কানাডার নাগরিকত্ব রেখেই ডব্লিউএইচওতে যান সায়মা
Published: 10th, February 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বাংলাদেশের পাশাপাশি কানাডারও নাগরিক। যদিও তিনি বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, মনোনয়নকালে তিনি কানাডার নাগরিক ছিলেন।
দ্বৈত নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করে সনদ নেওয়া যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সায়মা ওয়াজেদ সেই সনদ নেননি। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে না, তিনি দ্বৈত নাগরিক কি না। যদিও ২০০৮ সালের এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কানাডার ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রশ্নটি নৈতিকতার। সায়মা ওয়াজেদ বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে। ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক পদে বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে তাঁর মনোনয়নই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখন কানাডার নাগরিকত্ব থাকার বিষয়টিও সামনে এল।
দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ডব্লিউএইচওর আঞ্চলিক পরিচালক পদে সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল। তিনি যদি দ্বৈত নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মনোনয়নে ডব্লিউএইচওতে যান, সেটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
ডব্লিউএইচও নিজেদের কোড অব এথিকসে (নৈতিকতার নীতিমালা) কর্মীদের উদ্দেশে বলেছে, তারা সততাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সায়মা ওয়াজেদকে মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছিল আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে। খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট–এ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘এ ধরনের স্বজনপ্রীতি ডব্লিউএইচওর সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার মারাত্মক ক্ষতি করবে।’ যদিও বাংলাদেশ সরকার সেই সমালোচনাকে পাত্তা দেয়নি। সায়মা ওয়াজেদ ডব্লিউএইচওর ৭৬তম সম্মেলনে (২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর) নেপালের প্রার্থী শম্ভু প্রসাদ আচার্যকে হারিয়ে আঞ্চলিক পরিচালক হন। গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি দায়িত্ব নেন। সেই থেকে তিনি ওই পদে রয়েছেন।
ডব্লিউএইচওর আঞ্চলিক পরিচালক পদে সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল। তিনি যদি দ্বৈত নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মনোনয়নে ডব্লিউএইচওতে যান, সেটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামাননেপাল মনোনীত শম্ভু প্রসাদ আচার্য তখন ডব্লিউএইচওর সদর দপ্তরে একজন পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা সায়মা ওয়াজেদের চেয়ে অনেক বেশি বলে তখন বিভিন্ন নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, শম্ভু প্রসাদের ডব্লিউএইচওতে ৩০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি জনস্বাস্থ্যে একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে সায়মা ওয়াজেদের কানাডার নাগরিকত্বের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর কানাডা সরকার তাঁকে একটি পাসপোর্ট দেয়। ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্টটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৮ সালে। ২০২৩ সালে তাঁর নামে পাসপোর্ট রি-ইস্যু করা হয়, অর্থাৎ আবার দেওয়া হয়। এই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে ২০৩৩ সালে। পাতা শেষসহ বিভিন্ন কারণে পাসপোর্ট রি-ইস্যু করা হতে পারে।
সায়মা ওয়াজেদ ঠিক কোন বছর কানাডার নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তা জানা যায়নি। তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়ন করেন ২০২১ সালের ৩১ মে। এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০৩১ সালের ৩০ মে। কানাডায় নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ লাগে কি না জানতে চাইলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নবায়নের ক্ষেত্রে এই সনদ চাওয়া হয় না।
সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। তবে দ্বৈত নাগরিকত্বধারী কোনো ব্যক্তির জাতিসংঘসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার বড় পদে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। প্রশ্নটি নৈতিকতার।সায়মা ওয়াজেদের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও অন্যান্য বিষয়ে জানতে চেয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয়ে ই-মেইল করা হয়েছিল। তবে গতকাল (৯ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৮টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি।
দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। সংবিধানের ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন, তিনি সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। তবে দ্বৈত নাগরিকত্বধারী কোনো ব্যক্তির জাতিসংঘসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার বড় পদে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। প্রশ্নটি নৈতিকতার। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যখন সরকারপ্রধানের পরিবারের কেউ হন, তখন স্বজনপ্রীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন আরও বড় হয়ে দেখা দেয়।
দুদকের চিঠিদুদক সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের বিষয়ে নেওয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে জানাতে গত ২১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেয়। চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে।
দুদকের চিঠিতে বলা হয়, ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে সায়মা ওয়াজেদের মনোনয়ন ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সায়মা ওয়াজেদের ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে প্রদত্ত তথ্যাদি যথাযথ ছিল না। তিনি কানাডার নাগরিক। সায়মা ওয়াজেদের ভোটাভুটি উপলক্ষে ডব্লিউএইচওর ৭৬তম সম্মেলনে (২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর) নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের বিশাল প্রতিনিধিদল যায়, যা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।
দুদক আরও বলছে, সায়মা ওয়াজেদ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এবং তাঁর পরিবারিক রাজনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর আবাসিক প্রকল্পের কূটনৈতিক জোনে ১০ কাঠা আয়তনের প্লটের বরাদ্দ নেন। এ নিয়ে দুদক মামলা করেছে। এ ছাড়া সায়মা ওয়াজেদ ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামে প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন এবং ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে নিজে লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন রয়েছে। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রভাব বিস্তার করে সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে প্রাপ্য অর্থ করমুক্ত করেন।
সায়মা ওয়াজেদের ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে প্রদত্ত তথ্যাদি যথাযথ ছিল না। তিনি কানাডার নাগরিক। সায়মা ওয়াজেদের ভোটাভুটি উপলক্ষে ডব্লিউএইচওর ৭৬তম সম্মেলনে (২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর) নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের বিশাল প্রতিনিধিদল যায়, যা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিঠিটি পেয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যসচিব সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বহির্বিশ্বে এ ধরনের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা থাকে। বিষয়টি দেখতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, অবহিতকরণ চিঠিটি তাঁরা পেয়েছেন। কানাডার নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগ তুলে ডব্লিউএইচও থেকে সায়মা ওয়াজেদের অপসারণ চাইলে সফল হওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে যখন দ্বিপক্ষীয় বিষয় আসবে, তখন সায়মা ওয়াজেদ কাকে প্রতিনিধিত্ব করবেন, এটাই প্রশ্ন। তাই দ্বৈত নাগরিক হয়ে রাষ্ট্রীয় মনোনয়নে বৈশ্বিক সংস্থার কোনো পদে যাওয়া অনৈতিক।
ডব্লিউএইচওর এ ধরনের উঁচু পদে নিশ্চয়ই সবাই নৈতিকভাবে প্রশ্নহীন কাউকে দেখতে চাইবে। সংস্থাটি নিজেও নৈতিকতার চর্চা করে। সায়মা ওয়াজেদের উচিত হবে নিজেই দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া।সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবিরনতুন সরকারের অবস্থানজুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারত চলে যান। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার সায়মা ওয়াজেদের মাধ্যমে ডব্লিউএইচওর সঙ্গে যোগাযোগে আগ্রহী নয়। গত ৩০ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর সাংবাদিকদের বিষয়টি বলেছিলেন।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ডব্লিউএইচওর এ ধরনের উঁচু পদে নিশ্চয়ই সবাই নৈতিকভাবে প্রশ্নহীন কাউকে দেখতে চাইবে। সংস্থাটি নিজেও নৈতিকতার চর্চা করে। সায়মা ওয়াজেদের উচিত হবে নিজেই দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৩ স ল র র য গ যত স ল র ৩০ ন ত কত র এ ধরন র র মন ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ৩১ বিভাগকে প্রস্তুতির নির্দেশ ইসির
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এবার এক নতুন আলোচনায় এসেছে গণভোট আয়োজনের সম্ভাবনা। রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী প্রস্তাব ও অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলেছে, সরকার যদি চায় তাহলে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একযোগে বা আলাদা দিনেও গণভোট আয়োজন সম্ভব। এজন্যই কমিশন সরকারের ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আগাম প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, আইন, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, স্থানীয় সরকার, তথ্য, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহনসহ ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব উপস্থিত ছিলেন।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল- একদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি পর্যালোচনা, অন্যদিকে গণভোট আয়োজনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ।
গণভোটের প্রস্তুতি নির্দেশনা
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতেই সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “গণভোট নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। তবে এটি হবে কি না, কবে হবে তা নির্ধারণ করবে সরকার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যদি গণভোট আয়োজনের নির্দেশ আসে, তাহলে যেন তা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায় সে জন্য প্রস্তুতি রাখা।”
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সভায় বলেন, “সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সেক্ষেত্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা আগে থেকেই বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত রাখে।”
সভায় আরো জানানো হয়, দুটি ভোট একসঙ্গে হলে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ইসি ইতোমধ্যে খসড়া ভোটকেন্দ্র তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকা অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোর রাস্তা, বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়।
ভোটকেন্দ্র, অবকাঠামো ও লজিস্টিক প্রস্তুতি
সভায় আলোচনা হয়, দেশের ৪২ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে হবে। যেসব স্থানে ভবন সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।
ইসির নির্দেশে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যাতায়াতের রাস্তা যেন ভোটের আগে মেরামত ও প্রবেশযোগ্য হয়। দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় হেলিপ্যাড সংস্কারের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রয়োজনে জরুরি পরিবহন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলাচলে সমস্যা না হয়।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা সচল রাখা, ভোটের দিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনি কর্মকর্তাদের লজিস্টিক সহায়তা ও যানবাহন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মেডিকেল টিম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা জানান, নির্বাচনের দিন প্রতিটি উপজেলায় একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হবে। প্রতিটি টিমে একজন চিকিৎসক, একজন নার্স ও প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকবে। দুর্গম এলাকায় ইউনিয়নভিত্তিক সহায়ক টিমও থাকবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও র্যাবকে যৌথভাবে প্রস্তুত রাখা হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অন্তত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন, যিনি আচরণবিধি প্রতিপালন তদারকি করবেন।
প্রযুক্তি ও নজরদারি ব্যবস্থা
ইসি জানিয়েছে, ভোটগ্রহণ ও ফলাফল প্রেরণে এবার সর্বাধুনিক ডিজিটাল ভোট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ডিভিএমএস) ব্যবহার করা হবে। এতে কেন্দ্র থেকে সরাসরি ফলাফল জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে পাঠানো সম্ভব হবে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আমরা চাই ফলাফল যেন দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ঘোষণা করা যায়। সেই জন্যই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে।”
তিনি আরো জানান, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তি রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হচ্ছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে।
গণভোটের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪২(১)-এর উপধারায় বলা আছে যদি সংবিধান সংশোধন বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত জানতে হয়, তবে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।
সরকার ও রাজনৈতিক মহলে সম্প্রতি সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদে সংস্কার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই গণভোটের বিষয়টি সামনে এসেছে।
তবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সংবেদনশীল। কিছু দল মনে করছে, একই সঙ্গে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করলে প্রশাসনিক চাপ বেড়ে যাবে; আবার কেউ কেউ বলছে, এতে ব্যয় কমবে ও জনসম্পৃক্ততা বাড়বে।
একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, “ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে এমনভাবে, যেন সরকার যেদিন গণভোটের সিদ্ধান্ত দেবে, সেদিনই কাজ শুরু করা যায়।”
অর্থনৈতিক প্রস্তুতি ও বাজেট বরাদ্দ
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচন একা আয়োজনের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা প্রায় ৮,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গণভোট যুক্ত হলে ব্যয় আরো ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অর্থ বিভাগের সচিব বৈঠকে জানান, বাজেট সংস্থান বিষয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ না করে শুধু অপরিহার্য খাতে অর্থ ব্যয় করতে বলা হয়েছে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা
ইসি সচিব বলেন, “আমরা প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল তৈরি করছি। শিক্ষক, সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীরা এতে থাকবেন।”
ইসি চায়, ভোটগ্রহণে যেন নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিরপেক্ষ শিক্ষকদের তালিকা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তথ্য মন্ত্রণালয় ও প্রচার কৌশল
ভোটার সচেতনতা বাড়াতে ইসি সংসদ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) এয়ারটাইম ব্যবহার করবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটাধিকার ও আচরণবিধি বিষয়ে সচেতনতামূলক ভিডিও প্রচার করা হবে। তথ্য মন্ত্রণালয় ও ইসি যৌথভাবে এই প্রচার অভিযান পরিচালনা করবে।
বিদেশি পর্যবেক্ষক ও প্রবাসী ভোটার
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা ও অনুমতি প্রক্রিয়া দ্রুত করা হবে। একই সঙ্গে ইসি প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের জন্য ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম চালু করছে। আগামী ১৬ নভেম্বর এর ট্রায়াল অ্যাপ উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছেন সচিব আখতার আহমেদ।
সরকারি সফরে সচিবদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিল ইসি
বৈঠকে সিইসি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা সরকারি সফরে দেশের যেখানেই যান না কেন, নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন। এটি আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।”
তিনি আরো বলেন, “নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতিতে সরকারের পূর্ণ সহায়তা চায়। কারণ নির্বাচন কমিশন একা এই বিশাল আয়োজন করতে পারে না, সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় জরুরি।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও ঢাকা-১৪ আসনের ভোটার তৌহিদুর রহমান বলেন, “সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই বৈঠক শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি ইঙ্গিত দেয় যে সরকার গণভোটের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে এবং ইসি চাইছে আগেভাগে প্রস্তুত থাকতে যাতে কোনো অঘটন বা বিলম্ব না ঘটে।”
তিনি বলেন, “এখন অপেক্ষা সরকারের সিদ্ধান্তের। সংসদ নির্বাচন ও গণভোট কি একসঙ্গে হবে, নাকি আলাদা দিনে। যেভাবেই হোক, নির্বাচন কমিশনের এই আগাম প্রস্তুতি বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আরো সংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে।”
ঢাকা/এস