সাজেকে হোটেলের কক্ষ না পেয়ে বারান্দা-ক্লাবঘরে রাত কাটালেন ৪০০ পর্যটক
Published: 8th, February 2025 GMT
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই ভ্যালিতে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। গতকাল শুক্রবার সাজেক ভ্রমণে গিয়ে হোটেলের কক্ষ না পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে দুই শতাধিক পর্যটককে। অন্তত ৪০০ পর্যটককে রাত কাটাতে হয়েছে সাজেকের বিভিন্ন হোটেলের বারান্দা, স্থানীয় ক্লাবঘর ও বাড়িঘরে। সাজেকের মতো গতকাল পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় ছিল রাঙামাটি শহর, কাপ্তাইসহ জেলার অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রেও।
সাজেক রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা ও বেলা সাড়ে তিনটা—এই দুই দফায় চার শতাধিক জিপ ও পিকআপ ভ্যান নিয়ে পর্যটকেরা সাজেক ভ্রমণে যান। এর বাইরে পাঁচ শতাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলে পর্যটকেরা সাজেক ভ্রমণে গিয়েছেন। এসব যানবাহনে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ছয় হাজারের মতো। সাজেক পর্যটনকেন্দ্রে ১১৫টি হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে পর্যটকের ধারণক্ষমতা চার থেকে সাড়ে চার হাজার। ফলে হোটেলের কক্ষ না পেয়ে অনেক পর্যটককে ফিরতে হয়েছে। কিছু পর্যটক স্থানীয় হোটেল-রিসোর্টের বারান্দা, ক্লাবঘর, বাসিন্দাদের বাড়িঘরসহ যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন, সেখানেই রাত কাটিয়েছেন।
সাজেকে রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির হয়ে পর্যটকদের হিসাব রাখেন মতিজয় ত্রিপুরা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যটকদের প্রায় ৯০ শতাংশই আগেই হোটেলের কক্ষ বুকিং দিয়েছিলেন। অন্যরা সাজেকে আসার পর কক্ষ ভাড়া নিতে শুরু করেন। তবে গতকাল সন্ধ্যায় কক্ষ না পেয়ে পর্যটকদের হইচই শুরু হয়। একপর্যায়ে আমরা তাঁদের বলি নাম জমা দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৫০ জনের নাম জমা পড়ে। এরপর আমরা আর নাম তালিকাভুক্ত করিনি। ওই ১৫০ জনকে বিভিন্ন ক্লাব ও স্থানীয়দের বাড়িঘরে তুলে দিয়েছি।’ মতিজয় আরও বলেন, রুইলুই পাড়া ও কংলাক পাড়ার অনেক বাসিন্দা নিজ উদ্যোগে পর্যটকদের নিজেদের বাড়িঘরে নিয়ে গেছেন। সব মিলিয়ে চার শতাধিক পর্যটক হোটেলের কক্ষ না পেয়ে গতকাল বাইরে রাত কাটিয়েছেন।
সাজেকের রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রের রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুর্পণ দেব বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল রেকর্ডসংখ্যক পর্যটক সাজেক ভ্রমণে এসেছেন। আমরা কয়েক শ পর্যটককে কক্ষ ভাড়া দিতে পারিনি। অনেক পর্যটক বারান্দায়, মানুষের বাড়িঘরে, যে যেভাবে পারেন রাত কাটিয়েছেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে দুই শতাধিক পর্যটককে।’
পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল রাঙামাটি শহর, পলওয়েল পার্ক, কাপ্তাই হ্রদ, ঝুলন্ত সেতু, আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রেও পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। পর্যটকদের পদচারণে মুখর ছিল রাঙামাটি শহর। পর্যটকবাহী যানবাহন বাড়ার কারণে রাঙামাটি শহরের বনরূপা-রিজার্ভ বাজার, রিজার্ভ বাজার-তবলছড়ি ও আসামবস্তি-রাঙাপানি সড়কে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত যানজট দেখা দেয়। শহর ও এর আশপাশের সব হোটেল-রিসোর্টের কক্ষ খালি ছিল না।
রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যান্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনের তুলনায় গতকাল পর্যটকের আনাগোনা অনেক বেশি ছিল। আমাদের কমপ্লেক্স ও কটেজগুলোতে কোনো কক্ষ খালি নেই। গতকাল ছয় হাজারের বেশি মানুষ ঝুলন্ত সেতু দেখতে গিয়েছেন। অন্যান্য ছুটির দিনে দেড় থেকে দুই হাজার পর্যটক যেতেন।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স জ ক ভ রমণ র ব ড় ঘর শত ধ ক গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
সেন্ট মার্টিন ভালো নেই, সেন্ট মার্টিনের মানুষ ভালো নেই
অমাবস্যা ও সমুদ্রের নিম্নচাপ একই সময় হওয়ার কারণে উপকূলজুড়ে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। সেখানকার জনজীবনে দুর্ভোগ ও ক্ষতির পরিমাপ এতটা বেশি যে অনুমান করাও কঠিন।
প্রতিবছর বর্ষায় মোটামুটি দু-তিনটি ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু এত ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস কখনো হয়নি। এত তাণ্ডব কখনো দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
২৬ ও ২৭ জুলাই সমুদ্রের নিষ্ঠুর লীলাখেলা দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দ্বীপের প্রায় চারপাশ থেকে হু হু করে ঢুকেছে সমুদ্রের পানি। অনেক দিন এমন পানির তোড় দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
দ্বীপে যা সামান্য কৃষিকাজ হয়, বিশেষ করে ধান চাষ ও সবজি চাষে এবার জলোচ্ছ্বাসের থাবা পড়েছে। লোনাপানি ঢুকে চাষাবাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
সমুদ্রের পাড়ের বাড়ি ও দ্বীপের মাঝখানের নিম্নাঞ্চলে (স্থানীয় ভাষায় মরং বলে) সাগরের পানি ঢোকার কারণে অনেক এলাকায় পানি লবণাক্ত হয়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
অনেক বাড়ি ও রিসোর্ট সমুদ্রের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেছে।
দ্বীপে কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় এবার জলোচ্ছ্বাস পূর্ণমাত্রায় আঘাত করতে পেরেছে! ফলে পুরোপুরি অনিরাপদ দ্বীপটিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।
দ্বীপের ভাঙন শুরু মূলত ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে। ওই দুই ঘূর্ণিঝড় দ্বীপের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ আশপাশের পাথরের স্তূপ নড়বড়ে করে দেয়। ফলে দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রের স্রোত সমুদ্রগর্ভের পরিবর্তে সৈকত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়।
এতে দ্বীপের উত্তর ও উত্তর–পূর্ব পাশে ব্যাপক ভাঙন হয়। উত্তর পাড়া ও ডেইল পাড়া নামের দুটি পাড়া বিলীন হয়ে যায়। বাসিন্দাদের ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গুচ্ছগ্রাম করে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?সেই ১৯৯১ সাল থেকে আজ অবধি দ্বীপের ভাঙন চলমান। কিন্তু কোনো বেড়িবাঁধ নেই। আবার নতুন করে অপরিকল্পিত রিসোর্ট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণেও সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়া ঝোপ উজাড় হয়েছে। এতে দ্বীপের ঢেউ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মুরব্বিদের কথায় এবারের মতো জলোচ্ছ্বাস তাঁদের জীবনে দেখেনি। তাঁরা দ্বীপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। আদৌ দ্বীপে অদূর ভবিষ্যতে বসবাস করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে তাঁদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা মনে করেন, এ রকম আর দু–তিনটি জলোচ্ছ্বাস সহ্য করার মতো শক্তি সেন্ট মাটিনের নেই। দ্রুত স্রোতপ্রতিরোধী বাঁধ নির্মাণ করতে না পারলে সেন্ট মার্টিন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে!
দ্বীপবাসী মনে করে, একটা টেকসই বেড়িবাঁধ যেটা সচরাচর উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধের মতো না। কারণ, এখানে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান। ফলে কাছিমের ডিম দিতে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সেভাবে সৈকত থেকে সমুদ্রের দিকে লম্বালম্বি করে বাঁধ দিয়ে স্রোত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিতে হবে। দক্ষিণ ভারতে এ রকম বাঁধ অনেক কার্যকর প্রমাণিত।
পাশাপাশি দ্বীপের মানুষের আয়ের বিকল্প কর্মসংস্থান বা আয়ের উৎস সৃষ্টি করে পর্যটননির্ভরতা কমাতে হবে। একটা আবাসন নীতিমালা করে দ্বীপে পরিবেশবান্ধব বাড়ি ও ইকো রিসোর্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। যত্রতত্র রিসোর্ট করা বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত রিসোর্ট কমিয়ে ফেলতে হবে আর যেসব রিসোর্টের বিরুদ্ধে আইনি বাধা আছে, সেগুলো উচ্ছেদ করতে হবে।
সৈকত, জঙ্গল, খাল ও জলাভূমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে কিছু জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে বা ক্ষতিপূরণ হলেও সৈকতের ১০০ ফুট পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সে জমিতে বনায়ন করতে হবে। ঝাউগাছের পরিবর্তে ভাঙনপ্রতিরোধী কেয়াগাছ, নারকেল ও সাগরলতা রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?
তৈয়ব উল্লাহ, আন্দোলনকর্মী ও সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা