বিএবি আগের মতোই ব্যাংক থেকে চাঁদা তুলছে
Published: 13th, January 2025 GMT
বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আগের মতোই ব্যাংক থেকে চাঁদা তোলা শুরু করেছে। সম্প্রতি সংগঠনটি প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণভান্ডারে কম্বল দিতে পরিমাণ উল্লেখ করে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা আন্তর্জাতিক ম্যারাথনে মোট ৪ কোটি টাকা অনুদান দিতে চাঁদা নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।
বিএবির এই পদক্ষেপ বিস্মিত করেছে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের। ছয়টি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বিএবির পক্ষ থেকে এ ধরনের চিঠি পাঠানোর বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংকগুলো থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে চাঁদা আদায় করতেন। এরপর মালিকেরা মিলে সেই অর্থ ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে আসতেন। বিনিময়ে ব্যাংকগুলো ব্যাংক কোম্পানি আইন ও নীতিমালার বিভিন্ন শর্ত থেকে ছাড় পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। সে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএবি পর্ষদে পরিবর্তন আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএবি আগে গণহারে চাঁদাবাজি করে ব্যাংক খাতকে ডুবিয়েছে। নতুন কমিটিও একই কাজ শুরু করলে সেই উদ্যোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা দরকার। জনগণের আমানত নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলা যাবে না। যে খাতে সামাজিক দায়বদ্ধতার টাকা খরচ করা যায়, সব ব্যাংক সেই সব খাতেই খরচ করবে। বিএবি এই টাকায় হাত দেওয়ার কেউ না।’
১৭ বছরে এক চেয়ারম্যান২০০৮ সাল থেকে টানা ১৭ বছর বিএবির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। এ সময় তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পান। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নজরুল ইসলাম মজুমদারকে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বিএবির চেয়ারম্যান পদও হারান তিনি। সরকার বদলের পর নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিএবির দুই ভাইস চেয়ারম্যানও ব্যাংকের পরিচালক পদ হারান। তাঁরা হলেন আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ। অপরজন হলেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে সর্বশেষ ‘শেখ হাসিনা আন্তব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট’ আয়োজন করে বিএবি। এ জন্যও ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা তোলা হয়। নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বে বিএবি গত ১৫ বছরে বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাংকগুলো থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলেছে বলে জানান ব্যাংকাররা। এ জন্য সরকার বদলের পর এসব টাকার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, দাবি ওঠে নিরীক্ষার।
ব্যাংকগুলো গত ১০ বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা শুধু প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দেয়। ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক নির্দেশনায় জানায়, ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের ৫ শতাংশ অর্থ প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্ট তহবিলে অনুদান হিসেবে জমা দিতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়।
জানা যায়, এবার ম্যারাথনের জন্য সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের শীর্ষ পর্যায়ের একটি ব্যাংকের এমডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ বছরে তিনি প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছেন। সরকার বদলের পর চিঠি পেয়ে কম্বল কিনে জমা দিয়েছেন। ম্যারাথনের জন্য টাকা চেয়ে চিঠি এসেছে। এ সপ্তাহেই তা দেওয়া হবে। এভাবে চাঁদা আদায়ের ফলে ব্যাংকের সিএসআর কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
নতুন কমিটিও আগের ধারাতেইগত সেপ্টেম্বরে বিএবি নতুন অস্থায়ী (অ্যাডহক) কমিটি গঠন করে। চলতি মাসে তাঁরা পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। চেয়ারম্যান হয়েছেন ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার। ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এবং ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরী।
বিএবির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বিএবি একটি পরামর্শ সেবা দেওয়া সংগঠন। ব্যাংক খাতের যেকোনো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে থাকে বিএবি। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে।
১৯৯৩ সালে বেসরকারি খাতের ৯ ব্যাংকের উদ্যোক্তারা মিলে বিএবি গঠন করেন। ব্যাংকগুলোর চাঁদায় পরিচালিত হয় বিএবির কার্যক্রম। এখন ৩৮টি ব্যাংক বিএবির সদস্য।
বিএবির কমিটিতে যুক্ত একজন ব্যাংক চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএবি আগে যে ধারায় চলেছে, এখনো তা থেকে খুব একটা বের হতে পারেনি।
বিএবির নতুন কমিটি আগের চাঁদা আদায়ের বিষয়ে কোনো নিরীক্ষা করেনি বরং আগের ধারাতেই চলছে বলে বিভিন্ন ব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। সর্বশেষ কম্বল ও ম্যারাথনের মতো আয়োজনের জন্য চাঁদা চেয়ে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি। গত ১৫ ডিসেম্বর দেওয়া চিঠিতে প্রতিটি ব্যাংকের জন্য কম্বলের পরিমাণ নির্ধারণ করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে প্রতিটি কম্বলের ওজন কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ গ্রাম হতে হবে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে সর্বশেষ ‘শেখ হাসিনা আন্তব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট’ আয়োজন করে বিএবি। এ জন্যও ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা তোলা হয়।এরপর ৫ জানুয়ারি আরেক চিঠিতে বিএবির চেয়ারম্যান ব্যাংকগুলোকে জানান, আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা আন্তর্জাতিক ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে ৪ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হবে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করে ৮ জানুয়ারির মধ্যে বিএবির হিসাবে সেই অর্থ জমা দিতে বলা হয়। ঢাকা আন্তর্জাতিক ম্যারাথন আয়োজক কমিটি বিএবিকে যে চিঠি দিয়েছে তাতে মূল স্পনসরের জন্য সর্বোচ্চ চাঁদা চাওয়া হয়েছে ২ কোটি টাকা। ফলে কেন ৪ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
দুটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগে শীত কিংবা গরম, ঝড় বা বৃষ্টি যেকোনো ইস্যু পেলেই ব্যাংক থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে। এতে ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল (সিএসআর) কার্যত শূন্য হয়ে পড়ে। এখনো একই পথে হাঁটছে বিএবি। এতে ব্যাংকগুলোর পক্ষে সত্যিকার সিএসআর কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিএবি নেতাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কথা বলা যায়নি।
গত দেড় দশকে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে ঋণের ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ, পরিচালকদের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংক আইন সংশোধন, বিভিন্ন ঋণ নীতিমালা শিথিল করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা ছাড়া বিএবিকে অন্য কোনো ভূমিকায় খুব একটা দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএবির চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। চাঁদার মাধ্যমে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আইনও পরিবর্তন করে ফেলে। এর ফলে ব্যাংক খাতের করুণ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। আইনে সিএসআরের অর্থের যে ব্যবহার হওয়ার কথা, শুধু সেই খাতে ব্যবহার করতে হবে। ব্যাংকগুলো নিজ উদ্যোগে এই অর্থ ব্যবহার করতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।