Samakal:
2025-11-04@03:32:59 GMT

নারীবিরোধী তৎপরতা কীসের আলামত

Published: 6th, February 2025 GMT

নারীবিরোধী তৎপরতা কীসের আলামত

অন্তর্বর্তী সরকারের মধুমাস প্রায় শেষ। ছয় মাস বয়সী এই সরকারের কাছে বেশি বেশি জবাবদিহি চাওয়ার সময় হলো।গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত একটি সরকারের কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক। সে কারণে আমরা দেখছি, যে কোনো বিষয় নিয়েই দিনরাত রাস্তায় আন্দোলন করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী।

কিন্তু একদিকে কয়েকটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়ে পড়লেই কখনও কখনও দাবি মানা হচ্ছে, অন্যদিকে যৌক্তিক দাবিতে সংগঠিত কোনো আন্দোলন সরকারের কাছ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে। যেমন পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনা কমিটি বাতিল করা হলো একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হুমকি শুনে। কয়েকটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রাফিতি তুলে নেওয়া হলো পাঠ্যপুস্তক থেকে। কিন্তু অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের স্মারক সেই গ্রাফিতি পুনর্বহালে আদিবাসী এবং সমমনা শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনকে পুলিশ দিয়ে দমন করা হলো। এসবের মাধ্যমে স্পষ্টত একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকেই আশকারা দিচ্ছে সরকার। 

এখন এই আশকারা সমাজে গেড়ে বসা পুরুষতন্ত্রকে আরও চাঙ্গা করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন পেশার নারীকে হেনস্তা, তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি এবং পেশায় বাধা দেওয়া এবং তা করা হচ্ছে বিভিন্ন তকমা দিয়ে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বিনোদন জগতের তারকারা। এর সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন নারী ফুটবলাররা। গত ২৮ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিলের ঘটনা তারই প্রমাণ।

‘তৌহিদি জনতা’, ‘ধর্মপ্রাণ মুসল্লি’ ও ‘এক দল যুবক’ নামে ব্যানার টানিয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা গত সরকারের সময়ও দেখা গেছে। তবে গত আগস্ট মাস থেকে তা যেন এক প্রকার বল্গাহীন। গত বছরের ২৯ আগস্ট বিভিন্ন এলাকায় যৌনকর্মীদের ‘এক দল যুবক’ শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। এমনকি শ্যামলীতে যৌনকর্মীদের লাঠি নিয়ে একজন পুরুষ ধাওয়া করছে, সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মিডিয়াতে জায়গা পাওয়া সেই ‘এক দল যুবক’-এর কর্তৃত্ববাদিতার উৎস নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি না হওয়াতেই পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটেছে। 

আমরা দেখেছি, সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে নারীকে কান ধরিয়ে ওঠবস করাচ্ছে সেই ‘এক দল যুবক’। সেই নারী কানে হাত দিয়ে ওঠবস করতে না চাইলে উপস্থিত যুবকরা লাঠি দিয়ে তাঁকে আঘাত করে। এটি করেও মেটেনি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষোভ; সেই নারী নির্যাতনের পুরো ঘটনা ভিডিও করে তা ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়। সেই ‘এক দল যুবক’ পুলিশের সামনেই তা করছিল।

ওইসব ঘটনার ধারাবাহিকতায়ই আমরা ২ নভেম্বর চট্টগ্রামে একটি লাইফস্টাইল পণ্যের শোরুম উদ্বোধন করতে অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীকে বাধা পেতে দেখেছি। গত জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে রুখে দেওয়া হয় আরও দু’জন অভিনেত্রীকে। গত ২৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে একটি শোরুম উদ্বোধন করতে যেতে পারেননি অভিনেত্রী পরীমণি। ২৮ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জে একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করতে পারেননি চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস। 

পেশা নির্বাচনের অধিকার সবারই আছে। এই ‘তৌহিদি জনতা’, ‘ধর্মপ্রাণ মুসল্লি’ ও ‘এক দল যুবক’ নামের ব্যানারগুলো কেন নারীর বিপক্ষে সক্রিয় হচ্ছে? এগুলো আসলে কাদের ব্যানার? ৩০ জানুয়ারি বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর কেউ দিতে পারেননি। অর্থাৎ সাধারণভাবে তাদের কোনো দলীয় পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। তবে স্থানীয় সাংবাদিক ও প্রশাসনের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট, এই তৌহিদি জনতা বিভিন্ন ইসলামভিত্তিক দলের সদস্য, কর্মী বা সমর্থক।’

বস্তুত এগুলোর কোনোটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সবই একটি গোষ্ঠীর নারীর ‘আদর্শ’ চরিত্র চিত্রণ চেষ্টারই ফল। এ কারণেই একদিকে নারীকে ‘বেশ্যা’ বা ‘খারাপ নারী’ হিসেবে তকমা দেওয়ার অতি পুরোনো কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী পুরুষালি রাজনীতি, অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিজাব র‍্যালি’র মধ্য দিয়ে ‘আদর্শ নারী’র ইমেজ উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে। 

প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তী সরকার এসব ব্যানারের বিষয়ে নতজানু কেন? এরা কি তবে সরকারেরই অংশ? এ প্রশ্ন তোলার কারণ ‘তৌহিদি জনতা’, ‘ধর্মপ্রাণ মুসল্লি’, ‘এক দল যুবক’ কিংবা ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে ব্যানারভিত্তিক সংগঠনগুলো নিয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার নয়। যদি এসব ব্যানার সম্পর্কে সরকার কিছুই না জানে, তাহলে তাদের দাবি পূরণে এত আগ্রহ কেন? তারা কেন সরকার থেকে আশকারা পাচ্ছে? তবে কি মুখে বারবার গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের কথা বললেও ছয় মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকার একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি? গণঅভ্যুত্থানের চেতনা হিসেবে বহুল উচ্চারিত সামাজিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, সমতা, দরদ; সবই ফাঁপা বুলি? 

আমরা দেখছি কোনো আন্দোলন তৈরি হলে সেটি থামাতে ছাত্রদের যেতে হয়। অন্যদিকে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রদের দল গঠনের কথা বলছেন। ‘তৌহিদি জনতা’, ‘ধর্মপ্রাণ মুসল্লি’ ও ‘এক দল যুবক’-এর মতো ব্যানার হঠাৎ আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে এসবের সম্পর্ক আছে। এসব সম্পর্ক রাজনৈতিক।

জয়পুরহাটে মেয়েদের খেলা যারা বন্ধ করেছেন, তাদের কারও কারও বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। বাধাদানকারীদের কেউ কেউ নিজেদের ‘অনুতপ্ত’ হওয়ার কথা জানিয়ে মেয়েদের খেলাধুলা করতে বাধা নেই বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। আপাতত এই ‘অনুতপ্ত’ হওয়া নিছক রাজনৈতিক বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। যদি সামনের দিনে ‘তৌহিদি জনতা’, ‘ধর্মপ্রাণ মুসল্লি’ ও ‘এক দল যুবক’ নামে কোনো ব্যানার এসে নারীর গতিরোধ বা নারীর ওপর কোনো ধরনের ‘নৈতিক নজরদারি’র ঘটনা না ঘটায় তাহলেই প্রমাণিত হবে– এই গোষ্ঠী আসলেই ‘অনুতপ্ত’। 

এগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকারও তার ‘আদর্শিক’ অবস্থান পরিষ্কার করবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, ওপরে বর্ণিত ঘটনাগুলো ব্যক্তির সংবাদস্বীকৃত নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার স্পষ্টতই বিপক্ষে। এসব অব্যাহত থাকলে সংস্কারের নামে প্রস্তাবিত বহুত্ববাদ, দায়-দরদ, ন্যায্যতা, ন্যায়বিচার প্রাপ্যতা, মানমর্যাদা অতীতের মতোই ‘শুক পাখি’ হয়ে উড়বে। 

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
zobaidanasreen@gmail.

com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র

এছাড়াও পড়ুন:

উচ্চ প্রবৃদ্ধি, বৈষম্যবাদী বিকাশ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সমাজ অর্থনীতির পুঁজিবাদী রূপান্তর ঘটেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। প্রথাগত বিচারে ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি’র অনেকগুলো দিকই চিহ্নিত করা যায়। যেমন অর্থনীতির আকার বেড়েছে অনেক, কংক্রিট অবকাঠামোর বিস্তার ঘটেছে, জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ, আমদানি-রপ্তানির উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে, সড়কপথের বিস্তার ঘটেছে অনেক, পরিবহন ও যোগাযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে, বহুতল ভবন বেড়েছে দ্রুত, রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে পোশাকশিল্প বড় সাফল্য তৈরি করেছে, প্রবাসী আয় বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল মজুত তৈরি করেছে, প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক তৎপরতায় ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিও মডেল অনেক বিস্তৃত হয়েছে, নগরায়ণ বেড়েছে, দেশের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও সচলতা বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির গুণগত পরিবর্তন বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অনেক নতুন উপাদান যোগ করেছে। অনেক পেশা নাই হয়ে যাচ্ছে আবার অনেক পেশা নতুন যোগ হয়েছে।

অনলাইন যোগাযোগের উল্লম্ফনে গ্রাম-শহরের বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনযাপন ও অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক তৎপরতায় এর প্রভাব পড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। অসংখ্য মানুষের দৈনন্দিন জীবন এখন মুঠোফোন, ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ইউটিউব, ওটিটি, বিকাশ, নগদনির্ভর হয়ে গেছে। অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইন সেমিনার-আলোচনা-পড়াশোনা, অনলাইন কেনাবেচা ব্যবসা-বাণিজ্য, অনলাইন সাংগঠনিক তৎপরতা, অনলাইন ধর্মীয় প্রচার দিনে দিনে বেড়েছে বহুগুণ। অনলাইন-অফলাইন বেচাকেনায় কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট, টিভি ইত্যাদির ব্যবসার প্রসার ঘটেছে, যার অনেকগুলোই আমদানি করা পণ্যের ওপরই নির্ভরশীল। বেসরকারি ক্লিনিক, ল্যাবরেটরি ও হাসপাতাল, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, কনসালট্যান্সি ফার্ম ইত্যাদির বিস্তার ঘটেছে অনেক। এ সময়ে সিনেমা হল কমেছে, সিনেপ্লেক্স হয়েছে কিছু; পাঠাগার, থিয়েটার হল, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সেভাবে বাড়েনি, কিন্তু বহুগুণ বেড়েছে দেশি-বিদেশি খাবারের দোকান, শপিং মল; পাবলিক বাস বেড়েছে কিছু, কিন্তু তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে প্রাইভেট গাড়ি। সমাজে ধর্মচর্চা বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি।

তবে জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি বা কথিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যেভাবে ঘটছে, তার সামাজিক ও পরিবেশগত মূল্য অনেক বেশি। যেমন যে দশকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হারে ঘটেছে, সেই সময়ে বন বিনাশের হার দেখা গেছে সবচেয়ে উঁচু। নদী-নালা, খাল-বিল ও বনদূষণ, দখল ও বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এ সময়েই দেশে একটি অতি ধনিকগোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে। তাদের বিত্তবৈভব যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন মাথা গণনায় দারিদ্র্যের প্রচলিত সংজ্ঞা বা কোনোভাবে টিকে থাকার আয়সীমার নিচে মানুষের সংখ্যা চার কোটির বেশি। যদি দারিদ্র্যসীমায় শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন যুক্ত করা হয় তাহলে দেখা যাবে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই অমানবিক জীবনে আটকে আছেন। গত এক বছরেও দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে। 

গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণের বেশি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের যথেষ্ট পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যের সংস্থান হয়নি। দেশে কৃষকদের জীবনও বহু দিক থেকে বিপন্ন। ফসলের দাম, অনিশ্চয়তা, বিষের মধ্যে বসবাস, দখল-দূষণ সবই তাদের অস্থির করে রাখে। টিকে থাকার জন্য তাদের খুঁজতে হয় নতুন নতুন অবলম্বন। শিক্ষা ও চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। দোকানদারি অর্থনীতির উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটছে, যেখানে বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানচর্চা বাহুল্য জ্ঞান করা হয়। আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বাজার, ভোগবাদিতা ও নিয়তিবাদিতার প্রভাব বেড়েছে।

বৈষম্যের বিরোধিতা করে যে গণ–অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেই বৈষম্য দূর করার পথে আমরা কতটুকু এগোলাম?

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • উচ্চ প্রবৃদ্ধি, বৈষম্যবাদী বিকাশ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা