কুড়িগ্রামে ‘ঐতিহাসিক’ এক কৃষক মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে কৃষক ও ভিআইপিদের জন্য প্রস্তাবিত খাবারের বৈষম্যমূলক বরাদ্দের বিষয়ে। চেয়ে টাকা না পাওয়ার তথ্য দিয়ে আয়োজনের আহ্বায়ক বলছেন, এ ধরনের সমালোচনা শিশুসুলভ।

২৬ জানুয়ারি জেলার চিলমারী উপজেলায় অনুষ্ঠেয় এই কর্মসূচিতে যোগদান করা কৃষকদের জন্য একবেলা খাবারের জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা বরাদ্ধ ধরা হলেও ভিআইপিদের জন্য রাখা হয়েছে ৫০০ টাকা। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, কৃষকদের পেট কী আর বড় হবে না?

নাহিদ হাসান নলেজ নামে একজন শিক্ষকের সই করা এ-সম্পর্কিত একটি চিঠি বুধবার থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে খাবারের বরাদ্দ এবং অনুষ্ঠানের ব্যযের একটি ছক রয়েছে। আর তা নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা। অনেকে জানতে চাইছেন, কে এই নাহিদ হাসান নলেজ, কৃষকদের নিয়ে কী কাজইবা রয়েছে তার।



আরো যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগ হলেও সরকারি বরাদ্দ টানার চেষ্টা, আয়োজকরা ১ লাখ কৃষকের সমাবেশ ঘটানোর কথা বলে কেন ৩০ হাজার জনের বরাদ্দ চেয়েছেন।

‘উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন গণকমিটি’ নামে একটি ব্যানারের আহ্বায়ক পরিচয় দিয়ে জেলা প্রশাসককে মাধ্যম করে ব্যয় সংকুলানের টাকা চেয়ে নাহিদ হাসান চিঠিটি পাঠিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর।

তবে আয়োজকরা বলছেন, হাট-ঘাট থেকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির জন্য এই মহাসমাবেশ। এখানে খাবার কোনো বিষয় নয়। সরকারের কাছে একটি সহায্য চাওয়া হয়েছিল, সেটি পেলে ভালো হতো; পাওয়া যায়নি; তবু সমাবেশ হবে নির্ধারিত দিনেই।

চিঠির ভাষায় যা আছে
কথিত আহ্বায়ক নলেজ সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, “বিনীত নিবেদন এই যে, কৃষক-জেলে-তাঁতীরা যুগ-যুগান্তের বঞ্চিত ও ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। তাদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে আগামী ২৬ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে উপস্থিত থাকবেন রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের সব জেলার কৃষকরা। আশা রাখি, লক্ষাধিক কৃষক এতে উপস্থিত হবেন।”

“আমরা তাদের মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার কৃষককে এক বেলা আহার করাতে ইচ্ছুক। উল্লেখ্য, উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম (বীরপ্রতীক)।”

অর্থ বরাদ্দে জনাবকে (সচিব) আজ্ঞা দেওয়ার নিবেদন করে তার নিচে একটি ছক করে বরাদ্দের ধরন ও টাকার অঙ্ক দিয়েছেন আহ্বায়ক নলেজ। সে অনুযায়ী, ৩০ হাজার কৃষক-জেলের খাবারের জন্য ২০০ টাকা হারে ৬০ লাখ, ভিআইপি ১০০ জনের খাবারের জন্য ৫০০ টাকা হারে ৫০ হাজার এবং স্টেজ, সাউন্ড সিস্টেম, গেট, লাইটিং, বসার ব্যবস্থা, তোরণ এবং আনুষাঙ্কিত অন্যান্য ৫ লাখ টাকার বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে।

অতিথি যারা
আয়োজকরা যে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন, সে অনুযায়ী এই কৃষক সমাবেশে বিশিষ্টজনদের অতিথি করা হয়েছে। বলা হচ্ছিল, সমাবেশ উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।

অতিথি হিসেবে আরো যাদের নাম প্রচার করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছেন: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, লেখক ও সংগঠক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খান, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কারাবন্দি নেতা কনক রহমান, জাতীয় নাগরিক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কবি আব্দুল হাই শিকদার, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি আহমেদ ইসহাক।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব মোর্শেদ, লেখক-সংগঠক রাখাল রাহা ও পাভেল পার্থ, বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শেখ নাছির উদ্দিন, কৃষক দেলোয়ার জাহানের নাম আয়োজকদের প্রচারে রয়েছেন।

চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের জোড়গাছে সফি আলম রাজা স্টেডিয়ামে এই মহাসমাবেশে বিভিন্ন জেলার  কৃষকদের জমায়েত ঘটানোর চেষ্টা করছেন আায়োজকরা।

ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
ইমতে আহসান শিলু নামে একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক তার ফেসবুক পোস্টে চিঠিটি দিয়ে লিখেছেন, “বৈষম্যহীন রাষ্ট্রে মো.

নাহিদ হাসানের আহ্বানে কৃষকের জন্য খাবার বরাদ্দ ২০০ টাকা আর ভিআইপিদের খাবার ৫০০ টাকা!”

ইমতে আহসান শিলুর সঙ্গে কথা হলে রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা কৃষকের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা।”

কুড়িগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক হারুন অর রশিদ তার ফেসবুকে লিখেছেন, “সমাবেশ করবেন আপনারা, খরচের টাকা চেয়ে আবেদন করবেন সরকারের কাছে। এটা কোন ধরনের আবদার।”

নাহিদ হাসান নলেজের সঙ্গে কথা হলে রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেন, “হাট-ঘাটের ইজারা বাতিল, কৃষকদের উৎপাদিত পণের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও চরের মানুষের নদী ভাঙনের বিষয় নিয়ে একটি ঐতিহাসিক কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেছি।”

“এই কৃষক সমাবেশে পাবনার কৃষক, কক্সবাজারের লবণ চাষীসহ সারা দেশ থেকে লোজন আসবেন। আমরা তো সরকারের কাছে আবেদন করতেই পারি। আমরা কৃষকদের একবেলা খাওয়াতে চাই। যদি সরকার দেয়, তো দেবে। এ বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি।”

প্রেক্ষপট ও জেলা প্রশাসকের বক্তব্য
আহ্বায়ক নলেজ বলেন, “আমরা ডিম-খিচুরি খাওয়াইতে চাইছিলাম। কিন্তু সরকারের লোকজনই বলেছে যে, ৬০ টাকা হবে কেন? আপনারা মুরগি দিয়ে খাওয়ান। এতে কৃষকপ্রতি গড়ে ২০০ টাকা করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। মহাসমাবেশে ৩০ হাজারের অধিক লোক হবে। এই ৩০ হাজার কৃষকের জন্য ৬০ লাখ টাকা লাগছে। তার সঙ্গে ডেকোরেটরের ভাড়া রয়েছে। উপজেলা পরিষদে অতিথিরা খাবেন। সব মিলে ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাজেট দিয়েছি।”

আবেদন করলেও সরকারের কাছ থেকে কোনো টাকা পাননি জানিয়ে নজেল বলেন, “টাকা কি আমরা পেয়েছি? সরকার আমাদের টাকা দিলে দেবে, না দিলে নাই। আবেদন করেছিমাত্র। একটি আবেদন নিয়ে শিশুসুলভ কথাবার্তা আমি হাস্যকর ঘটনা বলে মনে করছি।”

মহাসমাবেশের চিঠি নিয়ে হুলস্থূল শুরু হলে বিষয়টি জানতে রাইজিংবিডি ডটকম কথা বলেছে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেছেন, “আমাদের কাছে চিঠি আসায় তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বরাদ্দ দেবে কি দেবে না, সেটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়।”

কে এই আহ্বায়ক নলেজ
নাহিদ হাসান নলেজ চিলমারীর শাখাহাতি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক; উপজেলার রমনা সরকার বাড়ী গ্রামের বাসিন্দা তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি একসময় ‘রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি’ নামে একটি সংগঠন করেছিলেন তিনি।  কৃষি রক্ষা, কৃষকের অধিকার ও পরিবেশ নিয়ে সচেতন এই মানুষটি নিজের মতো করে অনেক কাজ করে চলেছেন।

কৃষকদের নিয়ে কেন মহাসমাবেশ ঘটাচ্ছেন, জানতে চাইলে নলেজ বলেন, “এই সমাবেশ কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে করা হয়নি। এটা মূলত নিজেদের উদ্যোগে করা। কেউ করতেও বলেনি।”

শিক্ষক নজেলের বাড়ি চিলমারীতে হলেও বর্তমানে তিনি কুড়িগ্রাম জেলা শহরের কলেজপাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।

কৃষকদের এই মহাসমাবেশ সমাজের দশজন মিলেই ডাকা হয়েছে জানিয়ে নলেজ বলেন, “কৃষকদের কথা চিন্তা করে করা হয়েছে। তা ছাড়া জমিদার না থাকলেও এখনো জমিদারি প্রথার মতো হাটে-ঘাটে খাজনা তোলা হচ্ছে। এটার প্রতিবাদ করার জন্যই নিজেরা চিন্তা করে ১০ জন মিলে আলোচনা করে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।”

সরকারি সহযোগিতার ওপর সমাবেশটি নির্ভর করছে না, যা তাদের প্রচারপত্র দেখে বোঝা যায়। এটি মূলত জনগণের অর্থায়নের বাস্তবায়নের লক্ষ্য থেকে শুরু করা। প্রচারপত্রে দেখা যায়, সর্বসাধারণের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা চেয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নম্বর দেওয়া হয়েছে। জনগণের স্বার্থে এ ধরনের তহবিল সংগ্রহকে বলা হয় ক্রাউড ফান্ডিং, যার অর্থ মানুষের ছোট ছোট আর্থিক সহায়তা তাদেরই বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য কিছু করা।

‘অতিথিরা না এলেও সমাবেশ হবে’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তারা আসবেন না বলে নিশ্চিত করেছেন কৃষক মহাসমাবেশের এই আহ্বায়ক। নলেজ বলেছেন, “তারা না এলেও সমবাবেশ হবে।”

দুই উপদেষ্টার কুড়িগ্রাম সফর উপলক্ষে বুধবার (২০ জানুয়ারি) জেলা প্রশাসক বরাবর মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এলেও বৃহস্পতিবার তাদের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারির কুড়িগ্রাম সফর স্থগিত করে জেলা প্রশাসক বরাবর মন্ত্রণালয় থেকে আবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তবে উপদেষ্টারা কৃষক সমাবেশে না থাকলেও কর্মসূচি স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি।  এমনকি সরকারের চেয়েও টাকা না পাওয়াকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না নলেজ। তিনি বলেছেন, “অনুষ্ঠান হবে।”

বৃহস্পতিবারও চিলমারীতে এই কর্মসূচি ঘিরে আয়োজকদের প্রচার-প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।

সমাবেশ উপলক্ষে তৈরি করা একটি পোস্টারে দেখা গেছে, একপাশে মওলানা ভাষানী ও অন্য পাশে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ছবি দিয়ে বেশ কিছু কথা লেখা হয়েছে; যা থেকে সমাবেশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায়। সেখানে গোবিন্দগঞ্জ-ফুলবাড়িতে সাঁওতাল কৃষকদের নামে মামলা প্রত্যাহারের দাবি রয়েছে। সব মিলে ১২টি দাবি নিয়ে এই মহাসমাবেশ ডাকা হয়েছে।

ঢাকা/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সরক র র ক ছ র উপদ ষ ট ৩০ হ জ র র র জন য ক ষকদ র ২০০ ট ক উপস থ ত ধরন র উপজ ল ভ আইপ

এছাড়াও পড়ুন:

সন্তানদের টানে বিচ্ছেদ থেকে বন্ধন, আদালত চত্বরে আবার বিয়ে

তিন বছর আট মাস আগে বিবাহবিচ্ছেদ হয় এক দম্পতির। পরে দুই কন্যাসন্তানের হেফাজত চেয়ে আদালতে পাল্টাপাল্টি মামলা করেন মা ও বাবা। শুনানির সময় বাবার সঙ্গে আদালতে সন্তানদের দেখা হতো। কিন্তু এতটুকু দেখাতে মন ভরত না সন্তানদের। সন্তানেরা মা-বাবাকে সব সময় একসঙ্গে কাছে পেতে চাইত। সাত বছর বয়সী বড় কন্যা প্রতিবার সাক্ষাতের সময় কান্নাকাটি করে মা-বাবাকে একসঙ্গে থাকার জন্য আকুতি জানাত।

পরে দুই কন্যার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে  ব্যথা ও অভিমান ভুলে ওই দম্পতি আবার একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় তিন বছর মামলা চালানোর পর গত মার্চ মাসে আদালত চত্বরে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মলয় কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, শুধু কন্যাদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ওই দম্পতি আবার এক হয়েছেন। আপসের পর ধর্মীয় বিধান মেনে আদালত চত্বরে তাঁদের আবার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তাঁরা সংসার শুরু করেছেন।

যেভাবে দ্বন্দ্ব, যেভাবে আপস

২০১৭ সালে পারিবারিকভাবে এই দুজনের বিয়ে হয়। তাঁরা দুজনই উচ্চশিক্ষিত। দুজনই উচ্চপদে চাকরি করেন। বিয়ের পর নারীর বাবার বাড়িতে তাঁদের সংসার শুরু হয়। পরে রাজধানীতে একটি ভাড়া বাসা নিয়ে থাকা শুরু করেন। বিয়ের এক বছরের মাথায় তাঁদের কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।

নারীর ভাষ্য, বিয়ের পর তাঁদের সংসার ভালোই চলছিল। স্বামী যৌতুক চেয়েছিলেন। এ কারণে মেয়ের সুখের কথা ভেবে যৌতুক হিসেবে ছয় লাখ টাকা ব্যয় করে টিভি, ফ্রিজ, খাট ও আলমারি উপহার দেন তাঁর বাবা।

মামলায় ওই নারী অভিযোগ করেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তাঁর স্বামীর ভাড়া বাসায় ওঠার কয়েক মাস পর থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। ভাড়া বাসার পাশে তাঁর ননদের বাসা ছিল। শাশুড়ি কখনো তাঁদের সঙ্গে, আবার কখনো মেয়ের বাসায় থাকতেন। তুচ্ছ কারণে শাশুড়ির সঙ্গে তাঁর প্রায় সময় মনোমালিন্য হতো। এ নিয়ে স্বামী তাঁকে কটু কথা বলতেন। একপর্যায়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতেন স্বামী। তবু সন্তানের কথা ভেবে অত্যাচার সহ্য করে সংসার করতে থাকেন তিনি।

মামলায় ওই নারী আরও অভিযোগ করেন, একপর্যায়ে বাবার কাছ থেকে জমি লিখে নিতে স্বামী তাঁকে চাপ দিতে শুরু করেন। এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। একসময় তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। পরে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিয়ের চার বছরের মাথায় তিনি স্বামীকে তালাক দিয়ে সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান।

তালাক কার্যকরের (তিন মাস) আগে স্বামীর পরিবারের সদস্যরা তালাকের নোটিশ প্রত্যাহারের অনুরোধ করতে থাকেন। স্বামী ও তাঁদের স্বজনেরা ওই নারীর কাছে অঙ্গীকার করেন, আর কখনোই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হবে না। স্বামীর অনুরোধ ও সন্তানের কথা ভেবে কার্যকর হওয়ার আগে ওই নারী তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করে নেন। আবার সংসার শুরু করেন।

আদালতের কাছে নারী দাবি করেন, আবার সংসার শুরুর পর থেকে কয়েক মাস তাঁর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। তবে দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে আসার পর থেকে আবারও স্বামী নির্যাতন করা শুরু করেন। তিনি এতটাই উগ্র হয়ে ওঠেন যে নির্যাতন ঠেকাতে পরিবারের অন্য সদস্যরা এগিয়ে এলে স্বামী তাঁদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আবারও স্বামীর বাসা ছেড়ে চলে যান বাবার বাসায়। ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট তিনি আবার তাঁর স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেন। তালাক কার্যকরও হয়। ছয় মাস পর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর দ্বিতীয় কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। স্বামী কখনো দ্বিতীয় সন্তানকে দেখতে আসেননি।

তবে এই নারীর সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তাঁর সাবেক স্বামী। সাবেক স্বামীর অভিযোগ, তাঁর মায়ের সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনা হতো না। এ কারণে স্ত্রী প্রায় সময় তাঁর মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। একদিন রাগ করে তাঁর স্ত্রী বড় মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর কন্যাদের দেখতে তিনি শ্বশুরবাড়িতে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে মারধর করেন। এ সময় তিনি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ ফোন দেন। পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে।

এ ঘটনার পর তাঁদের দুজনের মধ্যে আর কোনো সমঝোতা হয়নি। পরে দুই কন্যার হেফাজত চেয়ে সাবেক স্ত্রীকে বিবাদী করে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন সাবেক স্বামী। অন্যদিকে ওই নারীও সাবেক স্বামীকে বিবাদী করে একই ধারায় মামলা করেন।

আরও পড়ুনবিয়ের অনেক বছর পরও কেন বিচ্ছেদ হয়১০ জুলাই ২০২৪

বিবাদীপক্ষের আইনজীবী মলয় কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, এই দম্পতির বড় সন্তানের বয়স প্রায় সাত বছর, আর ছোট সন্তানের বয়স চার বছর। পারিবারিক আদালতে মামলার শুনানি চলাকালে আদালতকক্ষে স্বামী-স্ত্রীর দেখা হতো। দুই কন্যা তখন মা–বাবা দুজনের সঙ্গেই কথা বলত। তারা কান্নাকাটি করত; সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতে চাইত। একসময় স্বামী-স্ত্রী দুজনই সন্তানের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে আবার একসঙ্গে সংসার করার সিদ্ধান্ত নেন।

আইনজীবী মলয় কুমার সাহা বলেন, মা–বাবার বিচ্ছেদের পর সন্তানেরা মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়। শিশুর মানসিক বিকাশে মা–বাবার আদর-ভালোবাসা বিরাট ভূমিকা রাখে। বিচ্ছেদের কারণে আদর-ভালোবাসার ঘাটতি সন্তানদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এ কারণে দুই কন্যার মানসিক সুস্থতার কথা ভেবে গত মার্চ মাসে আপস করে ওই দম্পতি আবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা সংসার শুরু করেছেন। তাঁদের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তাঁরা এখন সুখে আছেন।

আরও পড়ুনবিচ্ছেদের ৫০ বছর পর আবার একসঙ্গে দুজন ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪আরও পড়ুনডিভোর্সের পরও সন্তানের কথা ভেবে এক ছাদের নিচে থাকা কি ঠিক২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ