দাবি পূরণ না হলে রোববার জেলায় জেলায় মহাসড়ক অবরোধের হুমকি ‘জুলাই যোদ্ধা সংসদের’
Published: 17th, October 2025 GMT
২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের ‘শহীদ’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আহত ব্যক্তিদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি, শহীদ পরিবারের পুনর্বাসনের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এবং আহত ব্যক্তিদের জন্য আইনি সহায়তা—এসব দাবি পূর্ণাঙ্গভাবে ‘জুলাই সনদে’ উল্লেখ ও বাস্তবায়নের বিষয়টি যুক্ত না করলে আগামী রোববার দেশের প্রতিটি জেলায় মহাসড়ক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে ‘জুলাই যোদ্ধা সংসদ’।
আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের ১২ নম্বর ফটকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন জুলাই যোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক মাসুদ রানা। এর আগে দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার ভেতরে এবং পরে সড়কে জুলাই যোদ্ধাদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে মাসুদ রানা বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না। আগামী রোববার বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দেশের প্রতিটি জেলা শহরের মহাসড়কে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হবে। এই কর্মসূচিতে দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি আহ্বান জানাই—আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন। এই আন্দোলন কোনো দলের নয়, এটি জনগণের।’
সরকার ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এই রাষ্ট্রের জন্য, এই জাতির স্বাধীনতার নতুন স্বপ্নের জন্য জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমেছিলাম। আমাদের রক্তের বিনিময়ে যে জুলাই সনদ তৈরি হয়েছে, সেখানে আমাদের রক্তের স্বীকৃতি থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সেই স্বীকৃতি অস্বীকার করা হয়েছে। আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি, আর এখন রাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।’
মাসুদ রানা জানান, দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় ধরে তাঁরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। প্রতিটি জেলায় আহত ব্যক্তিরা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ে গিয়ে দাবিনামা জমা দিয়েছেন। ১৩ অক্টোবর শাহবাগ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তাঁরা সচিবালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেন। ১৪টি মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, এমনকি প্রধান বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছেও দাবিগুলো লিখিত আকারে পাঠানো হয়।
জুলাই যোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, সরকার ও ঐকমত্য কমিশন আমাদের ন্যায্য দাবি বুঝবে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল স্যারও আমাদের দাবিগুলো দেখেছেন। তিনি কেবল একটি শব্দ নিয়ে আপত্তি করেছিলেন, আমরা সেটি সংশোধন করেছি। তিনি আশ্বাস দিয়ে ছিলেন যে তিনি এই দাবিগুলো জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন সনদ প্রকাশিত হলো, আমরা দেখলাম—আমাদের কোনো দাবি বাস্তবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।’
শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে অভিযোগ করে মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা সংসদ ভবনের গেটে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলাম সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমরা তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিলাম, সকাল ১০টা পর্যন্ত আমাদের অবস্থান হবে, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করব না। কিন্তু সকাল গড়াতেই তারা কোনো আলোচনা বা সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে হঠাৎ আমাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে।’
মাসুদ রানা আরও বলেন, ‘আমাদের পেছন দিক থেকে পুলিশ হঠাৎ লাঠিচার্জ শুরু করে। কেউ বুঝে ওঠার আগেই আমাদের ওপর টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। যাঁরা মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের বুট দিয়ে পাড়ানো হয়েছে। এমনভাবে আক্রমণ চালানো হয়েছে যেন আমরা মানুষ না, কোনো প্রাণী। আমাদের মধ্যে শতাধিক আহত নতুন করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।’
পুলিশ এখনো শেখ হাসিনার আমলে তৈরি হওয়া মানসিকতায় চলছে বলে অভিযোগ করেন মাসুদ রানা। পুলিশ সংস্কার ছাড়া নতুন বাংলাদেশ সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশে এখনো ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি সদস্য হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া। এদের ডিএনএ টেস্ট করে নেওয়া হয়েছিল—তাদের বংশে আওয়ামী লীগ আছে কি না। তাই এই বাহিনী এখনো দলীয় সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। জুলাই বিপ্লবের পরেও তারা নিজেদের চরিত্র বদলায়নি। এই বাহিনী সংস্কার না করলে নতুন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য আম দ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মাধ্যমিকে কর্মবিরতি, বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি
চার দফা দাবিতে দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা গতকাল সোমবার লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এর ফলে ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গতকালের বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে গিয়ে ফিরে যায়।
তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে কর্মচারীদের পাহারায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে তিন দফা দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের একাংশ কর্মবিরতি পালন করছে। গতকাল থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার বলেছেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সরকারি কর্মচারী বিধি লঙ্ঘনের দায়ে তাঁদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় বাসসকে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলনের নামে যা করছেন, তা সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল। সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য আপনাদের কিন্তু তৈরি থাকতে হবে। এখানে সরকার একেবারে দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।’
মাধ্যমিকে কর্মবিরতিবাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৪ অনুযায়ী, সারা দেশে ১৯ হাজার ১১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সাধারণ বা জেনারেল) রয়েছে। এর মধ্যে ৬৩১টি সরকারি। মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৭৯ লাখ। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ৪ লাখ ৮৬ হাজারের বেশি। সরকারি মাধ্যমিকে মোট শিক্ষক ১৩ হাজারের বেশি।
চার দফা দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে। দাবিগুলো হলো—এক. সহকারী শিক্ষক পদকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেট প্রকাশ। দুই. বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষকদের বিভিন্ন শূন্য পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন দ্রুত কার্যকর করা। তিন. সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ দেওয়া। এবং চার. ২০১৫ সালের আগের মতো সহকারী শিক্ষকদের ২ থেকে ৩টি ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বর্ধিত বেতন-সুবিধা বহাল করে গেজেট প্রকাশ।
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দাবির বিষয়ে তাঁরা প্রথমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে শিক্ষকেরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু দাবি না মানায় লাগাতার কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন।
কর্মবিরতির কারণে বিভিন্ন বিদ্যালয় আগের দিন রোববার নোটিশ দিয়ে গতকালের পরীক্ষা স্থগিত করে। আবার শিক্ষার্থীরা গতকাল কোনো কোনো বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে পারে, পরীক্ষা হবে না। রাজধানীর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে পড়ুয়া এক ছাত্রের বাবা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সন্তান বিদ্যালয়ে গিয়েও ফিরে এসেছে। বিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, তাঁরা মৌখিকভাবে পরীক্ষা হবে না বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল আগের দিন রোববার নোটিশ দিয়ে পরীক্ষা না নেওয়ার কথা জানিয়েছে। গতকাল সকালে খুলনার সরকারি করোনেশন গার্লস হাইস্কুলের একজন শিক্ষক জানান, তাঁদের বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হচ্ছে না।
গতকাল সকালে খুলনা জিলা স্কুলের সামনে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সরফুদ্দিন আয়ান বলে, ‘আজ গণিত পরীক্ষা ছিল, তবে হবে না—এটা জানতাম না। এসে দেখি, পরীক্ষা হচ্ছে না।’ তার মতো খুলনার কয়েকটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা একই সমস্যায় পড়ে। তারা বিদ্যালয়ে যাওয়ার পর শিক্ষকদের কর্মবিরতির খবর পায়।
রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে পরীক্ষা না হওয়ার খবর পাঠিয়েছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় এ প্রতিবেদক মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখতে পান, বেশ কিছু ছাত্র রয়েছে বিদ্যালয় চত্বরে। অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্র বলল, তাদের পরীক্ষা হয়েছে। তবে পরীক্ষার হলে গার্ড দিয়েছেন কর্মচারীরা। পরে কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কর্মচারীদের দিয়ে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
তবে শিক্ষকেরা দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা হতে দেননি। বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাহমিনা ইয়াসমিন বলেন, আদিষ্ট হয়ে বিধি মোতাবেক পরীক্ষা কার্যক্রম চলমান রেখেছেন।
সেখান থেকে পাশের মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, সেই বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী গতকাল পরীক্ষা ছিল না।
সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক মোহাম্মদ ওমর ফারুক গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি তাঁদের ডেকে দাবিগুলো পূরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে তাঁরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন। অন্যথায় তাঁদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চলবে।
প্রাথমিকে একাংশের কর্মবিরতিসহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছে প্রাথমিক শিক্ষকদের একাংশ। প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে। পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আপাতত ১১তম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় আজ ২ ডিসেম্বর পরীক্ষা বর্জনসহ লাগাতার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে।
অবশ্য গতকাল সকালে ঢাকায় বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যায়। লালবাগ শিক্ষা এলাকার একটি বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক সকালে পরীক্ষা শুরুর কথা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কড়া বার্তা আছে। আর সাধারণত ঢাকার বিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের কর্মসূচি সব সময়ই কম পালিত হয়।