গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা চলমান সংঘাতের মধ্যে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আমরা যারা গত ১৫ মাস ধরে দেখে আসছি, হামলার অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছি, দূর থেকে শোক করেছি, ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে কথা বলেছি; এই যুদ্ধবিরতি সেই সময়কে পর্যালোচনার সুযোগ এনে দিয়েছে। এই ক্ষণস্থায়ী শান্তির জন্য বড্ড মূল্য দিতে হয়েছে। এটি রক্তপাতের সমাপ্তি, কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা যাদের হারিয়েছি, তারা কখনোই ফিরবে না এবং এই ক্ষত কখনোই সারানো যাবে না। যুদ্ধবিরতি কি সেই সত্য পরিবর্তন করতে পারবে?

কূটনৈতিক বিজয় হিসেবেই সাধারণত যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানানো হয়। তবে আমার কাছে এটা এক দুঃস্বপ্নের মধ্যকার বিরতির মতো। এ চুক্তি এটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, গাজার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম কতটা কঠিন। মা-বাবা-শিশু সবাইকে অনিশ্চয়তার অসহ্য ভার বহন করতে হয়। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করছি: যুদ্ধবিরতি কি সত্যিই শান্তির দিকে নিয়ে যাবে, নাকি বিলম্বিত ন্যায়বিচার এবং বর্ধিত যন্ত্রণাময় গল্পের এ আরেক অধ্যায়? যুদ্ধবিরতির শর্তাগুলো ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গৃহীত হয়েছে। গাজায় মানবিক সাহায্যের অনুমতি দেওয়াসহ বিমান হামলা এবং রকেট হামলা বন্ধ থাকাও এর অন্তর্ভুক্ত। এগুলো একান্ত জরুরি। কিন্তু এমন সংকট প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যর্থ– সে অভিযোগও সামনে আসছে। গাজার মানুষের সাহায্য জরুরি। কিন্তু এই সাহায্য নিপীড়ন ও রক্তপাতের ক্ষত নিরাময় করতে পারে না। অস্থায়ী শান্তি স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকার বাইরে স্বপ্ন দেখার অধিকার দেয় না।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে ইসরায়েলের বিপক্ষে। ফিলিস্তিনি জনগণের বিপক্ষে যে অপরাধ ইসরায়েল সংঘটিত করেছে, তার বিচার জরুরি ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে তা হয়নি। যুদ্ধ শেষ হলে বিশ্ব কি এই বিচার করবে, নাকি আমলাতন্ত্র ও উদাসীনতার পাহাড়ে ন্যায়বিচার চাপা পড়বে? যুদ্ধের আগে, সংঘাত চলাকালে এবং পরে প্রতিটি ধাপেই জবাবদিহি করতে ব্যর্থ বিশ্ব। এসব আদালত কতটা ত্রুটিপূর্ণ– বিচারহীনতাই তার প্রমাণ।

এই সময়ে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য অত্যাবশ্যক, কিন্তু তা নিপীড়নের ক্ষত সারাতে পারে না। এটি আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে: ফিলিস্তিনিরা কি কখনও তাদের ন্যায়বিচারের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পথের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে? নাকি তাদের সবসময় শক্তিহীন করে রাখা হবে এবং শিকারের ভূমিকায় থাকার জন্যই ঠিক করা হবে? যদিও আমাদের দুর্দশার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তারপরও স্বাধীনতার দিকে পথ নিজেদেরই বের করতে হবে।

ফিলিস্তিনিদের জন্য বিশেষ করে গাজাবাসীদের জন্য অবরোধ এক ধরনের যুদ্ধ। এটি বোমা ছাড়াও হতাহতের নামান্তর, যা কম বিধ্বংসী নয়। ১৭ বছর ধরে এই অবরোধ চলছে। গাজার মানুষ এ কারণে সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মৌলিক অধিকার তারা পাচ্ছে না। বরং দৈনন্দিন জীবনে এক সংগ্রাম তারা করে যাচ্ছে সহ্যের সব সীমার বাইরে। এই যুদ্ধবিরতি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে জেনেও আমরা কীভাবে এমন পরিস্থিতিতে জীবন পুনর্নির্মাণের স্বপ্ন দেখব? আমরা কীভাবে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখব, যখন বর্তমানে শোকই যেন নিয়তি?

শোকের এই চক্র ভাঙতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বকে অবশ্যই ভূমিকা পালন করতে হবে। যুদ্ধবিরতির জন্য তারা যে বিবৃতি দিচ্ছে সেগুলো ফাঁপা বুলির মতো শোনায়, যখন তারা বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং এই সংঘাতের মূল কারণ বিষয়ে নজর দেয় না। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, দখলদারিত্বের নির্মম বাস্তবতা ও শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধ– এগুলো উপেক্ষিত বিষয় নয়, বরং সমস্যার গোড়া।

আমরা কীভাবে একই মার্কিন প্রশাসনকে বিশ্বাস করতে পারি? জো বাইডেনের বিদায়ে শিগগির আসবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্ব। মার্কিন প্রশাসন তখনই যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেয় যখন ইসরায়েলের পদক্ষেপ ধারাবাহিকভাবে অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট করেছে? জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করেছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর প্রথম শাসনের এমন সিদ্ধান্তই বলে দিয়েছে যে, ন্যায়বিচারের ওপর ক্ষমতাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এখন আশঙ্কা রয়ে গেছে, এই প্রশাসন তাঁর পশ্চিম তীরে নজর দেবে, সেখানে সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুতির একই ঘটনা ঘটবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বলছে– যুদ্ধবিরতি আসলে নিষ্ফল।
ফিলিস্তিনি হিসেবে আমি এই চরম সত্য উপেক্ষা করতে পারি না যে, কেবল না থাকাই শান্তি নয়। বরং শান্তির জন্য ন্যায়বিচার জরুরি। ভয়ডরহীন বাঁচার স্বাধীনতা, ধ্বংসের নিশ্চয়তা ছাড়া পুনর্গঠনের অধিকার ও সীমাহীন স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা জরুরি। এর কম কিছু 
হলে তা শান্তি আনবে না। এটা কেবল কোনোমতে বেঁচে থাকা। এমন বেঁচে থাকা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়, যারা এর চেয়ে বেশি পাওয়ার অধিকার রাখে।

আফাফ আল-নাজ্জার: গাজা উপত্যকায় বসবাসরত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

প্রথম নারী হাওয়া (আ.)-র জন্ম যেভাবে

আল্লাহ মানুষ বানালেন। প্রথমে বানালেন আদম (আ.)-কে। ফেরেশতারা তাঁকে সিজদা করলেন। জান্নাতেই থাকতেন তিনি। একাকী। তাঁর কোনো সঙ্গী বা স্ত্রী ছিল না, যাঁর কাছে তিনি ভালোবাসা পেতে পারেন, কথা বলতে পারেন, একাকিত্ব ঘোচাতে পারেন, প্রশান্তি লাভ করতে পারেন।

একদিন আদম (আ.) ঘুমিয়ে ছিলেন। জেগে উঠে দেখতে পেলেন, একজন নারী বসে আছেন তাঁর মাথার কাছে। এর আগে তিনি এমন অবয়ব বা মানুষ দেখেননি কোনোদিন। পরিচয় জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘আমি নারী।’ জানতে চাইলেন, ‘তোমাকে সৃষ্টির কারণ কী?’ বললেন, ‘আপনার প্রশান্তির জন্য।’

আল্লাহ সুরা নিসার ১ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা থেকে তাঁর স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাঁদের দুজন থেকে বহু নারী-পুরুষ ছড়িয়ে দেন।’

আরও পড়ুনমুসা (আ.)-এর বিয়ের শর্ত১৫ এপ্রিল ২০২৫

এ আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, আল্লাহুতাআলা হাওয়া (আ.)-কে আদম (আ.) থেকে সৃষ্টি করেছেন। এখানে দুই ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। ১. আল্লাহুতাআলা পুরুষের সঙ্গে তারই স্বজাতীয় অপর এক নারী সৃষ্টি করেছেন, যে পুরুষের জীবনসঙ্গিনী হয়ে থাকে। ২. হাওয়া (আ.)-কে আদম (আ.)-এর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (কাসাসুল কোরআন, ১/৪০)

তাফসিরবিদরা প্রথম ব্যাখ্যাকেই সমর্থন করছেন। এর সারমর্ম হলো, নারী জাতি পুরুষেরই স্বজাতীয় এবং একইভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।

নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টির কথা বলা আছে হাদিসে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং হাড়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বাঁকা হাড় হলো এটা (আর তা থেকেই নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে)। তুমি যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে তা ভেঙে যাবে আর যদি ছেড়ে দাও, তাহলে সব সময় তা বাঁকাই থাকবে। কাজেই নারীদের উত্তম উপদেশ দিতে থাকো।’ (বুখারি, হাদিস: ৫,১৮৫)

আরও পড়ুনস্বজাতিকে বাঁচাতে চাইল যে কাঠমিস্ত্রি১৬ এপ্রিল ২০২৫

আদম ও হাওয়া (আ.)-এর বসবাস শুরু হলো জান্নাতে। তাঁরা সেখানে একসঙ্গে থাকতে লাগলেন। তাঁদের জন্য অফুরন্ত নেয়ামতের ব্যবস্থা ছিল সেখানে। তাঁরা নেয়ামতের মধ্যে ডুবে ছিলেন। ইচ্ছামতো ঘুরতেন। পছন্দমতো খেতেন। এর মধ্যে আল্লাহ একটি গাছ দেখিয়ে বললেন, ‘তোমরা এর কাছে যেয়ো না।’ পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি বললাম, হে আদম, তুমি তোমার সঙ্গিনীকে নিয়ে জান্নাতে বাস করো এবং যেখানে ইচ্ছা যাও বা যা ইচ্ছা খাও, কিন্তু ওই গাছের কাছে যেয়ো না, গেলে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৯)

কিন্তু ইবলিসের প্রবঞ্চনায় আদম (আ.)-কে নিয়ে খেয়ে ফেলেন নিষিদ্ধ সেই গাছের ফল—আল্লাহ যা নিষেধ করেছিলেন। সীমালঙ্ঘন করায় আল্লাহ তাআলা আদমকে (আ.) তাঁর সঙ্গীনি হাওয়া (আ.)-সহ দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন। শুরু হলো পৃথিবীতে মানুষের বসবাস।

 লেখক: আলেম

আরও পড়ুনশীতল অগ্নি১৬ এপ্রিল ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ