Samakal:
2025-11-02@18:44:54 GMT

শত বাদ্যের কারিগর

Published: 24th, January 2025 GMT

শত বাদ্যের কারিগর

সুনির্মল দাস বাপী, নিত্যনতুন বাদ্যযন্ত্রের কারিগর। গোপালগঞ্জ জেলার গান্ধিয়াশুর গ্রামে ১৯৯৩ সালে তাঁর জন্ম। স্কুলশিক্ষক বাবা সুনীল কুমার দাসের কাছ থেকে বরাবরই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। সুনীলও গান-বাজনায় ছিলেন পারদর্শী। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে সংগীতচর্চার পরিবেশ পেয়েছেন সুনির্মল দাস। বাবার কাছ থেকে শেখেন একতারা বাজানো। কাকার কাছ থেকে ঢাক বাজানো। প্রতিবেশী বর্ষীয়ান কারুশিল্পী বিজয় পাণ্ডের কাছ থেকে প্রথমে দোতারা, বেহালাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা শেখেন। কিশোর বয়স থেকেই সুনির্মল সামনে যা পান, তা দিয়েই সুরের খেলায় মেতে ওঠেন। বানাতে থাকেন একের পর এক নিত্যনতুন বাদ্যযন্ত্র। লিখেছেন শিশির কুমার নাথ

‘আমার ছিঁড়ে গেছে একতারার তার হয় না গাওয়া বাউল গান।’ সাধের একতারার তার ছিঁড়ে গেলে কি আর বাউল গান হয়? গানের কথায় তো প্রশ্নের জবাব রেখে গেছেন সাধক বাউল। তা তো জানা ছিল না বাদ্যপাগল এক কিশোরের। বয়স সাত কী আট। সেই কিশোর বাবা-কাকার হাত ধরে ছুটে যেত পালাগান, কবিগান, হরিসভা কীর্তন, বাউল-ভাটিয়ালির আসরে। ছুঁয়ে দেখত বাদ্যের শরীর। একবার এলাকায় এক মহোৎসবে দূর-দূরান্ত থেকে শিল্পীরা এসেছেন। কিশোর ছেলেটির নজর পড়ল বাউলের একতারায়। আনাড়ি হাতের আঁচড়ে একতারার তার গেল ছিঁড়ে। বাউল বেশ বিরক্ত হলেন ছেলেটির ওপর। ছেলের এমন কাণ্ডে বাবাও বিব্রত। কিছুদিন পর একটি একতারা কিনে নিয়ে এলেন বাড়িতে। ছেলেকে বললেন, ‘দেখ বাজে কিনা?’ হাত ধরে শিখিয়ে দিলেন। সেই থেকে শুরু। তারপর হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তাতেই ওঠে সুর-তাল। খেলনা কিংবা ফেলনা, সবেতেই কেবল সুর খোঁজা। বাদ্যের সে ভান্ডারে কখনও যোগ হয়েছে ঘটি-বাটি, কখনও নারকেলের মালা। কখনও বুনো বাঁশ কোকিলের কণ্ঠ নিয়ে বাজছে নির্ভুল। কখনও আবার সুর উঠেছে শামুক-ঝিনুকে। 
চার ভাই-বোনের মধ্যে সুনির্মল দাস বাপী সবার ছোট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর এলএলবি সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার রাহুথড় ইউনিয়ন ভূমি অফিসে কর্মরত। 
একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নারকেলের মালা দিয়েও যে একতারা তৈরি করা যায়, তা দেখে অনেকটা অবাক হন সুনির্মল। পরে বিভিন্ন লোকবাদ্য তৈরি ও বাজানোর তালিম নেন। বাসু বালার কাছ থেকে বেহালা, গোপাল শর্মার কাছ থেকে খমক, নিরঞ্জন ওস্তাদের কাছ থেকে সরোদ, অমিতোষ বিশ্বাস ও ভবানী শংকর বিশ্বাসের কাছ থেকে তবলা বাজানোর হাতেখড়ি নেন।
সুনির্মল দাসের তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– একতারা, দোতারা, সারিন্দা, খমক খঞ্জনি, কাঠসেকার, চুড়িসেকার, মনসেকার, পাখিবাঁশি, বাঁশের বাঁশি, সরোদ, বেহালা, কাহন, ঢাক-ঢোল, তবলা, গোপীযন্ত্র, জলতরঙ্গ, কোকিলের ডাক, সানাই, প্রেমজুড়ি, রাবনবীণা, পাখওয়াজ, নাল, ডুগডুগি; বাঁশ থেকে তৈরি ফুরাংফাং, চটা, মোহনবাঁশি; নারকেলের মালা থেকে একতারা, ম্যাচবক্স, বীণ, মেরাকাচ, শিঙা, কাঠের ঘণ্টা, অ্যাম্বুলেন্স বাঁশি প্রভৃতি। এর প্রতিটি যন্ত্র বাঁজাতেও পারেন। নিজের খেয়ালে টিউন করেন। বললেন, ‘বাজারে প্রচলিত একতারা তো টেনটেন করে। আমারটার সুর অনেক ভরাট, গম্ভীর। আমার বানানো জলতরঙ্গের সুরে একটা কোমলতা আছে, একটা শীতল অনুভূতি আছে; ওটা সচরাচর পাবেন না।’ বাপী আরও বলেন, ‘আমি যেখানে যাই, সেখানেই বাজানোর জন্য নতুন কিছু পাওয়া যায় কিনা খোঁজ করি। তেমন কিছু পেলে সংগ্রহ করি। হাতের কাছের জিনিস নিয়ে সুর-তালের খেলা করি। নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করি। পাড়া-প্রতিবেশীরাও প্রশ্রয় দেয় খুব। কেউ একটা নারকেলের মালা অথবা লাউয়ের খোল পেলেও রেখে দেয় আমার জন্য।’
জানার আগ্রহ হলো ব্যতিক্রমী পাখিবাঁশিটি নিয়ে। বাপী জানালেন, একবার তিনি বইমেলায় গিয়েছেন। সেখানে এক লোক সিরামিকের বাঁশি বিক্রি করছেন। পানি ভরে ফুঁ দিলে পাখির ডাকের মতো শব্দ হয়। ১০০ টাকা দিয়ে কিনলেন বাঁশিটি। বাজে চমৎকার। হাত থেকে পড়লে তো ভেঙে যাবে, আবার দামও বেশি। ভাবলেন এমন বাঁশি নিজে বানানো যায় কিনা। যেই ভাবনা, সেই কাজ। হাতের কাছে আছে একটি নাকের ড্রপ আর ললিপপ চকলেটের পাইপ। খানিকক্ষণ চেষ্টায় হয়ে গেল শিসবাঁশি। পানি ভরে ফুঁ দিলে পাখির ডাকই শোনা যায়। 
প্রতিবেশী অমূল্য দাদুর কাছে দেখেন শামুকযন্ত্র। তিনি সুর তুলছিলেন যন্ত্রটি দিয়ে। দাদুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথা থেকে পেয়েছেন?’ তিনি বললেন, ‘এটি আমি ছোটবেলা থেকে নিজেই শিখেছি।’ তারপর তাঁর কাছ থেকে শিখলেন শামুক দিয়ে বাদ্য তৈরি। সুর তোলা যায় ম্যাচ বাক্সেও। এটা জানতে পেরে ম্যাচ বাক্স বা দেশলাই দিয়ে বাজানোর চেষ্টা করেন বাপী। স্থানীয় শহীদ মিয়া ও পরিতোষ বিশ্বাসের কাছ থেকে শিখেছেন এ যন্ত্রে সুর তোলার পদ্ধতি। 
এভাবেই বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়েছে সুনির্মলের সুনিপুণ হাতে। তাঁর ছোট ঘরটি যেন লোকবাদ্যের এক বিরল সংগ্রহশালা। সব জায়গায়তেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা বাদ্যযন্ত্র এবং তা তৈরির উপকরণ। সুনির্মল একসময় ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করতেন। কখনও অভিনয় করে লোক হাসিয়ে উপার্জন করতেন। সেই টাকা জমিয়ে বাদ্য বানাতেন। এখন অবশ্য রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে। তবে যৌথ পরিবারে অভাব তো আর পিছু ছাড়ে না। মাঝে মধ্যে দু’একটা বাদ্য বিক্রি হয়। তাতে খুব লাভ হয় না। নিজের তৈরি এসব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রদর্শনী করেছেন একাধিকবার। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উদীচী সম্মেলনে প্রদর্শনী করে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। একই বছর গোপালগঞ্জেও লোকজ বাদ্য প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন জায়গায় বাদ্য প্রদর্শনীতে অংশ নেন। প্রদর্শনীর পাশাপাশি এসব বাদ্য বাজিয়েও মানুষকে শোনান তিনি। বিলম্বিত বিরহে নামক একটি নাটকে খমক বাজিয়ে অভিনয়ও করেছেন। ভবিষ্যতে সাহায্য-সহযোগিতা পেলে নিজ বাড়িতে বাদ্যযন্ত্রের একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার আশা ব্যক্ত করেন সুনির্মল দাস বাপী। হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের সুর শোনাতে চান নতুন করে। এসবের মধ্য দিয়ে যেন জোড়া লাগাতে চান শৈশবে ছিঁড়ে ফেলা বাউলের একতারাটি। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রদর শ একত র

এছাড়াও পড়ুন:

প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত

বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ। 

সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।

আরো পড়ুন:

একা বাস করতে পারে যে পাখি

কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?

সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।

তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না। 

এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস। 

তিনি জানেন,  প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে।  বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।

সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন। 

একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।

সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।

চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।

গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বর্তমান সংকটের জন্য সরকার দায়ী, দলগুলোর চাপে সিদ্ধান্ত বদল
  • প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত