দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই জোর দিতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বিনিময় হারের ওপর চাপ কমিয়ে রিজার্ভ ধরে রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপে সরকারও সমর্থন দিচ্ছে। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে চলতি অর্থবছরে সরকারে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। সেটি কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭–৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায়। সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে গতকাল সোমবার চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি–জুন) জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আপাতত তাদের প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতির কমিয়ে আনা। তাই এ মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে খুব বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না।

নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭-৮% নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রানীতির বিভিন্ন কৌশল তুলে ধরেন ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। নীতি সুদহারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। আগের মতোই ১০ শতাংশে রাখা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান বলেন, অনেক দিন ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করলেও তা নিয়ন্ত্রণে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ছিল অপ্রতুল। অনেক ক্ষেত্রে নীতি গ্রহণও বিলম্বিত হয়েছে। এ জন্য মূল্যস্ফীতি কমেনি।

হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের অগ্রাধিকারে নেই। সরকার চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আমরাও মনে করছি, অর্থবছর শেষে তা ৫ শতাংশের ওপরেই থাকবে। এরই মধ্যে দেশের চলতি ও আর্থিক হিসাব ইতিবাচক হয়েছে। আগামী দিনে লেনদেন ভারসাম্যও ইতিবাচক ধারায় ফিরবে, যা ডলারের ওপর চাপ কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ মুহূর্তে তাদের সামনে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা, রিজার্ভ বাড়ানো ও ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা বৃদ্ধি।

ভঙ্গি সংকোচনমূলক

মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ফলে সব ধরনের নীতি সুদহার আগের মতোই থাকবে। এবারের মুদ্রানীতির ভঙ্গি হবে প্রকৃত সংকোচনমূলক।

নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, আগামী জুন পর্যন্ত নীতি সুদহার বা রেপো রেট ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর নেওয়া ঋণের সুদ নতুন করে বাড়বে না। গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর জন্য চালু করা বিশেষ ধরনের ধার বা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা আগের মতো সাড়ে ১১ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির (এসডিএফ) সুদহার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশে বহাল রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, কঠোর নীতির ধারাবাহিকতা ও অংশীজনদের সহযোগিতায় নিকট ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নেমে আসবে। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমেছে।

এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাকেও অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে নতুন মুদ্রানীতিতে।

বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়বে

মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতেও একই লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কমানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা। চলতি অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের জন্য সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ১৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বর যা ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির নতুন এ লক্ষ্যমাত্রার ফলে আগামী জুনে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ।

মুদ্রানীতিতে বলা হয়, দেশে খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। তাই খেলাপি ঋণের এ চাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে বেশ কিছু ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জোরদার, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত ও যথাযথভাবে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। এসব নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব সরক র দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে

সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।

পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।

অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ  ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।

একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের  প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। 

অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে,  মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে  ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
  • ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ বিএসইসির
  • বেসরকারি খাত পিপিপিতে আকৃষ্ট নয়, বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকা
  • কমপ্লায়েন্সের অভাবে ধুঁকছে চামড়া খাতের রপ্তানি
  • ৫ বছরে ঋণের স্থিতি বাড়বে ৫৩.৭৭ শতাংশ: অর্থবিভাগ