ডিপসিক বনাম চ্যাটজিপিটি: প্রযুক্তি যখন আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার
Published: 8th, February 2025 GMT
একজন রাঁধুনি বা শেফের কথা চিন্তা করা যাক। প্রতিদিন ছোট একটা পরিবারের রান্না তিনি একাই করে ফেলতে পারবেন। হরেক রকমের রান্নায় পারদর্শী হওয়ায় নানা স্বাদের বাহারি রান্নার আয়োজন করতে পারবেন।
কিন্তু প্রতিদিন যদি একটা রেস্তোরাঁর রান্নার দায়িত্ব তাঁর ওপর পড়ে, তাহলে শত শত মানুষের রান্না একা তাঁর পক্ষে সীমিত সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়। সমাধান হিসেবে ছোট ছোট কাজগুলো তিনি অন্য কাউকে ভাগ করে দিতে পারেন। যেমন শুধু পেঁয়াজবাটার জন্য একজন লোক, আলু কেটে দেওয়ার জন্য একজন লোক।
ধরা যাক, পেঁয়াজ কাটার ব্যক্তি একটি ব্লেন্ডিং মেশিন ব্যবহার করে কাজটুকু করেন। কিন্তু একই ধরনের কাজ হওয়ায় তিনি যদি একসঙ্গে ১০টা ব্লেন্ডিং মেশিন ব্যবহার করেন, তাহলে একই সময়ে ১০ গুণ বেশি কাজ করতে পারবেন।
এখানে প্রধান শেফকে কম্পিউটারের সিপিইউ, অর্থাৎ সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের (কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ অংশ) সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যেটি কম্পিউটারের নানা ধরনের কাজ সম্পন্নে পারদর্শী। আমাদের ডেস্কটপ, ল্যাপটপ বা মুঠোফোনে যত কাজ করা হয়, তার সবকিছু কম্পিউটারের ব্রেন বলে পরিচিত এই সিপিইউতে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়।
অপর দিকে পেঁয়াজবাটার কাজকে জিপিইউ, অর্থাৎ গ্রাফিক্যাল প্রসেসিং ইউনিটের কাজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। দশটা ব্লেন্ডিং মেশিনকে দশটা কোর বা প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সিপিইউর করা জটিল কাজের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সরল, একযোগে করা সেই কাজগুলো হতে হয় একই ধরনের। একটি উচ্চমানের জিপিইউতে হাজার হাজার কোর থাকতে পারে, যেখানে সিপিউ কোর সংখ্যা হয় সাধারণত আটটি বা তার কিছুটা বেশি। এনভিডিয়ার জিফোর্স আরটিএক্স ৪০৯০ মডেলের জিপিইউতে ১৬ হাজার ৩৮৪টি কোর আছে।
ছবি, ভিডিও, বিভিন্ন গেম খেলার ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তিমূলক গণনার প্রয়োজন হয় বলে শুরুতে শুধু সে ধরনের কাজে জিপিইউ ব্যবহার করা হতো। সেখান থেকেই এর নামকরণে গ্রাফিক্যাল (চিত্রসংক্রান্ত) কথাটা এসেছে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রসারের ফলে বিভিন্ন ধরনের মেশিন লার্নিং মডেল চালাতেও ব্যাপকসংখ্যক জিপিইউ প্রয়োজন হয়। মেশিন লার্নিং মডেল ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ) মূলত কোটি কোটি গাণিতিক গণনার মাধ্যমে করা হয়। সে গণনার কাজগুলো একযোগে কম সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় জিপিইউর কল্যাণেই।
বহুল আলোচিত চ্যাটজিপিটি এবং ভাষার জন্য প্রস্তুতকৃত সমজাতীয় বড় ধরনের মডেলগুলোকে (লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল) বিশাল পরিমাণ ডেটার মাধ্যমে ট্রেনিং করানো হয়। বলতে গেলে ইন্টারনেটে এযাবৎ লেখা প্রায় সবকিছুই সে ডেটার অন্তর্ভুক্ত থাকে। নির্দিষ্ট ভাষা জানা একজন ব্যক্তি যেমন একটি বাক্যের পর কী হতে পারে, তা অনুমান করতে পারেন বা ভাষার ব্যবহার করে নতুন ধারণা তৈরি করতে পারেন, একেবারে সঠিক না হলেও ভাষা মডেলগুলো সে রকম অনুমান করতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, বিষয়বস্তু তৈরি করতে পারে।
প্রবন্ধ লেখা থেকে শুরু করে অ্যাপ তৈরি, জীবনবৃত্তান্ত তৈরি, গাণিতিক সূত্র লেখা থেকে শুরু করে সারসংক্ষেপ তৈরি, কভার লেটার তৈরি, প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি, বর্ণনা থেকে শুরু করে ছবি কিংবা চার্ট তৈরি—কোনো কিছুই বাদ নেই ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের কাজের আওতা থেকে।
২০২৩ সালে চ্যাটজিপিটি প্রায় ৩০ হাজার এনভিডিয়া জিপিইউ ব্যবহার করেছিল তাদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য, যেগুলোর প্রতিটির দাম ছিল ১২ থেকে ১৮ লাখ টাকা (সূত্র: ট্রেন্ডফোর্স মার্কেট ইন্টেলিজেন্স)। সুপরিচিত ইন্টেল বা এএমডির রাজত্ব সিপিইউ চিপ তৈরিতে। আর এনভিডিয়ার রাজত্ব জিপিইউ চিপ তৈরিতে। বর্তমানে জিপিইউ বাজারের প্রায় ৯০ শতাংশই এনভিডিয়ার দখলে এবং এনভিডিয়া বাজার মূলধন প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
চ্যাটজিপিটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য লাখ লাখ ডলার খরচ হলেও প্রকৃত ব্যয়ের প্রয়োজন হয় সেটি পরিচালনা করতে, ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর দিতে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যে ব্যয় হয়, পরিচালনার জন্য তার বেশি খরচ হয়ে যায় এক সপ্তাহেই (সূত্র: ফোর্বস, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
ঠিক এ জায়গাতেই নতুনত্ব এনে গোটা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চায়নিজ প্রতিষ্ঠান ‘ডিপসিক’। ডিপসিক দাবি করেছে, অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাসম্পন্ন জিপিইউ ব্যবহার করেও তাদের মডেল তৈরি করতে সময় লেগেছে মাত্র দুই মাস এবং খরচ হয়েছে ছয় মিলিয়ন ডলারের কম।
২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টার্টআপ আরও বলেছে, তাদের মডেলগুলো কার্যক্ষমতায় শীর্ষ মার্কিন মডেলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম, অথচ খরচ হয় সেগুলোর তুলনায় অনেক কম।
এসব বৃহৎ মডেল তৈরিতে বিশাল কম্পিউটিং ক্ষমতা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে যে ধারণা করা হয়, ডিপসিকের দাবি সে ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দেয়। নড়েচড়ে বসে প্রযুক্তিবিশ্ব, যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ আইফোন ডাউনলোডে পরিণত হয় ডিপসিকের অ্যাপ। এনভিডিয়ার বাজার মূলধন একলাফে কমে যায় ৫৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এক দিনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় অঙ্কের ক্ষতি (সূত্র: ইয়াহু ফিন্যান্স)। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ৪৩৭ বিলিয়ন ডলার (সূত্র: ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ২০২৩)।
কিছু সূত্র হিসাব করে দেখিয়েছে, ডিপসিকের ট্রেনিং খরচ সমমানের প্রতিদ্বন্দ্বী মডেলগুলোর তুলনায় ২০ থেকে ৪০ ভাগের এক ভাগ। অপর দিকে কিছু সূত্র বলছে, এত কম খরচে এ মডেল তৈরির যে দাবি, সেটি বিভ্রান্তিকর এবং সেখানে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। তবে ওপেনএআইয়ের ও১ মডেল বা ডিপসিকের আর১ মডেল তুলনা করলে কয়েকটি জিনিস স্পষ্টত লক্ষণীয়। যেমন ওপেনএআইয়ের মডেল ব্যবহারের জন্য যেখানে প্রতি মাসে ২০ ডলার প্রদান করতে হয়, সেখানে ডিপসিক শুধু অ্যাপের মাধ্যমে বিনা মূল্যে ব্যবহারই করা যায় না, বরং ডাউনলোড ও ব্যবসায় প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ডেভেলপারদের জন্যও এটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। দুটি পরিষেবার উদ্দেশ্য খানিকটা ভিন্ন হলেও নেট দুনিয়ায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারকারী ও প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞরা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরছেন। কোনটির সবলতা কী বা দুর্বলতা কী, সেটিও উঠে আসছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক গবেষণা ও পরিষেবায় মডেল প্রশিক্ষণ বা শক্তিশালী চিপই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয় সফটওয়্যার অপটিমাইজেশন, উন্নত কুলিং সিস্টেম এবং বিশেষায়িত ডেটা সেন্টার ডিজাইনের। সেসবের জন্য প্রয়োজন হয় বড় আকারের বিনিয়োগের। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত গবেষণা করছে উন্নত সংস্করণের নতুন পণ্য বাজারে নিয়ে আসার জন্য।
ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলই একমাত্র ক্ষেত্র নয়, যেখানে বিশাল কম্পিউটিং ক্ষমতার ব্যবহার হয়ে থাকে। আরও বহু ধরনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে হাজার হাজার জিপিইউ, ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন ভবিষ্যৎ ব্যবহারের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক এই প্রতিযোগিতা বাজারের সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতিতে; জড়িয়ে পড়ছে দেশ ও সরকার।
বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন ঘটছে রীতির, প্রয়োজন পড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেন্দ্রিক নীতির। রীতিনীতির এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতিযোগিতা চলতে থাকুক, কিন্তু সেটির উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষ, লক্ষ্য যেন হয় মানবতার কল্যাণ, অকৃত্রিম এই পৃথিবীতে যেন বেঁচে থাকতে পারে ছোট-বড় প্রতিটি প্রাণ।
ড.
বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এনভ ড য় র ধরন র ক জ জ প ইউ ব য় র জন য স প ইউ ন করত ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ৩১ বিভাগকে প্রস্তুতির নির্দেশ ইসির
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এবার এক নতুন আলোচনায় এসেছে গণভোট আয়োজনের সম্ভাবনা। রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী প্রস্তাব ও অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলেছে, সরকার যদি চায় তাহলে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একযোগে বা আলাদা দিনেও গণভোট আয়োজন সম্ভব। এজন্যই কমিশন সরকারের ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আগাম প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, আইন, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, স্থানীয় সরকার, তথ্য, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহনসহ ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব উপস্থিত ছিলেন।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল- একদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি পর্যালোচনা, অন্যদিকে গণভোট আয়োজনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ।
গণভোটের প্রস্তুতি নির্দেশনা
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতেই সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “গণভোট নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। তবে এটি হবে কি না, কবে হবে তা নির্ধারণ করবে সরকার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যদি গণভোট আয়োজনের নির্দেশ আসে, তাহলে যেন তা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায় সে জন্য প্রস্তুতি রাখা।”
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সভায় বলেন, “সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সেক্ষেত্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা আগে থেকেই বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত রাখে।”
সভায় আরো জানানো হয়, দুটি ভোট একসঙ্গে হলে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ইসি ইতোমধ্যে খসড়া ভোটকেন্দ্র তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকা অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোর রাস্তা, বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়।
ভোটকেন্দ্র, অবকাঠামো ও লজিস্টিক প্রস্তুতি
সভায় আলোচনা হয়, দেশের ৪২ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে হবে। যেসব স্থানে ভবন সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।
ইসির নির্দেশে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যাতায়াতের রাস্তা যেন ভোটের আগে মেরামত ও প্রবেশযোগ্য হয়। দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় হেলিপ্যাড সংস্কারের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রয়োজনে জরুরি পরিবহন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলাচলে সমস্যা না হয়।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা সচল রাখা, ভোটের দিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনি কর্মকর্তাদের লজিস্টিক সহায়তা ও যানবাহন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মেডিকেল টিম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা জানান, নির্বাচনের দিন প্রতিটি উপজেলায় একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হবে। প্রতিটি টিমে একজন চিকিৎসক, একজন নার্স ও প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকবে। দুর্গম এলাকায় ইউনিয়নভিত্তিক সহায়ক টিমও থাকবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও র্যাবকে যৌথভাবে প্রস্তুত রাখা হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অন্তত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন, যিনি আচরণবিধি প্রতিপালন তদারকি করবেন।
প্রযুক্তি ও নজরদারি ব্যবস্থা
ইসি জানিয়েছে, ভোটগ্রহণ ও ফলাফল প্রেরণে এবার সর্বাধুনিক ডিজিটাল ভোট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ডিভিএমএস) ব্যবহার করা হবে। এতে কেন্দ্র থেকে সরাসরি ফলাফল জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে পাঠানো সম্ভব হবে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আমরা চাই ফলাফল যেন দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ঘোষণা করা যায়। সেই জন্যই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে।”
তিনি আরো জানান, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তি রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হচ্ছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে।
গণভোটের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪২(১)-এর উপধারায় বলা আছে যদি সংবিধান সংশোধন বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত জানতে হয়, তবে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।
সরকার ও রাজনৈতিক মহলে সম্প্রতি সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদে সংস্কার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই গণভোটের বিষয়টি সামনে এসেছে।
তবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সংবেদনশীল। কিছু দল মনে করছে, একই সঙ্গে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করলে প্রশাসনিক চাপ বেড়ে যাবে; আবার কেউ কেউ বলছে, এতে ব্যয় কমবে ও জনসম্পৃক্ততা বাড়বে।
একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, “ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে এমনভাবে, যেন সরকার যেদিন গণভোটের সিদ্ধান্ত দেবে, সেদিনই কাজ শুরু করা যায়।”
অর্থনৈতিক প্রস্তুতি ও বাজেট বরাদ্দ
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচন একা আয়োজনের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা প্রায় ৮,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গণভোট যুক্ত হলে ব্যয় আরো ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অর্থ বিভাগের সচিব বৈঠকে জানান, বাজেট সংস্থান বিষয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ না করে শুধু অপরিহার্য খাতে অর্থ ব্যয় করতে বলা হয়েছে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা
ইসি সচিব বলেন, “আমরা প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল তৈরি করছি। শিক্ষক, সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীরা এতে থাকবেন।”
ইসি চায়, ভোটগ্রহণে যেন নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিরপেক্ষ শিক্ষকদের তালিকা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তথ্য মন্ত্রণালয় ও প্রচার কৌশল
ভোটার সচেতনতা বাড়াতে ইসি সংসদ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) এয়ারটাইম ব্যবহার করবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটাধিকার ও আচরণবিধি বিষয়ে সচেতনতামূলক ভিডিও প্রচার করা হবে। তথ্য মন্ত্রণালয় ও ইসি যৌথভাবে এই প্রচার অভিযান পরিচালনা করবে।
বিদেশি পর্যবেক্ষক ও প্রবাসী ভোটার
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা ও অনুমতি প্রক্রিয়া দ্রুত করা হবে। একই সঙ্গে ইসি প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের জন্য ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম চালু করছে। আগামী ১৬ নভেম্বর এর ট্রায়াল অ্যাপ উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছেন সচিব আখতার আহমেদ।
সরকারি সফরে সচিবদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিল ইসি
বৈঠকে সিইসি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা সরকারি সফরে দেশের যেখানেই যান না কেন, নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন। এটি আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।”
তিনি আরো বলেন, “নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতিতে সরকারের পূর্ণ সহায়তা চায়। কারণ নির্বাচন কমিশন একা এই বিশাল আয়োজন করতে পারে না, সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় জরুরি।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও ঢাকা-১৪ আসনের ভোটার তৌহিদুর রহমান বলেন, “সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই বৈঠক শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি ইঙ্গিত দেয় যে সরকার গণভোটের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে এবং ইসি চাইছে আগেভাগে প্রস্তুত থাকতে যাতে কোনো অঘটন বা বিলম্ব না ঘটে।”
তিনি বলেন, “এখন অপেক্ষা সরকারের সিদ্ধান্তের। সংসদ নির্বাচন ও গণভোট কি একসঙ্গে হবে, নাকি আলাদা দিনে। যেভাবেই হোক, নির্বাচন কমিশনের এই আগাম প্রস্তুতি বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আরো সংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে।”
ঢাকা/এস