মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ ঘটাতে চাইতেন আনিসুর রহমান, স্মরণসভায় বক্তারা
Published: 6th, February 2025 GMT
মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ ঘটাতে চাইতেন অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমান। সে জন্য তিনি ছাত্রদের নিয়ে সরাসরি গ্রামে চলে যেতেন এবং কৃষকদের কাছ থেকে শিখতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি পার্টিসিপিটরি অ্যাকশন রিসার্চ বা গণ গবেষণার তত্ত্ব নিয়ে আসেন। এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ক্ষমতায়ন।
উন্নয়ন নিয়ে অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমানের চিন্তা ছিল অর্থনীতির প্রথাগত চিন্তার বাইরে। উন্নয়ন বলতে তিনি নিছক অবকাঠামো নির্মাণ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি বুঝতেন না। কীভাবে প্রতিবন্ধকতার অর্গল খুলে মানুষের মুক্তির দ্বার উন্মোচন করা যায়, সেই চেষ্টা করতেন তিনি এবং বিশ্বাস করতেন, মানুষকে সুযোগ দেওয়া হলে তাঁরা নিজেরাই পথ তৈরি করে নেবেন।
বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে বাঙলার পাঠশালা, রিব ও এএলআরডি আয়োজিত আনিসুর রহমান স্মরণসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্যের অলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস আর ওসমানী। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালার সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ।
অনুষ্ঠানে সদ্য প্রয়াত অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমানের একাডেমিক বা বিদ্যায়তনিক উৎকর্ষ নিয়ে আলোকপাত করেন যুক্তরাজ্যের অলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস আর ওসমানী। তিনি বলেন, আনিসুর রহমান তত্ত্বীয় অর্থনীতিবিদ হিসেবে অনন্য উচ্চতায় উঠেছিলেন। আনিসুর রহমানের পিএইচডি থিসিস এমন গাণিতিক ভিত্তির ওপর করা হয়েছিল যে গণিত ওই সময় কেবল অর্থনীতিতে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। সে কারণে অমর্ত্য সেন বলেছেন, আনিসুর রহমান যদি তত্ত্বীয় গবেষণার কাজ অব্যাহত রাখতেন, তাহলে তাঁর অর্থাৎ অমর্ত্য সেনের আগেই তিনি নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন।
এস আর ওসমানী আরও বলেন, আনিসুর রহমানের পর বাংলাদেশে এখনো তাঁর মতো তত্ত্বীয় অর্থনীতিবিদ দ্বিতীয় কেউ আসেননি। একই সঙ্গে জীবনের দ্বিতীয় ভাগে তিনি পঠিত বিদ্যা প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন। এমনকি প্রথাগত অর্থনীতিচর্চা থেকেও তিনি কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবনের এই দুটি অংশের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে সমাজচেতনা। তিনি যে গবেষণা করেছেন, তা বিশুদ্ধ একাডেমিক উদ্দেশ্য থেকে করেননি; বরং সমাজচেতনা থেকে মানুষের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হওয়ার লক্ষ্যেই গবেষণা করেছেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আনিসুর রহমানকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ও মাহবুব উল্লাহ। রেহমান সোবহান বলেন, আনিসুর রহমান যা করতেন, তা তীব্র আবেগ থেকে করতেন। তিনি পাঠদানের কাজে যুক্ত হতে চাইতেন। বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। স্বাধীনতার পর জাসদের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে তিনি সেখানে যোগ দেন।
রেহমান সোবহানের আক্ষেপ, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের জন্য আনিসুর রহমান অনেক কিছু করেছেন, সেই বিভাগ তাঁর জন্য স্মরণ বা শোকসভা করল না।
অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ বলেন, আনিসুর রহমান প্রথাগত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না; বরং তিনি মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন নিয়ে আসার কথা বলতেন, যাকে বলা হচ্ছে, আত্মশক্তির উন্মোচন। তিনি আনিসুর রহমানের গণগবেষণা সম্পর্কে বলেন, এই বিষয়ে তিনি সম্ভবত মাও সে–তুংয়ের লার্ন ফ্রম পিপল বা জনগণের কাছ থেকে শেখার ধারণা পেয়েছেন।
আনিসুর রহমানকে মৌলিক চিন্তক হিসেবে আখ্যা দিয়ে মাহবুব উল্লাহ আরও বলেন, এই ধরনের মানুষেরা যুগে যুগে সমাজের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের শিকার হন। তিনি বলেন, আনিসুর রহমানও সে রকম পরিস্থিতির শিকার হন।
আনিসুর রহমানকে মুক্তচিন্তার মানুষ আখ্যা দিয়ে মাহবুব উল্লাহ বলেন, চিন্তার দাসত্ব না ভাঙলে গণতন্ত্র বা মানবাধিকার কোনো কিছুই প্রতিষ্ঠিত হয় না।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা দেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ। তিনি জানান, তিনি অর্থনীতিবিদ নন; কিন্তু আনিসুর রহমানের বই পড়ে কিছু বিষয় শিখেছেন। সেটা হলো, কারও কাছে হাত না পেতে নিজের সম্পদ দিয়ে উন্নয়ন করা। সে জন্য আনিসুর রহমান স্বাধীনতার পর কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে সচিবদের গাড়ি ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। যদিও তিনি তা গ্রহণ করেননি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান, অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম, অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিসার্চ অ্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের (রিব) চেয়ারম্যান শামসুল বারি।
বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার পর আনিসুর রহমান ভেবেছিলেন, দেশে তখন অনেক কিছু করার অবকাশ আছে। সে জন্য তিনি তরুণদের নিয়ে দেশ গড়ার কাজে নেমে গিয়েছিলেন। তিনি সব সময় নিজে পরামর্শ দিতেন না, তরুণদেরও ভাবতে উৎসাহিত করতেন। এ ছাড়া শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ছাত্রবান্ধব, এমনকি ছাত্রাবাসেও চলে যেতেন তিনি। এমন শিক্ষক আজকের দিনে বিরল।
আনিসুর রহমান ভূমি সংস্কার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন বলে উল্লেখ করেন বক্তারা। ভূমি অধিকার ও সংস্কার নিয়ে তাঁর গবেষণা ও চিন্তা বাস্তবায়নে কাজ করছে এএলআরডি। মানুষের সামাজিক ও আর্থিক সমস্যা সমাধানে অধ্যাপক আনিসুর রহমানের গণগবেষণা-তত্ত্ব ও তাঁর অন্যান্য চিন্তা সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করেছে রিব।
নতুন প্রজন্মের তরুণদের আনিসুর রহমানের চিন্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও তাদের সক্ষমতা বিকাশের জন্য বাঙলার পাঠশালা আনিসুর রহমানের জীবন ও কর্ম নিয়ে ২০১৯ সালে পাঁচ মাসব্যাপী পাঠচক্রের আয়োজন করেছিল।
অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আনিসুর রহমানের অনুরাগীরা উপস্থিত ছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ন এক ড ম করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
গলাচিপায় ভিপি নুরকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগ
পটুয়াখালীর গলাচিপায় বিএনপির নেতাকর্মীরা গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে (ভিপি নুর) অবরুদ্ধ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বৃহস্পতিবার (১২ জুন) রাত ১০টার দিকে গলাচিপা উপজেলার পাতাবুনিয়া বটতলা বাজারে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। রাত ১টার দিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ওই বাজারে গিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা গণঅধিকার পরিষদ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
অন্যদিকে, চর বিশ্বাস বাজারে সরকারি চান্দিনা ভিটির ডিসিআর (ডুপ্লিকেট কার্বন রিসিপ্ট বা ভূমি কর ব্যতিত অন্যান্য সরকারি পাওনা আদায়ের রশিদ) পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সম্পাদকের অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে ভিপি নুরের ভাই আমীনুল ইসলামসহ দুই পক্ষের ১০ জন আহত হন। পরে চর বিশ্বাস বাজারে ইউনিয়ন বিএনপির অফিস ভাঙচুর করেন গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা।
নুরুল হক নুরের ছোট ভাই আমীনুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, বাজারে দুই শতাধিক দোকান আছে। ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি বাকের বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান প্রতিটি দোকান থেকে ৩০ হাজার টাকা করে দাবি করেন ডিসিআর পাইয়ে দেওয়ার নামে, যা সরকারের নির্ধারিত ফি’র চেয়ে অনেক বেশি। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীরা নুরুল হক নুরের সহযোগিতা চান। গত ১০ জুন নুর এলাকায় গেলে বিষয়টি নিয়ে দোকানিরা অভিযোগ করেন। তিনি তাদের অতিরিক্ত টাকা না দিতে বলেন এবং প্রশাসনের মাধ্যমে ডিসিআর পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর থেকেই স্থানীয় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
অভিযোগ অস্বীকার করে চর বিশ্বাস ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেছেন, “আমরা কর্মীসভা করছিলাম। সে সময় ভিপি নুরের ভাই আমীনুল ও তার লোকজন এসে আলোচনা বন্ধ করতে বলেন। আমরা আলোচনা বন্ধ করলেও অকারণে তারা আমাদের ওপর চড়াও হন এবং চেয়ার ছুড়ে মারেন। এতে আমাদের ৮–১০ জন নেতাকর্মী আহত হন। আমরা কারো কাছ থেকে টাকা নিইনি। ভিপি নুরের শ্যালক এনিম আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে মিলে টাকা তুলেছেন। এখন এর দায় আমাদের ওপর চাপানো হচ্ছে।”
নুরুল হক নুর বলেছেন, “আমি নেতাকর্মীদের নিয়ে পাতাবুনিয়া বাজারের বাদল মেম্বারের স্মরণসভায় গিয়েছিলাম। রাত পৌনে ১০টার দিকে সেই স্মরণসভা শেষে গলাচিপা বাজারে ফেরার পথে শুনতে পাই, বিএনপির নেতাকর্মীরা গাছের গুড়ি এবং দেশীয় অস্ত্র হাতে নিয়ে সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন। পরে আমাদের কয়েকজন কর্মী সেখানে বিষয়টি দেখার জন্য গেলে বিএনপি নেতা হাসান মামুনের অনুসারীরা একটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন এবং কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন। এছাড়া, দশমিনার কয়েকটি অফিস তারা ভাঙচুর করেন। হাসান মামুনের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। আমরা যখনই গণসংযোগ করি, তখনই বিএনপির নেতাকর্মীরা আমাদের নেতাকর্মীদের হুমকি দেন। আমাদের সঙ্গে ৫০০ থেকে ৭০০ নেতাকর্মী ছিলেন। আমরা এ ঘটনা মোকাবিলা করতে পারতাম। কিন্তু, এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্ট হোক, সেটা আমরা চাইনি।”
সার্বিক বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বিএনপি নেতা হাসান মামুন। সেখানে তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগ নেতারা গণঅধিকারের ঘাড়ে পা দিয়ে বিএনপি অফিস ভাঙচুর করেছেন। হামলাকারী ও হামলার নির্দেশদাতাদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
পরে কয়েকটি পোস্টে তিনি ভিপি নুরকে উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশকে ধন্যবাদ জানান। এছাড়া, তিনি বিএনপি নেতাদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান।
গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেছেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
ঢাকা/ইমরান/রফিক