মাঘের সন্ধ্যায় বিয়ের দাওয়াত। আলমারির তাকে যে শাড়িগুলো রয়েছে সেগুলোয় চোখ বোলালেন নিকিতা। তাঁর চোখ আটকে গেল বছর দুই আগে কেনা একটি সিল্কের শাড়িতে। গায়ে জড়াতেই কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল চেহারা। বিয়ের দাওয়াতে এ জমকালো সিল্কের শাড়িই পরে যাবেন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
শুধু নিকিতা নন, এমন হাজারো নারীর চোখ আটকে যায় সিল্কের শাড়িতে। সিল্ক একদিকে যেমন আভিজাত্যের প্রতীক, তেমনি রুচিবোধের পরিচায়কও। শীতের দিনে একটু ভারী শাড়ি যেন অন্যরকম আবেশ দেয়। সহজে সামলানো যায় এ শাড়ি। জন্মদিন, অফিসের পার্টি কিংবা কোনো জমকালো ফ্যাশন শোর অনুষ্ঠানেও অনায়াসে পরা যায় সিল্কের যে কোনো পোশাক।
সিল্ক কেবল নির্দিষ্ট কোনো ঋতুর জন্য জুতসই এমনটা নয়, পরা যায় যে কোনো ঋতুতেই, আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে। এ কারণে ফ্যাশন হাউসগুলো সারাবছরই সিল্কের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, শ্রাগ, পাঞ্জাবি, শার্ট, স্কার্ট, কটি, জ্যাকেটসহ পাশ্চাত্য ঘরানার বিভিন্ন পোশাক নিয়ে আসে। সেসব পোশাকে থাকে দেশজ লোকজশিল্পের মোটিফ, জামদানি নকশা, বিমূর্ত নকশা, জ্যামিতিক প্যাটার্ন, এমব্রয়ডারির কাজ, বিভিন্ন ধরনের প্রিন্ট, প্যাচওয়ার্ক, হ্যান্ডপেইন্ট, ভেজিটেবল ডাই ইত্যাদি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিল্কের পোশাকে যেমন ফিউশন যুক্ত হচ্ছে, তেমনি নকশায়ও যোগ হচ্ছে নতুনত্ব।
পোশাকের ব্র্যান্ড বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী বিপ্লব সাহা জানান, বিশ্বরঙ উন্নত মানের মালবেরি তথা রাজশাহী সিল্ককে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে। রাজশাহীর বলাকা সিল্ক, অ্যান্ডি সিল্ক, মসলিন– এই তিন ধারায় কাজ করে এ ব্র্যান্ড। ঐতিহ্য ধরে রাখতে শাড়িতে রাজশাহীর বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মকে ফুটিয়ে তুলছে ‘বিশ্বরঙ’।
তিনি বলেন, ‘আমরা কখনও এক ধরনের সুতা, আবার কখনও দুই-তিন ধরেনর সুতার ব্লেন্ড করা কাজ করে থাকি। অ্যান্ডি সিল্কের সঙ্গে বলাকা সিল্ক, বলাকা সিল্কের সঙ্গে অ্যান্ডি যুক্ত থাকে। আবার কখনও ধুপিয়ান সিল্ক থাকে।’
অন্যদিকে অঞ্জন’সের স্বত্বাধিকারী শাহীন আহমেদ জানান, বাংলাদেশ ও ভারতে বেনারসি, কাঞ্জিভরম, ভাগলপুরি, মুর্শিদাবাদী, বালুচরি, তসর, বিষ্ণুপুরি, পৈঠানি ইত্যাদি সিল্ক পাওয়া যায়। অঞ্জন’স বলাকা ও অ্যান্ডি সিল্কের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও পাঞ্জাবি করে থাকে।
সিল্কের বুননে নানা ধরনের শেড, টেক্সার আনা হয় বলেও জানান ডিজাইনাররা। বিশ্বরঙের শাড়িতে বাটিক, এমব্রয়ডারি, ব্লক প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট, অ্যাপ্লিকের কাজ, রিবন ওয়ার্ক ইত্যাদি সব ধরনের নিরীক্ষাই করা হয়। পোশাকে কাঁথা স্টিচ, স্কিন প্রিন্ট, মেশিন এমব্রয়ডারি ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলে অঞ্জন’স।
পোশাকের ব্র্যান্ড কে ক্র্যাফটের স্বত্বাধিকারী খালিদ মাহমুদ খান জানান, আমাদের দেশে পোশাক হিসেবে সিল্কের শাড়ি এবং পাঞ্জাবি জনপ্রিয় ছিল। কালক্রমে এ দেশে সিল্কের সুতা উৎপাদন ও কাপড় বুনন কমে গেছে। এখন স্বল্প পরিসরে সিল্ক নিয়ে এ দেশে কাজ হচ্ছে। নানা প্রতিবন্ধকতা ও পরিচর্যার অভাবে সিল্কশিল্প দুর্বল হয়ে গেছে। অসংখ্য তাঁতি কাজ হারিয়েছেন, পেশা বদল করেছেন।
তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে অনেক কম সিল্ক ফেব্রিক্স ব্যবহার করছে। সিল্কের সঙ্গে নানা ধরনের সুতার মিশ্রণে উৎপাদিত ফেব্রিক এখন বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণত সিল্ক কাপড়ে অনুষ্ঠান উপযোগী উৎসবমুখী পোশাক তৈরি করা হয়। সিল্ক নিজেই একটি গর্জিয়াস লুক দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে কারুকাজের ব্যবহারে ডিজাইনকৃত পোশাক হয়ে ওঠে বিশেষ।
ব্যক্তিগত সংগ্রহ হিসেবে কাঁথা কাজের শাড়ি বা জারদৌসি কাজের কামিজ বা সাটিন স্টিচের সিল্ক পাঞ্জাবি সংগ্রহের রাখার আইটেম হয়ে উঠছে বলেও জানান খালিদ মাহমুদ খান।
লা রিভ তাদের যে কোনো উৎসবের পোশাকে ফেব্রিক হিসেবে সিল্ক ও ভিসকসের ব্লেন্ড করে থাকে। ব্র্যান্ডটির পোশাকে কারচুপি, এমব্রয়ডারি, স্ক্যালোপ, লেজার কাট, ফয়েল প্রিন্টের রুচিশীল ব্যবহার করা হয়। নার্গিসাস কালেকশনে আভিজাত্যে মোড়ানো সিল্কের বিভিন্ন পোশাককে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
বহু বছর ধরে সিল্কের বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ নিয়ে কাজ করছে ‘আড়ং’। সেখানে সিল্কের শাড়ি, টপ, কেপ, শ্রাগ, জ্যাকেট, স্কার্ফ ইত্যাদি পাওয়া যায়। আবার অরণ্যেও পাওয়া যায় ভেজিটেবল ডাইয়ের সিল্কের শাড়ি ও স্কার্ফ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নকশায় আসছে পরিবর্তন। এখন সিল্ক শাড়িতে হ্যান্ডপেইন্ট করেন অনেক নবীন উদ্যোক্তা। কয়েক বছর ধরে হ্যান্ডপেইন্টের সিল্ক শাড়ির কদর বেড়েছে। অনেকে ওয়াটার কালারবেজড কাজ করেন। দোয়েল সিল্কের শাড়িতে বিভিন্ন ফুল যেমন জবা, নীলকণ্ঠ, বাগানবিলাস, কাশফুল ইত্যাদি নকশা ফুটিয়ে তোলেন। হ্যান্ডপেইন্টের শাড়ির পাড় ও ফুলের মধ্যে এমব্রয়ডারি কাজ শাড়ির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে।
খাঁটি সিল্কের পাশাপাশি কেউ কেউ কৃত্রিম সিল্ক নিয়েও কাজ করছেন। এমনই একটি উদ্যোগ রয়েছে ‘হরীতকী’র। হরীতকী তাদের স্কার্টে মনের মতো নকশা ফুটিয়ে তুলতে কৃত্রিম সিল্ক ব্যবহার করে। হরীতকীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ডিজাইনার অনিক কুণ্ডু বলেন, ‘আমাদের মোটিফের মধ্যে আছে ফুল, আলপনা, মোগল চিত্রকলা, রিকশাচিত্র, যামিনী রায়ের চিত্রকর্ম, ভ্যান গগের চিত্রকর্ম, দেশীয় মোটিফ, গ্রামীণ দৃশ্য, কলমকারি, জ্যামিতিক ডিজাইন ও অন্যান্য।’
দরদাম
ব্র্যান্ড, কাজ, অন্য ফেব্রিকের সঙ্গে সংমিশ্রণ ইত্যাদি ভেদে সিল্কের শাড়ির দাম ভিন্ন হয়। বলাকা সিল্কের শাড়ির দাম এক রকম। দোয়েল সিল্কের শাড়ির দাম আরেক রকম। বলাকা সিল্কের সঙ্গে ধুপিয়ান যুক্ত হলে দাম ভিন্ন হয়। আবার শাড়িতে বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ, কারুকাজ, প্যাচওয়ার্ক থাকলে দাম বেড়ে যায়। সাধারণত ভালো মানের সিল্কের শাড়ির দাম ১০-১৫ হাজার টাকা হয়ে থাকে। ক্রেপ সিল্ক, বলাকা সিল্ক ও অ্যান্ডি সিল্কের ওপর ভেজিটেবল ডাই প্রিন্ট, কাঁথা স্টিচ কাজের শাড়ির দাম ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা। আড়ং থেকে সিল্কের শাড়ি ১০-২৫ হাজার টাকার মধ্যে কেনা যাবে। কে ক্র্যাফট, অঞ্জন’স থেকে সিল্কের শাড়ি কেনা যাবে ১০-২০ হাজার টাকার মধ্যে। সালোয়ার-কামিজ ৬-১৫ হাজারের মধ্যে কেনা যাবে। বিশ্বরঙ থেকে সিল্কের পোশাক কেনা যাবে ৪ হাজার থেকে ৫০-৬০ হাজার টাকার মধ্যে।
যত্ন
সিল্কের শাড়ি ফেলে রাখলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে পরলে বেশিদিন ভালো থাকবে শাড়ি। ব্যবহারের পর সিল্কের শাড়ি স্যাঁতসেঁতে জায়গায় রাখা যাবে না। ঘামে ভেজা শাড়ি না শুকিয়ে আলমারিতে রাখা যাবে না। শাড়িতে দাগ লাগলে পাউডার ছিটিয়ে দিন। পরে ধুয়ে ফেলুন।
ভারী কাজ করা শাড়িগুলো হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলে ভালো থাকবে। পোকামাকড় থেকে দূরে রাখতে সিল্কের পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে ন্যাপথালিন না রাখাই ভালো। এর পরিবর্তে দারচিনি কিংবা লবঙ্গ রাখলে গন্ধ শাড়িতে বসে যাবে না।
সিল্কের শাড়ি বছরে দু’বার আলমারি থেকে বের করে বাতাসে শুকিয়ে নিন। কড়া রোদে শাড়ি না শুকানোই ভালো। নয়তো রং জ্বলে যেতে পারে। সিল্কের শাড়ি পানিতে না ধুয়ে ড্রাই ওয়াশ করা ভালো। যদি পানিতে ধুতেই হয়, তাহলে শ্যাম্পু দিয়ে ৫ মিনিট ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন। ধোয়ার পর নিংড়ে পানি ঝরাবেন না। এতে শাড়ির স্থায়িত্ব নষ্ট হবে।
সিল্কের যে কোনো পোশাক ইস্তিরি করতে হবে মোটামুটি তাপে। হালকা ভেজা থাকতেই সিল্কের শাড়ি ইস্তিরি করতে হবে। এ জন্য শাড়ি উলটো করে ইস্তিরি করতে পারেন।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
একজন চা শ্রমিকের দিনে আয় ১৭৮ টাকা
হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলেয়ে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। এসব বাগানের বাসিন্দা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে, স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চা পাতা উত্তোলনে জড়িত।
চা বাগানে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়। এর বিনিময়ে মজুরি পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো বাগানে নিয়মিত এই মজুরিও দেওয়া হয় না।
শ্রমিকদের দাবি, দৈনিক মজুরি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করতে হবে। বর্তমানে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে চা শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে।
আরো পড়ুন:
বৈষম্য কেন? নারী শ্রমিকেরা পান না সমান মজুরি
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
সরেজমিনে কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকরা ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করেন। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দু-বেলা পেটভরে খেতে পারেন না।
শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘‘দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি ও সমস্যা নিয়ে চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠনের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিনিধির বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে বৈঠক হয়েছে। সে সময় ৮ টাকা ৫০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়ে মজুরি ১৭৮ টাকা ৫০ নির্ধারিত হয়েছে।’’
শ্রমিকদের কষ্টের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই টাকায় চলা যায় না। দেশের কোথাও এতো সস্তা শ্রমের দাম নেই। বর্তমানে একজন কৃষিশ্রমিক দিনে ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেন, একজন রিকশাচালকের প্রতিদিনের আয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে একজন চা শ্রমিক পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এজন্য তাকে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়।’’
চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নাটক ও গানের মাধ্যমে দাবি জানিয়ে আসা জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘দৈনিক ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা মজুরিতে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অচিরেই মজুরি ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া, শ্রমিকদের আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’’
ঢাকা/রাজীব