তাসকিন আহমেদ হাসছেন। প্রশ্নটা বিব্রতকর। যেকোনো পেশাদার খেলোয়াড়ের জন্য হতাশাজনক। কিন্তু ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার’ অবস্থানে থাকায় সুদর্শন পুরুষের মুখে হাসি ছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই!

‘‘আমার জীবনে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো। ম্যাচের দিন আমরা হোটেল পরিবর্তন করলাম। মাঠে আসার দুই ঘণ্টা আগে শুনলাম বিদেশি ক্রিকেটার কেউ আসবেন না।’’ ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এ-ও সম্ভব?

দুর্বার রাজশাহী দলে খেলে দিনভর যে নাটকের সাক্ষী হতে হয় অধিনায়ককে…এরপর মাঠে নেমে পারফর্ম করে, দলকে নেতৃত্ব দিয়ে জেতাতেও হয়। নিজের প্রতি বীরত্ব দেখানোর জন্যও তাকে আবার হাসতে হয়।

হাসতে হাসতেই তাকে বলতে শোনা যায়, ‘‘সত্যি বলতে, দিনের শুরু থেকে সব খেলোয়াড়দের অনেক ড্রামা দেখেছি। পরবর্তীতে শুনেছি টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে বলা হয়েছে, টাকা দিয়ে বিদেশি ক্রিকেটারদের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু, কেউ গেট-ই খুলেনি। শেষ পর্যন্ত আমরা স্থানীয় ক্রিকেটাররাই ছিলাম।’’

ম্যাচের দিন সকালে টিম হোটেল পরিবর্তন। ২০১৩ সাল থেকে পেশাদার ক্রিকেট খেলা তাসকিনের প্রথম অভিজ্ঞতা। গতকাল সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে জানতে পারেন রুম ছেড়ে দিতে হবে। অগত্যা বেরিয়ে পরেন নতুন গন্তব্যে। সেখানে গিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া করছিলেন। তখনই খবর আসে, দলের বিদেশি ক্রিকেটাররা মাঠে যাবেন না পারিশ্রমিক পাননি বলে। নিজে সতীর্থদের বুঝিয়েও রাজী করাতে পারেননি। পরে বোর্ড থেকে ফোন করে আশ্বস্ত করায় স্থানীয় ১১ ক্রিকেটারকে নিয়ে মাঠে নামতে হয় রাজশাহীকে।

স্থানীয় শক্তিতে বলিয়ান হয়ে মাঠে সত্যি-ই দুর্বার রাজশাহী। টেবিল টপার রংপুর রাইডার্সকে ২ রানে হারিয়ে দেয়। অগোছালো দলে এই জয় স্বস্তির পরশ আসলেও কীভাবে সম্ভব হয়েছে তা জানাতে গিয়ে খোলা মনে তাসকিন বলেছেন, ‘‘টিম অ্যাফোর্ট, সবার অবদান ও দিল (হৃদয়) থেকে চেষ্টা করার রিওয়ার্ডটা শেষে পাওয়া গেছে। শুরুর দিকে আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও বিরক্ত ছিলাম। কিন্তু, পরে তো দেখলেনই। জিতে গেলাম আল্লাহর রহমতে।’’

বিপিএল এমনিতেই সমালোচনায় ভরা। নবাগত দল দুর্বার রাজশাহীকে ঘিরে সমালোচনাটা আরো বেশি। অগোছালো পরিবারে নেই একটু স্বস্তি, পেশাদারিত্ব। আজ এই সমস্যা তো কাল ওই সমস্যা। নানা কারণে, নানা জটিলতায় আটকে থাকায় দলটিতে খেলার মানসিকতা ও পরিবেশ থাকে কিনা সেই প্রশ্নও করা হয়েছিল তাসকিনকে। যিনি মাত্র তিন ম্যাচ আগে এনামুল হক বিজয়ের পরিবর্তে দলটির নেতৃত্ব পেয়েছেন।

তাসকিন যা বললেন তাতে দাঁড়ায়, ক্রিকেট আয় রোজকারের তাদের একমাত্র উপায় বলে খেলাটা এখন নিজেদের জন্যই তারা খেলছেন। সামনে তা-ই করবেন।

‘‘আমি আসলে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার চেষ্টা করছি। উপভোগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কেননা ক্রিকেটই আমার ব্রেড অ্যান্ড বাটার। প্যাশন। মাঠে আমরা উপভোগ করেছি সবাই। স্থানীয় ক্রিকেটারদেরও কিন্তু তেমন বড় নাম নেই দু-তিনজন ছাড়া। বিদেশিরা তো খেলেননি। আমরা সবাই বলেছি, ‘‘লেটস ট্রাই’’। সবাই অনেক ইতিবাচক ছিল। আমি উপভোগ করেছি প্রতিটি মুহূর্ত। সাহস করে করে পরিবর্তন করেছি। যেই যখন বোলিং করেছে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছে। প্রত্যেকেই বুঝেছিল আমাদের হারানোর তেমন কিছু নেই। আমরা আমাদের সেরাটা দিয়ে দেখতে পারি শেষ পর্যন্ত কি হয়। শেষে তো আমাদের পক্ষেই ফল এসেছে।’’

ফ্রাঞ্চাইজি মালিকদের এমন অপেশাদারিত্ব সুলভ আচরণ ক্রিকেটারদের অনুভূতিতে আঘাত আনে জানিয়ে তাসকিন বলেছেন, ‘‘সত্যি বলতে, শুধু আমি না দলের ভেতরে কেউই এরকম যখন ঘটে ভালো অনুভব করে না। বিপিএল আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা। এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে আমাদের সবার একটা প্রত্যাশা থাকে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে থেকে খেলব। যে পরিমাণে ক্রাউড হচ্ছে, আগের চেয়ে জমজমাট বিপিএল হচ্ছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দলে বেশ কিছু সমস্যা হয়েছিল।’’ 

খেলাটা এখন তাসকিনদের কেবল নিজেদের জন্যই, ‘‘সবাই মিলে একটা কথাই বারবার বলছিলাম যে, যেহেতু আমাদের সবার নিজেদের প্রমাণ করার জায়গা একটা, যতই সমস্যা হোক এগুলো একটা সাইডে রেখে মাঠে উপভোগ করতে হবে। সবার ব্রেড অ্যান্ড বাটার, ক্যারিয়ার, জাতীয় দল সবকিছু, নিজেকে প্রমাণের মঞ্চ এটাই। তো এই জিনিসগুলোই আমাদের দলের সবাইকে বুষ্ট আপ করেছে। অনুভূতিটা অবশ্যই নাইস না। এর মধ্য দিয়েও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’’

রাজশাহীর ‘অভাবের সংসারে গোবরে পদ্মফুল’ ফোটানোর চেষ্টায় রাজশাহীর অধিনায়ক, ‘‘অনেক কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আমার মনে হয় এতো সমস্যার মধ্য দিয়ে, এতো চাপের মধ্যে থেকে খেলাটা ভবিষ্যতে উপকারে আসবে। এতো চাপের মধ্যে ভালো খেললে সামনে খেলাটা সহজ হয়ে যাবে।’’

তাসকিন হাসেন। হাসতেই থাকেন। হাসির আড়ালে কষ্ট লুকিয়ে রেখেছেন। ওই কষ্টও আড়াল হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। জয়ের আনন্দে। কিন্তু দাগটা থেকে যায়। হাসিতেও তা মুছে না।

ঢাকা/ইয়াসিন

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন য সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন

দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।

নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।

মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।

ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।

শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।

চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।

কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।

পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।

ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।

এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ