চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের সংরক্ষিত ৩ নম্বর আসনের সদস্য ফাতেমা বেগম। গত বছরের ১২ জুলাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। নির্বাচনের পর থেকে আজ পর্যন্ত ভাতা তুলতে পারেননি ফাতেমা বেগম।

শুধু ফাতেমা বেগম নন, উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ৮১ জন সাধারণ সদস্য ও ২৭ জন সংরক্ষিত নারী সদস্য মিলে মোট ১১৭ সদস্যের ছয় মাস ধরে ভাতা বন্ধ রয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানিয়েছে, একজন ইউপি সদস্য দুই ভাগে মোট ভাতা পান আট হাজার টাকা। ইউনিয়ন পরিষদ দেয় ৪ হাজার ৪০০ টাকা, সরকারের কাছ থেকে পান ৩ হাজার ৬০০ টাকা। সর্বশেষ গত বছরের জুনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা তাঁদের ভাতা উত্তোলন করেছিলেন। এরপর গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর উপজেলার প্রায় সব ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্যরা কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকতে শুরু করেন। এতে জনদুর্ভোগের তৈরি হয়।

১৯ আগস্ট একটি পরিপত্রে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর কার্যক্রম গতিশীল রাখতে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণের জন্য জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম স্বাক্ষরিত একটি অফিস আদেশে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদ ও বাকি চারটি ইউনিয়নের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা পরিচালনার জন্য সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের দ্বারা সেবাগ্রহীতাকে বিভিন্ন সনদ ইস্যু করছেন ইউএনও ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)।

কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের বেশির ভাগ সাধারণ সদস্য পরিষদ কার্যালয়ে নানা কারণে অনুপস্থিত থাকায় সমস্যা দেখা দেয়। পরে সংরক্ষিত নারী সদস্যের সহযোগিতায় ইউনিয়ন পরিষদের কাজ চলমান রেখেছে প্রশাসন।

কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো.

সালাউদ্দিন বলেন, ৫ আগস্টের পর তিনি এলাকায় থেকে সেবাগ্রহীতাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রয়োজন হলে তিনি পরিষদেও যাচ্ছেন। তাঁর জানামতে, ওই ইউনিয়নের চার সদস্য এলাকায় থেকে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। অনেক দিন ধরে তাঁরা ভাতা না পেলেও জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

গতকাল সোমবার সকালে কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, সভাকক্ষে বসে ব্যক্তি শনাক্তের কাজ করছেন ওই ইউনিয়নের সংরক্ষিত ৩ নম্বর আসনের নারী সদস্য ফাতেমা বেগম। উদ্যোক্তার কক্ষে রানা ও বাইরে দুজন গ্রাম পুলিশ কাজ করছিলেন। নির্ধারিত ফরমে ফাতেমা বেগম স্বাক্ষর করে শনাক্ত করেন। পরে উদ্যোক্তা রানার কাছে জমা দেন। এ ছাড়া অন্তত ২০ সেবাগ্রহীতা পরিষদের কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন।

ফাতেমা বেগম বলেন, নির্বাচিত হওয়ার দিন থেকে প্রতিদিন তিনি অফিস করছেন। মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। অন্য দুই নারী সদস্যও আসেন। তবে পুরুষ সদস্যরা কম আসেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একবারও ভাতা পাননি।

বেলা সাড়ে তিনটায় ভাটিয়ারি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে দেখা গেছে, কার্যালয়ের বাইরে একজন গ্রাম পুলিশ একটি চেয়ারে বসে রয়েছেন। তাঁকে ঘিরে বসে ছিলেন অন্তত চার সেবাগ্রহীতা। ভেতরে উদ্যোক্তার কক্ষের সামনে দেখা গেছে অন্তত ১০ সেবাগ্রহীতাকে। কিন্তু সচিব কিংবা কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি।

উদ্যোক্তা শম্পা মিত্র জানান, সংরক্ষিত ২ নম্বর আসনের নারী সদস্য দেলোয়ার বেগম নিয়মিত ইউপি কার্যালয়ে এসে কাজ সামলাচ্ছেন। দিনের বেলায় জন্মনিবন্ধনের সার্ভার ডাউন থাকে। তাই বিকেলের পর অনেক সময় রাত পর্যন্ত তাঁদের কাজ করতে হয়।

সেখানে কথা হয় সেবাগ্রহীতা জুলি আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিজের দ্বিতীয় সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন। নারী ইউপি সদস্য তাঁকে শনাক্ত করেছেন। কাজ হয়েছে কি না জানতে এসেছেন তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ছয় মাসের মতো ইউপি সদস্যদের ভাতা বন্ধ রয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে ভাতা পরিশোধের জন্য কার্যক্রম শুরু করবেন তাঁরা।

ভাতা বন্ধ হতে পারে বেশির ভাগ সদস্যের

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ইউপি সদস্যদের বেতন–ভাতা পরিশোধের লক্ষ্যে ইউপি কার্যালয় ও নিজ নিজ এলাকায় কোন কোন সদস্য উপস্থিত আছেন, তা যাচাই করে প্রতিবেদন পাঠাতে বলেছেন জেলা প্রশাসক। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ২৭ নারী সদস্য ও ১৯ সাধারণ (পুরুষ) সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি ৬২ সদস্য অনুপস্থিত রয়েছেন। এ ছাড়া চেয়ারম্যানরাও অনুপস্থিত রয়েছেন।

ইউএনও কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ভাতা পরিশোধের জন্য কর্মস্থলে উপস্থিত আছেন, এমন ৪৬ ইউপি সদস্যের তালিকা করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তাঁরা পাঠিয়েছেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের ভাতা পরিশোধ করা হবে। চেয়ারম্যানসহ মোট ৭১ জন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় ভাতা থেকে তাঁরা বাদ পড়তে পারেন বলে জানান তিনি।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ফেস্টুন অপসারণ করায় ইউএনওকে শাসালেন বিএনপি নেতা 

ফেস্টুন অপসারণ করায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল আহমেদকে শাসিয়েছেন এক বিএনপি নেতা। তিনি ইউএনওকে আগের স্থানেই ফেস্টুন লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তা না হলে যেটা করা দরকার, সেটাই করব।”

এই বিএনপি নেতার নাম কে এম জুয়েল। তিনি রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুলে তার বাড়ি। 

গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সড়ক বিভাজকে থাকা বিভিন্ন দলের ফেস্টুন অপসারণ করেন ইউএনও ফয়সাল আহমেদ। বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনওকে ফোন করে ধমকান জুয়েল।

কে এম জুয়েলের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। এতে শোনা গেছে, কে এম জুয়েল বলেছেন- “আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে, আমি শুনেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার কে এম জুয়েল বলছি, সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট। আপনার গোদাগাড়ী থানার প্রোপারে যে পোস্টার সরিয়েছেন, এই বিষয়ে কিছুক্ষণ আগে আমাকে ইনফর্ম করা হয়েছে। সেখানে আমার পোস্টার ছিল। জামায়াত-বিএনপির পোস্টার ছিল। আপনি যে হটাইছেন, এর কারণ কী? কোনো পরিপত্র আছে, না ইচ্ছে করেই?”

ইউএনও তখন বলেন, “জনগণ অভিযোগ দিয়েছে।” জুয়েল বলেন, “জনগণ তো অনেক অভিযোগ দিয়েছে। সমগ্র গোদাগাড়ী থানাতে ভর্তি হয়ে আছে পোস্টার। তোলেন, সব তোলেন।”

এ সময় ইউএনও কিছু বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে জুয়েল বলেন, “শোনেন, আমি যেটা বলছি লিগ্যাল রাইট নিয়ে বলছি, সেটার সঠিক অ্যানসার করবেন। আপনি কেন ওই জায়গার পোস্টার তুলেছেন, আর অন্য জায়গার তুলছেন না কেন? আমি ঢাকাতে আছি, আমি আসতেছি।”

ইউএনও বলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।” জুয়েল বলেন, “না, আপনি যেখান থেকে পোস্টার তুলেছেন, সেখানে আপনি সাবমিট করবেন পোস্টার।” কথা না বাড়িয়ে ইউএনও বলেন, “ঠিক আছে।”

এ সময় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি নেতা জুয়েল বলেন, “কালকে যেন আমরা ওখানে দেখতে পাই, পোস্টার যেখানে ছিল। ঠিক আছে মানে কী? অবশ্যই করবেন। না হলে যেটা করা দরকার সেটাই করব। আপনার এগেইনেস্টে যেরকম স্টেপ নেওয়া দরকার, সেটাই আমি করব। বিশেষ করে আমরা করব। আমার নেতার ছবি তুলেছেন আপনি ওখান থেকে। জাস্ট রিমেম্বার ইট।”

জুয়েল বলতে থাকেন, “নরসিংদী বাড়ি দেখান আপনি, না? কোন দল থেকে আসছেন আপনি? কোন দল থেকে এসেছেন? কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছেন আপনি? কালকে পোস্টার ভদ্রলোকের মতো লাগাবেন। ফাইজলামি! এহ, বিশাল ব্যাপার। উনি টিএনও হয়ে গোদাগাড়ীতে আসছেন।”

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউএনও ফয়সাল আহমেদ বলেন, “ডাইংপাড়া মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন এরকম পর্যায়ে ছিল যে, যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি পৌরসভার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল। স্থানীয় জনগণ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে সরানোর জন্য। দুই-তিনবার মৌখিকভাবে ও লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। না সরানোর কারণে ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে পৌরসভায় রাখা হয়েছে।”

তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভাতেও আলোচনা হয়েছিল। সেখান থেকে সকল রাজনৈতিক দলের পোস্টারই পৌরসভার পক্ষ থেকে সরানো হয়েছে। তবে, বিএনপি নেতা কে এম জুয়েলের ফোনে শাসানোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা কে এম জুয়েল বলেন, “ইউএনওর কাছে জনগণ অভিযোগ করেছে, আর আমরা কি মানুষ না? আমরা জানোয়ার? আমার ছবি তুলে ফেলুক আপত্তি নাই। আমার নেতার ছবিতে হাত দিয়েছে কেন? তার কাছে কি নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পোস্টার তুলে ফেলতে? তিন মাসের মধ্যে কি নির্বাচন? উনি জাস্টিস করতেন, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গরু-ছাগলের মতো আচরণ করবেন, তা তো হয় না।”

বিষয়টি নিয়ে কোথাও আলোচনা হয়নি, ইউএনও কোনো চিঠিও দেননি, দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “গতকাল আমার এক লোককে ডেকে ইউএনও বলেছেন, যেখানে পোস্টার ছিল, দয়া করে আপনারা লাগিয়ে নেন। কিন্তু, আমরা তো লাগাব না। ইউএনওকেই লাগাতে হবে।”

উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রায় দুই মাস আগে উপজেলা সদরের এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেন এক ব্যক্তি। এক মাসেও সেগুলো অপসারণ না হওয়ায় পরবর্তী মাসের সভাতেও বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। ওই সভায় ট্রাফিক পুলিশ আপত্তি করেছিল যে, ফেস্টুনের কারণে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ দুটি সভার মধ্যে প্রথম সভায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল ছিলেন না। দুই সভার মাঝে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন করা হলে তিনি পরবর্তী সভায় উপস্থিত ছিলেন।

তবে, কোনো আলোচনা হয়নি দাবি করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল বলেন, “আমি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য। পোস্টার নিয়ে কোনো আলোচনা সভায় হয়নি। ইউএনও আমাদের না জানিয়ে এভাবে ফেস্টুন অপসারণ করে ঠিক করেননি। সেখানে আমাদের নেতার ছবি ছিল।”

ঢাকা/কেয়া/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইউএনওর স্বাক্ষর জাল করে শিক্ষক নিয়োগের চেষ্টা, জামায়াতের পদ থেকে অব্যাহতি
  • বিএনপির সাবেক নেতার হুমকি, সরিয়ে ফেলা পোস্টার ইউএনওকেই লাগাতে হবে
  • ফেস্টুন অপসারণ করায় ইউএনওকে শাসালেন বিএনপি নেতা 
  • মেঘনায় নদীতে অবৈধ বালু তোলায় ব্যবহৃত ৭টি খননযন্ত্র ও ১টি বাল্কহেড জব্দ