ডিপসিক বনাম চ্যাটজিপিটি: প্রযুক্তি যখন আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার
Published: 8th, February 2025 GMT
একজন রাঁধুনি বা শেফের কথা চিন্তা করা যাক। প্রতিদিন ছোট একটা পরিবারের রান্না তিনি একাই করে ফেলতে পারবেন। হরেক রকমের রান্নায় পারদর্শী হওয়ায় নানা স্বাদের বাহারি রান্নার আয়োজন করতে পারবেন।
কিন্তু প্রতিদিন যদি একটা রেস্তোরাঁর রান্নার দায়িত্ব তাঁর ওপর পড়ে, তাহলে শত শত মানুষের রান্না একা তাঁর পক্ষে সীমিত সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়। সমাধান হিসেবে ছোট ছোট কাজগুলো তিনি অন্য কাউকে ভাগ করে দিতে পারেন। যেমন শুধু পেঁয়াজবাটার জন্য একজন লোক, আলু কেটে দেওয়ার জন্য একজন লোক।
ধরা যাক, পেঁয়াজ কাটার ব্যক্তি একটি ব্লেন্ডিং মেশিন ব্যবহার করে কাজটুকু করেন। কিন্তু একই ধরনের কাজ হওয়ায় তিনি যদি একসঙ্গে ১০টা ব্লেন্ডিং মেশিন ব্যবহার করেন, তাহলে একই সময়ে ১০ গুণ বেশি কাজ করতে পারবেন।
এখানে প্রধান শেফকে কম্পিউটারের সিপিইউ, অর্থাৎ সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের (কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ অংশ) সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যেটি কম্পিউটারের নানা ধরনের কাজ সম্পন্নে পারদর্শী। আমাদের ডেস্কটপ, ল্যাপটপ বা মুঠোফোনে যত কাজ করা হয়, তার সবকিছু কম্পিউটারের ব্রেন বলে পরিচিত এই সিপিইউতে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়।
অপর দিকে পেঁয়াজবাটার কাজকে জিপিইউ, অর্থাৎ গ্রাফিক্যাল প্রসেসিং ইউনিটের কাজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। দশটা ব্লেন্ডিং মেশিনকে দশটা কোর বা প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সিপিইউর করা জটিল কাজের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সরল, একযোগে করা সেই কাজগুলো হতে হয় একই ধরনের। একটি উচ্চমানের জিপিইউতে হাজার হাজার কোর থাকতে পারে, যেখানে সিপিউ কোর সংখ্যা হয় সাধারণত আটটি বা তার কিছুটা বেশি। এনভিডিয়ার জিফোর্স আরটিএক্স ৪০৯০ মডেলের জিপিইউতে ১৬ হাজার ৩৮৪টি কোর আছে।
ছবি, ভিডিও, বিভিন্ন গেম খেলার ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তিমূলক গণনার প্রয়োজন হয় বলে শুরুতে শুধু সে ধরনের কাজে জিপিইউ ব্যবহার করা হতো। সেখান থেকেই এর নামকরণে গ্রাফিক্যাল (চিত্রসংক্রান্ত) কথাটা এসেছে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রসারের ফলে বিভিন্ন ধরনের মেশিন লার্নিং মডেল চালাতেও ব্যাপকসংখ্যক জিপিইউ প্রয়োজন হয়। মেশিন লার্নিং মডেল ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ) মূলত কোটি কোটি গাণিতিক গণনার মাধ্যমে করা হয়। সে গণনার কাজগুলো একযোগে কম সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় জিপিইউর কল্যাণেই।
বহুল আলোচিত চ্যাটজিপিটি এবং ভাষার জন্য প্রস্তুতকৃত সমজাতীয় বড় ধরনের মডেলগুলোকে (লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল) বিশাল পরিমাণ ডেটার মাধ্যমে ট্রেনিং করানো হয়। বলতে গেলে ইন্টারনেটে এযাবৎ লেখা প্রায় সবকিছুই সে ডেটার অন্তর্ভুক্ত থাকে। নির্দিষ্ট ভাষা জানা একজন ব্যক্তি যেমন একটি বাক্যের পর কী হতে পারে, তা অনুমান করতে পারেন বা ভাষার ব্যবহার করে নতুন ধারণা তৈরি করতে পারেন, একেবারে সঠিক না হলেও ভাষা মডেলগুলো সে রকম অনুমান করতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, বিষয়বস্তু তৈরি করতে পারে।
প্রবন্ধ লেখা থেকে শুরু করে অ্যাপ তৈরি, জীবনবৃত্তান্ত তৈরি, গাণিতিক সূত্র লেখা থেকে শুরু করে সারসংক্ষেপ তৈরি, কভার লেটার তৈরি, প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি, বর্ণনা থেকে শুরু করে ছবি কিংবা চার্ট তৈরি—কোনো কিছুই বাদ নেই ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের কাজের আওতা থেকে।
২০২৩ সালে চ্যাটজিপিটি প্রায় ৩০ হাজার এনভিডিয়া জিপিইউ ব্যবহার করেছিল তাদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য, যেগুলোর প্রতিটির দাম ছিল ১২ থেকে ১৮ লাখ টাকা (সূত্র: ট্রেন্ডফোর্স মার্কেট ইন্টেলিজেন্স)। সুপরিচিত ইন্টেল বা এএমডির রাজত্ব সিপিইউ চিপ তৈরিতে। আর এনভিডিয়ার রাজত্ব জিপিইউ চিপ তৈরিতে। বর্তমানে জিপিইউ বাজারের প্রায় ৯০ শতাংশই এনভিডিয়ার দখলে এবং এনভিডিয়া বাজার মূলধন প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
চ্যাটজিপিটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য লাখ লাখ ডলার খরচ হলেও প্রকৃত ব্যয়ের প্রয়োজন হয় সেটি পরিচালনা করতে, ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর দিতে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যে ব্যয় হয়, পরিচালনার জন্য তার বেশি খরচ হয়ে যায় এক সপ্তাহেই (সূত্র: ফোর্বস, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
ঠিক এ জায়গাতেই নতুনত্ব এনে গোটা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চায়নিজ প্রতিষ্ঠান ‘ডিপসিক’। ডিপসিক দাবি করেছে, অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাসম্পন্ন জিপিইউ ব্যবহার করেও তাদের মডেল তৈরি করতে সময় লেগেছে মাত্র দুই মাস এবং খরচ হয়েছে ছয় মিলিয়ন ডলারের কম।
২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টার্টআপ আরও বলেছে, তাদের মডেলগুলো কার্যক্ষমতায় শীর্ষ মার্কিন মডেলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম, অথচ খরচ হয় সেগুলোর তুলনায় অনেক কম।
এসব বৃহৎ মডেল তৈরিতে বিশাল কম্পিউটিং ক্ষমতা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে যে ধারণা করা হয়, ডিপসিকের দাবি সে ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দেয়। নড়েচড়ে বসে প্রযুক্তিবিশ্ব, যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ আইফোন ডাউনলোডে পরিণত হয় ডিপসিকের অ্যাপ। এনভিডিয়ার বাজার মূলধন একলাফে কমে যায় ৫৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এক দিনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় অঙ্কের ক্ষতি (সূত্র: ইয়াহু ফিন্যান্স)। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ৪৩৭ বিলিয়ন ডলার (সূত্র: ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ২০২৩)।
কিছু সূত্র হিসাব করে দেখিয়েছে, ডিপসিকের ট্রেনিং খরচ সমমানের প্রতিদ্বন্দ্বী মডেলগুলোর তুলনায় ২০ থেকে ৪০ ভাগের এক ভাগ। অপর দিকে কিছু সূত্র বলছে, এত কম খরচে এ মডেল তৈরির যে দাবি, সেটি বিভ্রান্তিকর এবং সেখানে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। তবে ওপেনএআইয়ের ও১ মডেল বা ডিপসিকের আর১ মডেল তুলনা করলে কয়েকটি জিনিস স্পষ্টত লক্ষণীয়। যেমন ওপেনএআইয়ের মডেল ব্যবহারের জন্য যেখানে প্রতি মাসে ২০ ডলার প্রদান করতে হয়, সেখানে ডিপসিক শুধু অ্যাপের মাধ্যমে বিনা মূল্যে ব্যবহারই করা যায় না, বরং ডাউনলোড ও ব্যবসায় প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ডেভেলপারদের জন্যও এটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। দুটি পরিষেবার উদ্দেশ্য খানিকটা ভিন্ন হলেও নেট দুনিয়ায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারকারী ও প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞরা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরছেন। কোনটির সবলতা কী বা দুর্বলতা কী, সেটিও উঠে আসছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক গবেষণা ও পরিষেবায় মডেল প্রশিক্ষণ বা শক্তিশালী চিপই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয় সফটওয়্যার অপটিমাইজেশন, উন্নত কুলিং সিস্টেম এবং বিশেষায়িত ডেটা সেন্টার ডিজাইনের। সেসবের জন্য প্রয়োজন হয় বড় আকারের বিনিয়োগের। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত গবেষণা করছে উন্নত সংস্করণের নতুন পণ্য বাজারে নিয়ে আসার জন্য।
ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলই একমাত্র ক্ষেত্র নয়, যেখানে বিশাল কম্পিউটিং ক্ষমতার ব্যবহার হয়ে থাকে। আরও বহু ধরনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে হাজার হাজার জিপিইউ, ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন ভবিষ্যৎ ব্যবহারের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক এই প্রতিযোগিতা বাজারের সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতিতে; জড়িয়ে পড়ছে দেশ ও সরকার।
বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন ঘটছে রীতির, প্রয়োজন পড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেন্দ্রিক নীতির। রীতিনীতির এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতিযোগিতা চলতে থাকুক, কিন্তু সেটির উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষ, লক্ষ্য যেন হয় মানবতার কল্যাণ, অকৃত্রিম এই পৃথিবীতে যেন বেঁচে থাকতে পারে ছোট-বড় প্রতিটি প্রাণ।
ড.
বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এনভ ড য় র ধরন র ক জ জ প ইউ ব য় র জন য স প ইউ ন করত ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে উপনিবেশিত সব দেশকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়েছিল। অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষা আর সংগ্রামের বিনিময়ে এসেছিল স্বাধীনতা; কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘মুকুটরত্ন’ খ্যাত ভারতের মতো এত বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরের দেশে ও দেশের বাইরে বিরাট ক্যানভাসে স্বাধীনতার সংগ্রাম মনে হয় আর কোনো উপনিবেশের স্বাধীনতার জন্য করতে হয়নি।
আমরা সাধারণত ভারতীয় উপমহাদেশে সক্রিয় ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু এমন অনেকে ছিলেন, যাঁরা ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে বিদেশের মাটিতে বসে অসংখ্য বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলাদেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা কিংবা জনপ্রিয় লেখাজোখাতেও তাঁদের আত্মত্যাগের গল্প খুব কমই উঠে আসে।
অথচ এই বিপ্লবীদের রয়েছে এমন এক গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বগাথা, যা ভারতীয় উপমহাদেশসহ সারা দুনিয়ায় ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামরত সব মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার। কল্পনা করুন, পুলিশের চোখ এড়াতে একজন বিপ্লবী সিঙ্গাপুরের উপকূল থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে পাড়ি দিচ্ছেন জেলে নৌকার সাহায্যে। আরেকজন ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে সাঁতরে পাড়ি দিচ্ছেন মিসরের সুয়েজ খাল। এসব ঘটনা থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের অদম্য প্রচেষ্টার দু–একটি উদাহরণ পাওয়া যায়।
বিদেশে বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু সুপরিচিত। তবে তাঁরও অনেক আগে একদল ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। শুরুতে তাঁরা জার্মানি এবং পরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন ১৮৯২ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী। তিনি একা নন, মস্কোয় আরও দুজন বাঙালি বিপ্লবী লুহানীর মতো একই ভাগ্য বরণ করেছিলেন। একজন তৎকালীন বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যজন সাতক্ষীরার অবনী মুখোপাধ্যায়।
যেভাবে বইটির সূচনা
সম্প্রতি প্রকাশিত গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী: এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি বই থেকে বিপ্লবী লুহানীর বর্ণিল জীবন ও বহুমুখী কার্যকলাপ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়। বইটির লেখক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লুহানীর জীবন ও কর্ম উদ্ঘাটন করেছেন তাঁর ৪২ বছরের নিরলস সাধনায়।
মতিউর রহমান ১৯৮১ সালে দিল্লি ভ্রমণে গেলে বিজ্ঞানী ও কমিউনিস্ট নেতা ড. গঙ্গাধর অধিকারীর কাছ থেকে লুহানীর কথা প্রথম জানতে পারেন। গঙ্গাধর অধিকারী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নিয়ে কাজ করার সময় লুহানীর বহুমুখী কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯২৯ সালের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর গ্রেপ্তারের ঘটনাটি বেশ আলোচিত। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ব্রিটিশ সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।
১৯৮১ সাল থেকে মতিউর রহমান লুহানী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বার্লিন, মস্কো, দিল্লি ও কলকাতার বিভিন্ন আর্কাইভের শরণাপন্ন হন। তিনি সবকিছু জোগাড় করতে পারেননি বলে বইয়ের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন। তবে আপাত ‘বিস্মৃত’ এই বিপ্লবীর ওপর যে পরিমাণ তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন, সেটিও অভূতপূর্ব।
এই বইয়ে লেখক লুহানীর বহুমুখী কাজের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিকও তুলে এনেছেন। বইটিতে প্যারিস থেকে সিরাজগঞ্জে মায়ের কাছে লেখা লুহানী ও তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলের চিঠি এবং তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় লুহানীর পরিবারের সদস্য ও কলকাতার একটি শিপিং এজেন্সির মধ্যকার চিঠি আদান–প্রদানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বইটির প্রতি লেখকের গভীর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। ১৯৮০’–এর দশকের মাঝামাঝি রুশ ইতিহাসবিদ ও ভারতবিশেষজ্ঞ লিওনিদ মিত্রোখিনের সঙ্গে লেখকের দেখা হয়েছিল মস্কোয়। ১৯৯১ সালে মিত্রোখিন দিল্লি থেকে প্রকাশিত সোভিয়েত ল্যান্ড পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো তিনজন বাঙালি বিপ্লবী—বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখোপাধ্যায় ও গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর করুণ পরিণতির কথা প্রকাশ করেন। তাঁদের সবারই বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্গে যোগসূত্র ছিল। নিবন্ধের শেষে মিত্রোখিন লিখেছেন, মতিউর রহমান লুহানীকে নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করছেন, যা এই বিপ্লবীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। কয়েক দশক পর অবশেষে ২০২৪ সালের অক্টোবরে সেই প্রতীক্ষিত বইটি আলোর মুখ দেখেছে।
বইটি থেকে জানা যায়, লুহানী প্রবেশিকা পরীক্ষা (বর্তমান মাধ্যমিক পরীক্ষার সমমান) পাস করার পর ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত মিডিয়া ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফতেহ লোহানী ও ফজলে লোহানী এবং তাঁদের বোন বিশিষ্ট গায়িকা অধ্যাপক হুসনা বানু খানমের মামা। ফজলে লোহানীর মাধ্যমে মতিউর রহমানের যোগাযোগ ঘটে গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর ভাগনে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদের সঙ্গে; যিনি বহু বছর ধরে পারিবারিক চিঠিগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।
বইটি যখন প্রকাশের জন্য প্রস্তুত, তার কয়েক মাস আগে ২০২৪ সালের মে মাসে একটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। নিউইয়র্কের শিল্প–গবেষক জুলিয়া বডেউইন মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে লুহানীর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েল সোয়েন সম্পর্কে জানতে চান। এই যোগাযোগের সূত্র ধরে আরও বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর জানা যায় যে গ্যাব্রিয়েল ছিলেন একজন ফরাসি মডেল ও ফ্যাশন ডিজাইনার।
লুহানীর খোঁজে
মতিউর রহমানের সংগ্রহ করা নথিপত্র থেকে জানা যায়, লুহানী লন্ডনে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও শ্রমিক আন্দোলন এবং সোভিয়েত বিপ্লবের সমর্থনে কাজ করেছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি সাংবাদিক ও শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে বসবাস করেন এবং সেখানকার সংবাদপত্রগুলোতে ভারতের রাজনৈতিক ও শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ইংরেজি ছাড়াও তিনি ফরাসি, ফারসি, জার্মান ও হিন্দি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
১৯২১ সালে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লুহানী প্রথম একটি প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী দলের অংশ হিসেবে মস্কো সফর করেন। কিন্তু দলটি কমিন্টার্নের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। তবে লুহানী কিছু সময়ের জন্য সেখানে থেকে কমিন্টার্নের প্রচার বিভাগ অ্যাজিটপ্রপে কাজ করেন। প্যারিসে থাকাকালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা দ্য মেসেজ অব ইন্ডিয়া সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এ ছাড়া তিনি কমিটি প্রো-হিন্দুর (ভারতীয় অর্থে) সঙ্গে কাজ করেছেন। এই কমিটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করত। ফরাসি লেখক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী ওঁরি বারবুস ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। বারবুসের লেখার মাধ্যমে ‘লস্ট জেনারেশন’–এর বহু লেখক প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও এরিখ মারিয়া রেমার্ক অন্যতম।
প্যারিসে থাকাকালে লুহানীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ উঠলে সেখানে তাঁর থাকার অনুমতি বাতিল করা হয়। এ বছরের জুলাই মাসে আমি প্যারিসে গেলে মোঁপানাস এলাকায় লুহানীর সেই বাড়ির ঠিকানায় যাই। বাড়ির উল্টো দিকে থাকা একটি ক্যাফের লোকদের সঙ্গে আলাপে লুহানীর কাহিনি শুনে তাঁরা অবাক হন। ক্যাফের একজন জানান, বাড়িটি এখনো আবাসিক ভবন হিসেবেই আছে; কিন্তু কোনো বাঙালি থাকেন বলে তাঁরা জানেন না। অপ্রত্যাশিতভাবে পাশের সড়কেই পেয়ে যাই লুহানীর স্ত্রীর পোর্ট্রেট আঁকা প্রখ্যাত শিল্পী আমেদেও মোদিলিয়ানির বাড়ি। যদিও লুহানীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর পরিচয়ের অনেক আগেই মোদিলিয়ানি সেই পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, এটি এখন আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯২৫ সালের অক্টোবরে লুহানী স্থায়ীভাবে মস্কোয় চলে যান। ১৯২৮ সালে তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ এবং ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এ সময়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের বৈশ্বিক কেন্দ্র কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে (কমিন্টার্ন) বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
লুহানীর ওপর লেখা এই বইয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে। তিনি সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে কমিন্টার্নসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। যুক্ত ছিলেন পিজ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল ও মোপার (বিপ্লবীদের সাহায্য করার আন্তর্জাতিক সংস্থা) সঙ্গে। এ ছাড়া তিনি রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, নারিমানভ ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ ও কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অব দ্য টয়েলার্স অব দ্য ইস্ট-এ কাজ করেছেন। তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় বিষয় নিয়েও বক্তৃতা দিতেন।
মস্কোয় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কমিন্টার্ন কংগ্রেসে লুহানী ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে তিনি এম এন রায়ের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। ১৯৬৪ সালের ৩০ আগস্ট, লিংক-এর মস্কো সংবাদদাতা পি উন্নিকৃষ্ণান একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে লুহানী জাতীয় ও ঔপনিবেশিক বিষয়ে কমিন্টার্নের একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। মতিউর রহমান ৪২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টা ও আবেগের সংমিশ্রণে সংগৃহীত নথিপত্র কাজে লাগিয়ে লুহানীর এই অসাধারণ জীবন ও বহুমুখী অবদানকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
লুহানী ছাড়াও এই বইয়ে বার্লিন ও মস্কোভিত্তিক ভারতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ও উদ্যোগের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। ১৯২১ সালে লুহানী, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং পান্ডুরাজ খানখোজে যৌথভাবে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন’ নামে একটি থিসিস রচনা করে রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এর প্রত্যুত্তরও তাঁরা পেয়েছিলেন লেনিনের কাছ থেকে। উল্লেখ্য, ‘নাইটিঙ্গেল অব দ্য ইস্ট’ নামে পরিচিত বিখ্যাত রাজনৈতিক কর্মী ও কবি সরোজিনী নাইডুর ছোট ভাই ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত লুহানীর প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষণক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিখ্যাত বিপ্লবী এম এন রায় এবং সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টির প্রশংসা করেছেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি ও সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে।
মরণোত্তর সম্মান
বইটিতে ব্যবহৃত সোভিয়েত গোয়েন্দা নথিপত্র থেকে জানা যায়, স্তালিনের শাসনামলে লুহানী সন্দেহ ও অবিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন। সেই সময়ে অনেককে ভিন্নমতের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই করুণ পরিণতি থেকে লুহানীও রেহাই পাননি। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর স্তালিনের নির্দেশে মস্কোর কাছে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডির প্রশিক্ষণ মাঠ কমিউনারকায় তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত সুপ্রিম কোর্টের সামরিক কলেজিয়াম তাঁর বিচারকে ভুল বলে ঘোষণা করে এবং তাঁকে মরণোত্তর সম্মান প্রদান করে।
এই বইয়ে লুহানীর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ও ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন’ থিসিসসহ অনেকগুলো চিঠি ও নথি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ড. বিনায়ক সেনের একটি প্রবন্ধ, লিওনিদ মিত্রোখিনের ‘আ ট্রিপল ট্র্যাপ’ নিবন্ধ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কমিন্টার্ন–বিশেষজ্ঞ ড. শোভনলাল দত্তগুপ্তের সঙ্গে মতিউর রহমানের একটি কথোপকথন। তাঁদের এই আলোচনায় সেই সময়ের বিপ্লবী, কমিন্টার্ন ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
লুহানীর দুর্লভ রঙিন ছবি, তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলের পোর্ট্রেট ও প্রতিকৃতি, বিভিন্ন শহরে তাঁদের বাসস্থানের ছবি এবং গুরুত্বপূর্ণ চিঠি যুক্ত করার মাধ্যমে বইটি আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বই থেকে একজন বাঙালি বিপ্লবীর করুণ পরিণতি সম্পর্কে যেমন জানা যায়, তেমনি বিচরণ করা যায় ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট কালপর্বে, যার প্রভাব আজও ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজ–রাজনীতির নানা স্তরে। নিঃসন্দেহে এই বই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
খলিলউল্লাহ্ লেখক ও সাংবাদিক
মতামত লেখকের নিজস্ব