমি আবুল হোসেন মৃধা। মসজিদের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান মুয়াজ্জিন। রোজ কিয়ামতের দিন সব ধ্বংস হয়ে গেলেও মসজিদ ধ্বংস হবে না...’
এলাকার নানা স্মৃতি ও গল্প মৃধা দাদুর কাছ থেকে আমরা পাই। রসিয়ে সেসব গল্পের বাস্তবসম্মত বর্ণনা দেন তিনি। তাঁর শৈশবের, যৌবনের নানা গল্প রয়েছে। সেসব গল্পে তিনি নায়ক, বাস্তবেও তিনিই নায়ক। মৃধা দাদুর বাড়ি ঘেঁষে আছে একটা প্রকাণ্ড বাগান। বনবাঁদাড়ে যেমন গাছ থাকে, তেমনই। কোনো নির্দিষ্ট গাছ নয়, হরেক রকম গাছ। বনবিড়াল, বেজি, শিয়াল, সাপ নিজেদের মতো বাস করে, খেলা করে, বাসা বানায়, বাসা ভাঙে এই বাগানে। পাখিদের কিচিরমিচির সমান্তরাল চলে। দিনের বেলায়ও দুর্বল হৃদয়ের মানুষ এই বাগানে একা যেতে ভয় পায়। ভূতের ভয়, সাপখোপের ভয়, জিন–পরির ভয়। তবু যে মানুষের একেবারেই আনাগোনা নেই বাগানের মধ্যে, তেমনটাও নয়।
বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। বলা যায় গ্রামের মুরব্বিদের মুরব্বি এই মৃধা দাদু। এলাকায় তাঁর সমবয়সী লোক খুব কমই বেঁচে আছেন। মুখে বেশ লম্বা দাড়িতে মেহেদি লাগিয়ে লাল করে রাখেন দাদু, যে কারণে চেহারায় কমলার উজ্জ্বল হলদে আভা তৈরি হয়। খুব মিশুক আর তেজি মানুষ মৃধা দাদু।বাগানের ভেতর দিয়ে পায়ে চলার মতো ছোট্ট একটা পথ রয়েছে। গ্রামের মানুষেরা বাগানে পাতা কুড়ায়, ডাল ভেঙে রান্নার খড়ি বানায়। মরা গাছপালা কেটে নিয়ে যায়। পাখি শিকার করতে আসে অনেকেই। বাগানটা নোংরা নয়, যে কারণে শিশুরা একসঙ্গে ফুল ছিঁড়তে যায়। বেতফল, কায়োজাঙাল, ড্যাপল, ডেউয়া, বঁইচি, খুদে জাম খেতে যায়। খেলনার অনুষঙ্গ কুড়াতে যায়। কেউ বেলি ফুল, ঘাসফুল, জাম, খেজুর, ভেন্না খুঁজে কুড়িয়ে নেয়। খেজুরগুটি, কাঁঠাল পাতা, ভেন্নার গুটি, লাটিম দিয়ে বিভিন্ন খেলা এদের সবার প্রিয়। বিকেলে দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা বউচি খেলে, গোল্লাছুট খেলে, দাড়িয়াবাঁধায় মেতে ওঠে। পুকুর বা নদীতে সাঁতারের প্রতিযোগিতা হয়।
মৃধা দাদুদের বাড়ির পাশের বাগান পেরিয়ে ছোট্ট মাঠের পরই আবার খাঁ বাড়ির বাগান। ওই বাগান আরও বড়। ২০২০ সাল পর্যন্তও ওই বাগানের পাশ দিয়ে যেতে ভয়ে গা–ছমছম করত। বাগান থেকে শিয়াল বেরিয়ে লোকালয়ে এসে হাঁস-মুরগির মতো মানুষের বাচ্চা পর্যন্ত ধরে নিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক অরণ্যে ঘেরা সবুজ তৃণভূমি যেন পশু ও পাখিদের অভয়াশ্রম। পাখিশিকারিরা পাখি শিকার করতে প্রতিদিন আসত এ বাগানে। আমরা নানা কিসিমের ফল ও বন্য ফুল-ফলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দল বেঁধে ওই বাগানে যেতাম। বেতফল, ঢেঙ্কর, গাব, খই, ডেউয়া, খুদে জাম, মেজো জাম, বুনো জামরুলসহ বিভিন্ন ফলের বাহার ছিল এই বাগান। যদিও খুব ভেতরে যাওয়ার সাহস দেখাতাম না, তবু এসব ফলের লোভ প্রায়ই আমাদের বাগানের দিকে টানত।
মৃধা দাদু আবার বলতে শুরু করেন, এলাকায় প্রয়োজনের চেয়ে জঙ্গল ছিল বেশি। প্রচুর গাছপালা ছিল সর্বত্র। প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচে ফলমূল, কাঠের শতবর্ষী গাছ দেখা যেত। গাছকে আশ্রয় ভাবত সবাই। খুব প্রয়োজন না থাকলে গাছ কাটত না কেউ। ফলে নির্মল পরিবেশ ছিল। এত গরম, শীত, অনিয়মিত বৃষ্টি ছিল না। আবহাওয়ার একটা নিয়মতান্ত্রিক অবস্থা ছিল। ছয়টি ঋতুকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যেত। প্রকৃতি আমাদের স্বভাবকবি বানিয়েছে। গান তৈরি হতো, সুর দিতে বাদ্যযন্ত্র লাগত না। আমাদের বাদ্যযন্ত্র ছিল বাতাসে হেলে যাওয়া বাঁশপাতার শব্দ, সন্ধ্যার ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক, নৌকার গলুইয়ে লাগা ঢেউয়ের তাল।
ছয়টি ঋতুকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যেত। প্রকৃতি আমাদের স্বভাবকবি বানিয়েছে। গান তৈরি হতো, সুর দিতে বাদ্যযন্ত্র লাগত না। আমাদের বাদ্যযন্ত্র ছিল বাতাসে হেলে যাওয়া বাঁশপাতার শব্দ, সন্ধ্যার ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক, নৌকার গলুইয়ে লাগা ঢেউয়ের তাল।ইদানীং দুপুরের কড়া রোদ মিলিয়ে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায় হঠাৎ। মাঝেমধ্যে একপশলা বৃষ্টিও হয়। কিন্তু গরমের কোনো হেরফের হয় না। চারপাশে যেমন ভ্যাপসা গরম, তেমনই থাকে; বরং আরেকটু যেন গরম বেড়ে যায়। প্রথম রাতে ঘুমানোর আগপর্যন্ত গরম মোটেই কমে না, অথচ শেষ রাতের দিকে আবার শীত পড়ে। ফলে কাঁথা গায়ে দিতে হয়। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণ মৃধা দাদুর শরীর ও মনে প্রভাব ফেলছে। বয়সের কারণে আগের মতো সব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না তিনি। হুটহাট রেগেও যান আশপাশের কারও কারও ওপর। কোনো কাজ অগোছালো হলে বা কাজ পছন্দ না হলে এমনটা বেশি হয়।
খাঁ বাড়ি ও মৃধা দাদুর বাড়ির পাশের বাগানগুলো অতীত হয়েছে। সেই বাগানের জায়গায় এখন বৈদ্যুতিক আলোর ছড়াছড়ি, বিলাসবহুল দালান। কে বলবে একদিন ওখানে, ওই জঙ্গলে যেতে আমাদের গা–ছমছম করত!
মৃধা দাদুর কণ্ঠে আক্ষেপের সুর—সময় বদলেছে। খেলার মাঠ নেই। বাগান নেই। ঘোড়দৌড়ের রাস্তা নেই, ঘুড়ি ওড়ানোর সেই দিগন্তজোড়া আকাশ নেই, গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেলা নেই। শিশুরা প্রকৃতির সান্নিধ্য পাচ্ছে না। রোবোটিক জীবন তাদের। বইয়ের ব্যাগ বড় হয়েছে কিন্তু ব্রহ্মতালু খালি হতে শুরু করেছে। চার বছর বয়স থেকেই জোর করে শিশুদের ওপর পড়ালেখা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ওদের শৈশব। প্রযুক্তি এর সঙ্গে ঠুকে দিয়েছে আসক্তির শেষ পেরেকটি। শিশুরা মুঠোফোন, ট্যাব, কম্পিউটারের বিভিন্ন খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিকেলে প্রকৃতির সঙ্গে খেলাচ্ছলে সময় কাটায় না তারা। বন্ধুত্ব ও নেতৃত্ব ছোটবেলায় তৈরি হচ্ছে না। পারিবারিক বন্ধন আলগা হচ্ছে। বিকলাঙ্গ একটি ভবিষ্যৎ গড়ে উঠছে।
এখন আর কেউ বৃক্ষের প্রতি আলাদা টান অনুভব করে না। গাছেদের প্রয়োজনের কথা ভাবে না। বনজঙ্গল উজাড় হয়ে গেছে, যেন মরুভূমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। মানুষের কি গাছপালার প্রতি কোনো আগ্রহ তৈরি হবে না? পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নেবে না মানুষ? এভাবে চললে একদিন গ্রামও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং একই কারণে একদিন ধ্বংস হবে পৃথিবী।
দাদু ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলেন।
বড়দের প্রচুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন মৃধা দাদু। কেউ গাছ না লাগিয়ে শুধু বিক্রি করতে গেলে রেগে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা কি তাহলে অক্সিজেনের বদলে ঘরবাড়ি খেয়ে বাঁচবা?’
নির্বিকার সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। যেন পৃথিবীতে নতুন কিছুই ঘটছে না।