লিফটে যান্ত্রিক ত্রুটি, ব্ল্যাকআউটে আটকা পড়া তিন নারীর জীবনের গল্প
Published: 23rd, January 2025 GMT
জমে উঠেছে নাটকপাড়া। একের পর এক মঞ্চায়ন হচ্ছে নতুন নতুন নাটক। ব্যতিক্রমী পরিবেশনা নিয়ে আসছে দলগুলো। তেমনই একটি ‘সাতকাহন’। নবরস নৃত্য ও নাট্যদলের ৪র্থ প্রযোজনা এটি। ভিন্নধর্মী একটি গল্পের নাটকটি দর্শক প্রশংসা কুড়িয়েছে। শামীম সাগরের রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সৈয়দা শামছি আরা সায়েকা।
চলতি বছরের প্রথম দিন এ উপলক্ষে গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ শো করেছে দলটি। আর দর্শকের জন্য বছরের শুরুতে ২-৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির ড.
নাটকের গল্পে দেখা যায়, এক পাঁচতারকা হোটেলের লিফটে যান্ত্রিক ত্রুটি। এরই সঙ্গে শহরের ব্ল্যাকআউটে আটকা পড়ে তিন ভিন্ন জগতের তিন নারী। এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী উঠতি অভিনেত্রী, এক গৃহবধূ, আর এক যৌনকর্মী। প্রথমে সন্দেহ, তর্ক আর অপমানের জালে জড়িয়ে পড়লেও ধীরে ধীরে নিজেদের জীবনের গল্পে তারা একে অপরকে চিনতে শুরু করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণ, বঞ্চনা আর ব্যক্তিগত সংগ্রামের গল্প তাদের এক অদ্ভুত বন্ধনে আবদ্ধ করে। লিফট সচল হলে, নির্দিষ্ট ফ্লোরে পৌঁছেও তারা আর বের হয় না। কারণ তারা বুঝে গেছে, তারা একই পুরুষের প্রতারণার শিকার এবং একে অপরের শত্রু নয়; বরং একই লড়াইয়ের সহযাত্রী। নাটকে তিন নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন রোজী সিদ্দিকী, সৈয়দা শামছি আরা ও মিতা গাঙ্গুলী।
উচ্চবিত্ত বিলাসবহুল জীবনের মধ্যে আসলে যে নারী অধিকারহীনতা, নারীর যন্ত্রনা ও নারী স্বাধীনতার অভাব রয়েছে তা নাটকের মধ্যে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্দেশক। এ নাটকের কাহিনি পরম্পরা। উচ্চবিত্ত জীবন নিয়ে এ ধরনের নাটক মঞ্চে আগে কখনও হয়নি। রোজী সিদ্দিকী, সৈয়দা শামছি আরা ও মিতা গাঙ্গুলীর অভিনয় ছিল অসাধারণ। তাদের প্রাণবন্ত অভিনয়, মিউজিক, লাইট ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে অনবদ্য পরিবেশনা ছিল। তবে পোশাকে নারী চরিত্রগুলো স্টাবলিস্ট হয়নি। পোশাকে কিছু পরম্পরাহীনতা মনে হয়েছে। তিনজন নারী প্রায় একই রকম ড্রেস পরেছেন, যে কারণে চরিত্রবিন্যাস আলাদাভাবে বুঝতে একটু অসুবিধা হয়েছে।
নাটকটি প্রসঙ্গে নাট্যকার শামীম সাগর বলেন, “নারীকেন্দ্রিক একটি নাটক লেখার অনুরোধ করেছিলেন নবরসের কর্ণধার শামছি সায়েকা। তখন থেকেই ভাবনাটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল; একসময় লেখার সূত্রটা মগজে ধরা দিল।
এরপরই ‘সাতকাহন’ রচনার যাত্রা শুরু হয়। আশা করি দর্শক নারীদের সাতকাহন দর্শন ও শ্রবণে ভাবিত হবেন, আবেগে ভাসাবেন নিজেদের, অন্তরের আয়নায় নিজেদের নতুন করে দেখবেন নিশ্চিতভাবে। আপনাদের ভালোলাগা আমার অনুপ্রেরণা। আপনাদের ভালোবাসা সাতকাহনকে পূর্ণতা দেবে।’
নির্দেশকের ভাষ্য, “নবরস দল থেকে শুধু নারীদের নিয়ে নাটক করার ইচ্ছা ছিল, বিশেষ করে সাতকাহন গল্পটার মতো পাণ্ডুলিপিতে। এমন একটি বিষয় নিয়ে নাটক করার তাড়না অনেক দিন ধরে মনে ধারণ করেছিলাম। নাটকটি মঞ্চে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য হলো, সমাজে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা। তবে তা সম্ভব না জেনে-বুঝেও চেষ্টাটুকু করা মাত্র। শামীম সাগরের এমন নিপুণ আর শৈল্পিক লেখায় মুগ্ধ আমরা সব অভিনয় শিল্পীরা। ধন্যবাদ জানাই তাকে ও নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত কলাকুশলী ও নেপথ্যে যুক্ত সব শিল্পীবৃন্দের।
কন্যা-জায়া-জননী এই ৩টি শব্দের তাৎপর্য বিশাল। একজন নারীকে মা হিসেবে, কন্যা হিসেবে বা স্ত্রী হিসেবে যে সম্মান সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন তা অতুলনীয়। সৃষ্টিকর্তা যে সম্মান, গুরুত্ব ও মর্যাদা নারীদের দিয়েছেন, সে দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবারের সমাজের কাছ থেকে, পাচ্ছে কিনা বা মিলছে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান গোটা পৃথিবী। পুরুষশাসিত সমাজে সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে, নারীদের জীবনের এই নাটকীয় অবস্থান।”
প্রযোজনাটির পোশাক পরিকল্পনা করেছেন ওয়াহিদা মল্লিক জলি। সংগীত পরিকল্পনা করেছেন গোপী দেবনাথ। নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন সৈয়দা শামছি আরা সায়েকা। আলোক পরিকল্পনা করেছেন পলাশ হেন্ড্রি সেন আলো। সেটা ডিজাইন করেছেন শামীম সাগর।
২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল ‘নবরস’ নৃত্য ও নাট্যদলের যাত্রা শুরু হয়। দলটির অন্যান্য প্রযোজনাগুলো হলো– ঊনপুরুষ (মঞ্চনাটক, ২০২৩), আর্তনাদ ও দ্য ক্লেইম (পথনাটক, ২০২৪)।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।
আরো পড়ুন:
খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’
‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।
মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।
বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন।
জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’
‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’
ঢাকা/তারা