দুর্নীতির টাকা আড়ালে জেলার সোহেল স্ত্রীকে সাজান মাছচাষি
Published: 3rd, February 2025 GMT
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার (বরখাস্ত) সোহেল রানা বিশ্বাসের স্ত্রী হোসনে আরা পপি মাছ চাষ করে দুই কোটি টাকা আয় করেছেন। এ আয় থেকে সোহেল রানাকে ৮০ লাখ টাকা দান করেছেন। কিন্তু এগুলো সবই কাগজে-কলমে। ৯ বছর তিনি মাছ চাষ করলেও কোন পুকুরে চাষ করেছেন, কোথায় বিক্রি করেছেন– তার দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই। স্বামীর অবৈধ আয় আড়াল করতে নিজেকে মৎস্য চাষি সাজাতে গিয়ে করেছেন অভিনব জালিয়াতি। ২০১৭ সালে কেনা তিনটি ১০০ টাকার স্ট্যাম্পকে ২০১১ সালে কেনা স্ট্যাম্প দেখিয়ে ভুয়া লিজ চুক্তি করেন পপি। তবে এই দম্পতির শেষরক্ষা হচ্ছে না। দুদক ময়মনসিংহে ছয়টি ব্যাংকে পপির আটটি অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ১ লাখ টাকার হদিস পেয়েছে। কিন্তু এ সম্পদ অর্জনের কোনো বৈধ ও গ্রহণযোগ্য উৎস পাওয়া যায়নি।
সোহেল রানা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ছুটি নিয়ে ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর ট্রেনে বাড়ি যাওয়ার সময় ভৈরবে দুই বস্তায় ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকাসহ রেলওয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
চট্টগ্রামে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর সহকারী পরিচালক এনামুল হক বলেন, হোসেনে আরা পপি গৃহিণী। সোহেল রানা বিশ্বাস দুর্নীতির অর্থ আড়াল করতে পপিকে মৎস্য চাষি বানান। যে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জমি নিয়ে মৎস্য চাষের কথা বলা হয়, সেই স্ট্যাম্প ২০১১ সালে কেনা দেখানো হলেও তদন্তে দেখা যায়, তিনটি স্ট্যাম্পই ২০১৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন থেকে বিতরণ করা হয়েছে। স্ট্যাম্প জালিয়াতি করে পপি দুই কোটি টাকা মৎস্য খাত থেকে আয় দেখালেও এ অর্থ মূলত স্বামীর দুর্নীতির অর্থ। তদন্ত প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। গত ৩০ জানুয়ারি প্রতিবেদনটি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
তবে অভিযুক্ত পপি বলেন, ‘আমি মাছ চাষ করেই দুই কোটি টাকা আয় করেছি। স্ট্যাম্পগুলোও সঠিক। দুদক তদন্ত করে কী পেয়েছে, জানি না। আমার স্বামীও কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন।’ পপি ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। দুদক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, পপি ২০১১ সাল থেকে স্বামীর বাড়ির পরিবর্তে নেত্রকোনায় বাবার বাড়িতে মৎস্য ব্যবসা শুরু করেন বলে দাবি করেন। কিন্তু ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যবসার বিল ভাউচার, ট্রেড লাইসেন্স, নিজের নামে কোনো পুকুর, মৎস্য চাষি হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের কোনো প্রত্যয়নপত্র দুদককে দেখাতে পারেননি। শুধু তিনটি ১০০ টাকার স্ট্যাম্প উপস্থাপন করেন। আয়কর নথিতে তিনি ২০১১-১২ করবর্ষে মৎস্য চাষে ১৩ লাখ টাকা, ২০১১-১৩ বর্ষে ১৫ লাখ, ২০১৩-১৪ বর্ষে ২০ লাখ, ২০১৪-১৫ বর্ষে ৩০ লাখ, ২০১৫-১৬ বর্ষে ৩৫ লাখ, ২০১৬-১৭ বর্ষে ২০ লাখ, ২০১৭-১৮ বর্ষে ২২ লাখ, ২০১৮-১৯ বর্ষে ২৩ লাখ, ২০১৯-২০ বর্ষে ২৩ লাখ টাকাসহ ২ কোটি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করেছেন উল্লেখ করেন। কিন্তু এসবের বৈধ উৎস পায়নি দুদক।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০১১-১২ করবর্ষ থেকে ২০১৮-১৯ করবর্ষ পর্যন্ত নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার দলধলা মৌজার ৩০৪ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করেছেন উল্লেখ করা হয়। কথিত দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের জন্য মাছ চাষের লিজ চুক্তির তিনটি স্ট্যাম্প যাচাই করে দুদক। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ট্রেজারি শাখা থেকে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ তিনটি স্ট্যাম্প ২০১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে রাজু আহমেদ নামক ভেন্ডারের কাছে ছাড়করণ করা হয়। এছাড়া পপি ময়মনসিংহ জেলার ছয়টি ব্যাংকে আটটি অ্যাকাউন্টের মধ্য থেকে দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের আগে অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তিনটি ব্যাংক থেকে ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করে সরিয়ে ফেলেছেন। তাঁর নামে প্রিমিয়ার ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৫০ লাখ করে ১ কোটি টাকার দুটি এফডিআর আছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ছ চ ষ কর মৎস য চ ষ কর ছ ন তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
২৩৮ বছরে কী পেল আর কী পেল না ময়মনসিংহ জেলা
‘হাওর জঙ্গল মইষের শিং—এই তিনে ময়মনসিং’ প্রবাদ-প্রবচনে এভাবেই পরিচয় করানো হতো ময়মনসিংহ জেলাকে। ১৭৮৭ সালের ১ মে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন এই জেলা ২৩৮ বছর পূর্ণ করল আজ বৃহস্পতিবার। দীর্ঘ আন্দোলন–সংগ্রামের পর ২০১৫ সালে চারটি জেলা নিয়ে বিভাগ এবং ২০১৮ সালে ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে সিটি করপোরেশন পেয়েছে ময়মনসিংহ। তবে অপ্রাপ্তিও কম নয়।
ময়মনসিংহ জেলায় ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে সিটি করপোরেশন আছে। জেলাটি ১৩টি উপজেলা, ১৪টি থানা, ১০টি পৌরসভা, ১৪৭টি ইউনিয়ন, ২১০১টি মৌজা, ২৭০৯টি গ্রাম ও ১১টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত। জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৫৯ লাখ।
সরকারিভাবে ময়মনসিংহ জেলাকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে ‘শিল্প-সংস্কৃতির’ নগরী হিসেবে। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির এ শহরকে এখন আলাদাভাবে চেনার কোনো উপায় নেই। সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রগুলো দিন দিন সংকুচিত হয়েছে। সংস্কৃতিপল্লির দাবি উঠলেও সংস্কৃতির শহরে তা হয়নি। এ প্রসঙ্গে কবি ও নাট্যকার ফরিদ আহমদ দুলাল বলেন, ‘শিল্প-সংস্কৃতি’ নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় আর সংস্কৃতিচর্চার প্রয়োজন নেই বলেই হয়তো কোনো অগ্রগতি নেই।
ময়মনসিংহকে শিক্ষার শহর বলা হলেও আছে নানা সংকট। এখানে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। জেলায় কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়নি। স্থানীয়রা ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আনন্দ মোহন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
আনন্দ মোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. জাকির হোসেন বলেন, এখানে অনেক প্রতিষ্ঠান থাকলেও শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ নেই, কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চলছে। অনেক বিভাগীয় শহরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এখানে তা নেই। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন আছে।
আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিভাগ ও সিটি করপোরেশন পেয়েছি। কিন্তু আমরা দেশের অন্য বিভাগের তুলনায় অগ্রসর হতে পারিনি, বিভিন্ন খাতে পিছিয়ে আছি।নূরুল আমিন কালাম, সাধারণ সম্পাদক, ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলননাগরিক সংগঠন ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলন বেশ কিছু দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবির মধ্যে আছে এক হাজার শয্যার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে দুই হাজার শয্যায় উন্নীত করা ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, আলাদা সদর হাসপাতাল স্থাপন, ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটে ময়মনসিংহ থেকে দুই জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু, বিভাগীয় শহর হিসেবে ময়মনসিংহে একটি বিমানবন্দর স্থাপন, কৃষিপ্রধান অঞ্চল হওয়ায় কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, ব্রহ্মপুত্র নদে প্রাণ ফেরানো।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন কালাম বলেন, ‘২৩৮ বছরের পুরোনো এ জেলায় আমাদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিভাগ ও সিটি করপোরেশন পেয়েছি। কিন্তু আমরা দেশের অন্য বিভাগের তুলনায় অগ্রসর হতে পারিনি, বিভিন্ন খাতে পিছিয়ে আছি। এর মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করলেও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তাঁরা চিন্তা করেননি।’
বিভাগীয় শহর কত দূর২০১৫ সালে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলা নিয়ে ময়মনসিংহকে দেশের অষ্টম বিভাগ ঘোষণা করা হয়। এরপর বিভাগীয় শহর স্থাপনের জন্য ময়মনসিংহ শহর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে ‘ময়মনসিংহ বিভাগীয় সদর দপ্তর ও নতুন বিভাগীয় শহর প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের’ প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হয়। শুরুতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার একর জমিতে বিভাগীয় শহর স্থাপনের প্রস্তাব তৈরি হলেও স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখে সেটি অনুমোদন হয়নি। পরে চরাঞ্চলের গোবিন্দপুর, চর ঈশ্বরদিয়া, পাড়ালক্ষ্মীর আলগী ও চর সেহরা মৌজায় ২০২২ সালে প্রায় ৯৪৫ একর জমিতে বিভাগীয় শহর স্থাপনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। নতুন শহরে বিভাগীয় প্রশাসনের অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তর, আবাসিক এলাকা, সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, বাঁধ, জাদুঘর, নভোথিয়েটার, কৃত্রিম জলাশয়, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ও মানসম্মত হোটেল থাকবে। প্রকল্প অনুমোদনের পর জমি অধিগ্রহণ, উচ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এক বছর সময় বাড়ানো হয়েছে।
বিভাগীয় শহর বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে, তা বলা যাচ্ছে না। শুরুতে জটিলতা সৃষ্টি না হলেও এত দিন অনেক দূর এগিয়ে যেত বিভাগীয় শহর।তাহমিনা আক্তার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব), ময়মনসিংহবিভাগীয় শহর স্থাপন প্রকল্পের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ময়মনসিংহের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) তাহমিনা আক্তার বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে হবে। এ কাজ শেষ হলে পরে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প শুরু হবে। তবে বিভাগীয় শহর বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে, তা বলা যাচ্ছে না। শুরুতে জটিলতা সৃষ্টি না হলেও এত দিন অনেক দূর এগিয়ে যেত বিভাগীয় শহর।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বপ্ন শেষময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের চর রামমোহন মৌজায় প্রায় ২০০ একর জমিতে ২০১৮ সালে ২ নভেম্বর ময়মনসিংহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। তবে চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুমোদন পাওয়া ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রমও বাতিল করা হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনে নতুন আশাপ্রাচীন এই জেলায় নেই মানসম্মত কোনো স্টেডিয়াম। দেশের ক্রীড়ার মান উন্নয়ন, উচ্চতর ও আধুনিক প্রশিক্ষণের জন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে একটি মাল্টিস্পোর্টস অলিম্পিক কমপ্লেক্স তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলার ত্রিশালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭৩ একর জমিতে হবে এটি। এতে ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন ক্রীড়াবিদেরা। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ ফিরোজা খাতুন বলেন, এ জেলায় মানসম্মত স্টেডিয়াম না থাকায় এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ কম পাওয়ায় দক্ষ ক্রীড়াবিদ তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু এখন নতুন আশা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়